রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের এক বীর যোদ্ধা রানী ভেলু নাচিয়ার

বাল্যকালেই পিতামাতার আগ্রহের কারণে এ রাজকন্যা লাঠি চালনা, ধনুবিদ্যা ও অসি চালনাসহ সবরকমের অস্ত্র চালনায় পারদর্শী হয়ে উঠেন। গান বাজনায় পারদর্শিতাসহ তিনি ইংরেজি ফারসি ও উর্দু ভাষায় অসামান্য দক্ষতা অর্জন করেন। নাচিয়ার শিবগাঙ্গাইয়ের রাজকুমার মুথুভাদু উদয়থেভারের সঙ্গে তার বিয়ে হয় মাত্র ১৬ বছর বয়সে। তাদের একমাত্র কন্যার নাম ভেলস্নাচি। প্রায় ১০ বছর রাজ্য শাসন করেন ভেলু নচিয়ারের স্বামী মুথুভাদু।
তপন কুমার দাশ
  ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

ভেলু নাচিয়ার, ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের এক বীর যোদ্ধা। এখন থেকে প্রায় ছয় শত বছর আগে তিনি অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেন ব্রিটিশ সৈন্যদের বিরুদ্ধে। এ জন্য তিনি গড়ে তোলেন এক সুশিক্ষিত সৈন্যদল। যাদের বীরত্বে থর থরে কেঁপে উঠে ব্রিটিশ বাহিনী। ব্রিটিশদের কবল থেকে নিজ রাজ্য পুনরুদ্ধারে তিনি যে সাহস ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন তা আজও স্মৃতিতে অম্স্নান হয়ে রয়েছে ভারতীয়দের। তামিল জনপদে তাকে তার বীরত্বের জন্য ধীরামঙ্গাই বা সাহসী কন্যা হিসেবে অভিহিত করা হয়।

১৭৩০ সালে রানী ভেলু নাচিয়ার তৎকালীন রামনাদ রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা রামনাদের রাজা চেলস্নামযু বিজয় রঘুনাথ সেতুপাথি ও মাতার নাম সাকান্দি মুযান, যিনি রানী সাকান্দি নামেই পরিচিত ছিলেন। বাল্যকালেই পিতামাতার আগ্রহের কারণে এ রাজকন্যা লাঠি চালনা, ধনুবিদ্যা ও অসি চালনাসহ সবরকমের অস্ত্র চালনায় পারদর্শী হয়ে উঠেন। গান বাজনায় পারদর্শিতাসহ তিনি ইংরেজি ফারসি ও উর্দু ভাষায় অসামান্য দক্ষতা অর্জন করেন।

নাচিয়ার শিবগাঙ্গাইয়ের রাজকুমার মুথুভাদু উদয়থেভারের সঙ্গে তার বিয়ে হয় মাত্র ১৬ বছর বয়সে। তাদের একমাত্র কন্যার নাম ভেলস্নাচি। প্রায় ১০ বছর রাজ্য শাসন করেন ভেলু নচিয়ারের স্বামী মুথুভাদু।

তারপর এক সময় ব্রিটিশরা আর্কটের নবাবের সঙ্গে যোগ দিয়ে শিবগঙ্গাই আক্রমণ করে। ইংরেজরা ভেলু নাচিয়ারের স্বামীকে 'কালাইয়ার কোয়েল 'যুদ্ধে হত্যা করে'। তখন ভেলু নাচিয়ায় তার মেয়েকে নিয়ে তার রাজ্য ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। তিনি ডিন্ডিগুলের বিরুপাচিতে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পান এবং সেখানে গাপাল নায়েকারের অভয়ারণ্যে আট বছর অতিবাহিত করেন।

ডিন্ডিগুলে থাকাকালীন, ভেলু নাচিয়ার সেখানকার সুলতান এবং মহীশূরের তৎকালীন শাসক হায়দার আলীর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি সুলতানের সঙ্গে উর্দুতে কথা বলেন এবং তার দক্ষতা ও অধ্যবসায় সুলতানকে অত্যন্ত মুগ্ধ করে। এ ভেলু নাচিয়ার হায়দার আলীর কাছ থেকেও সমর্থন অর্জন করেন। তাদের সঙ্গে মিত্রতা বন্ধনে আবদ্ধ হন ভেলু নাচিয়ার।

হায়দার আলীর সহায়তায় এক সময় ভেলু নাচিয়ায় একটি সুশিক্ষিত ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। তারপরই তিনি নিজ রাজ্য থেকে ব্রিটিশ বাহিনীকে তাড়ানোর জন্য যুদ্ধের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি নিজেই আক্রমণ করেন ব্রিটিশ বাহিনীকে।

১৭৮০ সালে ভেলু নাচিয়ারের অন্যতম সেনাপতি আদিবাসী বীরকন্যা কুইলি সারা গায়ে গোলা-বারুদ বেঁধে ব্রিটিশদের অস্ত্র ও গোলাবারুদের গুদামে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালান। এতে ধ্বংস হয় ব্রিটিশদের সব গোলা বারুদ। গোলাবরুদের গুদামে ঝাঁপ দেয়ার সময় কুইলি নিজের গায়ে ঘি ঢেলে তাতে আগুন ধরিয়ে দেন। এ আগুন ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র গুদামে এবং গুদামের প্রতিটি অংশই ধ্বংস হয় যায়। কুইলিকে অনেকেই ভেলু নাচিয়ারের দত্তক কন্যা বলে জানেন। ভেলু নাচিয়ারের অপর এক দত্তক কন্যা ব্রিটিশদের আর একটি অস্ত্রগারে আত্মঘাতী হামলা চালান এবং সেটিও উড়িয়ে দেন। ফলে, ব্রিটিশরা রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হয়। তারা পরাজয় বরণ করে এবং ছেড়ে যায় সে এলাকা।

ব্রিটিশদের পরাজিত করে ভেলু নাচিয়ার হারানো রাজ্যের সিংহাসনে বসেন এবং এক দশক ধরে শিবগঙ্গাই রাজ্যে রাজত্ব করেন। তিনি তার কন্যা ভেলস্নাচিকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী নির্বাচন করেন। হায়দার আলীর সাহায্যের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে, ভেলু নাছিয়ার সারাগানিতে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। তিনি হায়দার আলীর ছেলে টিপু সুলতানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তিনি তাকে ভাইয়ের মতো সম্মান করতেন। তাদের সহায়তা নিয়েই রানী নিজ রাজ্যে প্রশাসনিক উন্নয়ন সাধন করেন। নিজ রাজ্যে তিনি শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করেন।

রানী ভেলু নাচিয়ার ১৭৯৬ সালে ছেষট্টি বছর বয়সে তার প্রিয় রাজ্য শিবগাঙ্গাইতে মারা যান।

ভাবতে অবাক লাগে, সেই আঠার শতকে রানী নাচিয়ার পুরুষতন্ত্রকে উপেক্ষা শুধু নিজেই অস্ত্র চালনায় অংশ নেননি, তিনি তার প্রধান সেনাপতি হিসেবে দুইজন নারীকেই নিয়োজিত করেন। এই দুই নারীই নিজেদের জীবন দিয়ে দখলদার ইংরেজ বাহিনীকে বিতাড়িত করেছেন নিজ রাজ্য থেকে। ইতিহাস আজও সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করে এই নারী যোদ্ধাদেরও।

তামিল-আমেরিকান হিপ-হপ শিল্পী অধ্যাপক এ এল আই 'আমাদের রানী' শিরোনামের একটি গান ভেলু নাচিয়ারকে উৎসর্গ করেন। ২০০৮ সালে তামিলনাডু সরকার রানীর স্মরণে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে। তামিলনাডুর শিবগাঙ্গাইতে ভেলু নাচিয়ারের মূর্তি স্থাপিত হয়। চেন্নাইয়ের ওভিএম ড্যান্স একাডেমি কর্তৃক তার নামে একট জমকালো ব্যালে পরিবেশনা উপস্থাপন করা হয়। চেন্নাইয়ের নারদ গণসভায়ও তার নামে একটি ব্যালে পারফরম্যান্স অনুষ্ঠিত হয়। তালিমনাডুর সাবেক মুখ্যমন্ত্রী, প্রয়াত জে. জয়ললিতা, ১৮ জুলাই, ২০১৪-এ শিবগাঙ্গাইতে বীরমাঙ্গাই ভেলু নাচিয়ার স্মৃতিসৌধের উদ্বোধন করেন। রানীর একটি ছয় ফুট ব্রোজের মূর্তিও স্থাপন করা হয়।

২০২৩ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ভেলু নাচিয়ারকে 'নারী শক্তির প্রতীক' বলে ঘোষণা দিয়ে সম্মান জানান।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে