সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

নারীর চাকরি নিয়ে আপত্তি ও বাস্তবতা

জুবায়ের আহমেদ
  ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

নারীর কাজ নিয়ে ইসলাম ধর্মে বিধি-নিষেধ আছে। ইসলাম স্পষ্টত রূপরেখা দিয়েছে নারীরা কেমন কাজে নিজেদের নিয়োজিত করতে পারবে ও কেমন কাজে পারবে না এবং কোন অবস্থায় কাজ করতে পারবে। ইসলামে নারীর কাজ নিয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকার পরও বাংলাদেশে নারীর কাজ নিয়ে সেসব ব্যাখ্যা সামনে না এনে ঢালাওভাবে সমালোচনা হয়। সম্প্রতি এক তরুণ ক্রিকেটারের পুরনো পোস্ট নিয়েও এক শ্রেণির মানুষ সমালোচনা করেছে এবং দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। পক্ষ-বিপক্ষে আলোচনার এক পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টির ইতি টানলেও নারীর কর্ম বিষয়ে কিছু কথা থেকেই যায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেসব কথা তোলে ধরার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।

বর্তমান বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ হলেও বিগত দুই দশক পূর্বেও গরিব রাষ্ট্র হিসেবেই বিবেচিত হতো বহিঃবিশ্বে। ধীরে ধীরে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হলেও এখনো বহু মানুষ বড়জোর ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকার মতো রুজি করতে পারে। বহু পরিবারের কর্তা ব্যক্তি তার রুজি দিয়ে পরিবারের সদস্যদের প্রয়োজন মেটাতে পারেন না। গরিব রাষ্ট্র এবং জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় সবার কাছে নগদ অর্থকড়ি কিংবা জমিজমা নেই। ফলে পরিবারের বড় সন্তান ছেলে কিংবা মেয়ে হোক, পরিবারের অভাব অনটন ঘুছানোর জন্য কাজে নিয়োজিত হতে হচ্ছে। বহু পরিবার আছে যেসব পরিবারের সব সন্তানই কন্যা সন্তান, কিন্তু নেই তাদের অর্থকড়ি। ভিটেবাড়ি ছাড়া বাড়তি জমিজমা নেই। এছাড়া গরিব বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, গরিব স্বামীর অসুস্থতা, স্বামী অকর্মঠ কিংবা নেশাগ্রস্ত, এসব বাংলাদেশের স্বাভাবিক চিত্র। ফলে বাধ্য হয়ে লাখ লাখ নারীকে গার্মেন্টস, কলকারখানাসহ সাধারণ বহু পেশায় নিয়োজিত হতে হচ্ছে। গার্মেন্টস ও কল কারখানায় নারী শ্রমিকরা কিন্তু শখের বশে কাজ করে না, বাধ্য হয়ে পরিবারের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের জন্যই তাদের কাজে নিয়োজিত হতে হচ্ছে। বাংলাদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের দেশ কিন্তু এই দেশে যাকাতের সুষ্ঠু ও সুষম বণ্টন হয় না, ফলে চাকরি না করে কিংবা ঘরে বসেই আয় রোজগার করা যায়, এমন বহু কাজে নারী নিয়োজিত হতে পারছে না অর্থাৎ মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ইসলামী সমাজের কর্তাব্যক্তিদের উলেস্নখযোগ্য কোনো কার্যক্রম নেই।

ইসলাম নারীকে বিভিন্নভাবে সম্মানিত করেছে। সন্তানের কাছে পিতা-মাতার মধ্যে মাতাকে পরপর তিনবার সম্মানের জায়গায় রেখে চতুর্থ স্থানে রাখা হয়েছে বাবাকে। মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের জান্নাত ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়াও নারীর মৌলিক অধিকারের জন্য অর্থব্যয়সহ নারীর অর্থ সংক্রান্ত যাবতীয় প্রয়োজন মেটানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে পিতা-ভ্রাতা ও বিবাহ পরবর্তী সময়ে স্বামী-সন্তানের ওপর অর্থাৎ জীবিকা নির্বাহের জন্য যে কায়িক পরিশ্রম করতে হয়, এই পরিশ্রমের ভার দিয়েছেন পুরুষের কাঁধে। পুরুষরাও স্রষ্টাপ্রদত্ত দায়িত্বভার গ্রহণের মাধ্যমে দায়িত্ব পালন করছে। ইসলামের এই স্বাভাবিক নিয়মের মাঝেও একাধিক বিশেষ প্রয়োজনে নারীর কাজ অর্থাৎ বৈধ উপায়ে আয় রোজগারের সুযোগ রেখেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় যেহেতু লাখ লাখ নারীকে খুবই সাধারণ মানের অর্থাৎ গার্মেন্টস, কারখানা, নির্মাণকাজসহ অসংখ্য পরিশ্রমের কাজে নিয়োজিত হতে হয়, ধর্মসচেতন নাগরিকদের উচিত এসব নারীরা যেন কর্মক্ষেত্রে কোনো হয়রানির শিকার না হয় এবং যারা পর্দা সহকারে কাজ করতে চায়, তাদের সেই স্বাভাবিক পরিবেশ দেয়ার জন্য কাজ করা এবং জোরালো ভূমিকা রাখা, কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই কারো।

নারীর কাজের পাশাপাশি নারীর উচ্চ শিক্ষা নিয়েও আপত্তি অনেকের। অথচ নারীর উচ্চশিক্ষায় ইসলামে বাধা নেই। ফলে নারীর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য হলেও উচ্চশিক্ষিত নারী শিক্ষিকা প্রয়োজন। নারীর চিকিৎসা কাজে নারী ডাক্তার প্রয়োজন, ডাক্তার মানেই উচ্চশিক্ষিত নারী। এছাড়াও যে পরিবারটিতে কোনো পুরুষ নেই অর্থাৎ পিতৃহীন পরিবারের সব সদস্যই নারী, তাদের পরিবারের কাজে আইনজীবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ সব প্রয়োজনে নারী হওয়া জরুরি। এসব বিবেচনায়ও যে কোনো পেশায় নারীর অংশগ্রহণ অত্যাবশ্যক। কিন্তু পুরুষরা এসব প্রয়োজন উপলব্ধি না করে নারীদের গৃহে আটকে রাখার চেষ্টারত থাকছে। তাদের যুক্তি অনুযায়ী যদি বলা হয়, নারীর কাজ যদি নিষিদ্ধ অর্থাৎ হারাম হয়, তাহলে পুরুষের চাকরি থেকে ঘুষ খাওয়া, চাকরিতে যে কোনো হারাম কাজে লিপ্ত হওয়া, ব্যবসা করলে ওজনে কম দেওয়া, অবৈধ কিংবা মেয়াদহীন পণ্য বিক্রয় করাসহ বহু হারাম কাজে লিপ্ত আছে পুরুষ। বাংলাদেশে এখন সবাই লুটপাটে ব্যস্ত। তাদের মধ্যে অধিকাংশই পুরুষ। কিন্তু পুরুষের পেশাগত কাজে এই হারাম নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না, আলোচনা হয় শুধু নারী/স্ত্রী চাকরি করলে কি হয়, সেসব নিয়ে।

বাংলাদেশ সরকারের সংবিধান এবং জাতিসংঘ কর্তৃক নারী বিষয়ে ঘোষিত বিধিমালা অনুযায়ী নারীর উন্নয়নসহ যাবতীয় বিষয়ের ওপর সরকার গুরুত্বারোপ করে। যেহেতু বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যার মধ্যে ৯৯ জন পুরুষের মধ্যে ১০০ জন নারী, সেহেতু নারীদের শিক্ষা ও বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত করার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার কাজ করে। দেশের নাগরিক হিসেবে সরকারের এই চেষ্টায় অংশগ্রহণ করা প্রয়োজন। একটি বিষয় উলেস্নখ করা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও বাংলাদেশ ইসলামী আইনে পরিচালিত হয় না। এছাড়াও জাতীয় নির্বাচনের সময় বেশ কয়েকটি ইসলামী দল অংশগ্রহণ করলেও এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমরা ইসলামী দলগুলোকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করে না অর্থাৎ যে দলগুলো ইসলামিক নয়, সেই দলগুলোকেই ভোট দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আনে নাগরিকরা অথচ সবকিছুতে ইসলামের বিধান প্রতিষ্ঠা চায়। বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা দলগুলো যেহেতু নারীদের শিক্ষা ও কর্মে ব্যাপকভাবে উৎসাহ দেয় এবং এসব জেনে শুনেই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমেরা দলগুলোকে ভোট দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসায়, সেহেতু নাগরিকদের উচিত দ্বিচারিতা বাদ দিয়ে নারী শিক্ষা ও নারীর সুস্থ স্বাভাবিক কর্মজীবনে সর্বাত্মক সহায়তা করা। ব্যক্তি জীবনে ধর্মের গুরুত্ব অসীম হলেও ধর্মের বিধানকে সমুন্নত রেখে একটি রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে নারী-পুরুষের অংশগ্রহণ অতীব জরুরি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে