শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

তালাক একটি সামাজিক ব্যাধি

বিয়ে বিচ্ছেদ যে কয়েক বছর ধরে বাড়ছে, তা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) তথ্যেও দেখা যায়। বেশি বাড়ছে শিক্ষিত দম্পতিদের মধ্যে। বিবিএসের ২০২১ সালের 'বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস' শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৫ বছর ধরে তালাকের হার ঊর্ধ্বমুখী। সবচেয়ে বেশি রাজশাহী বিভাগে, কম সিলেটে
সামছুর রহমান
  ০৩ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০

দেশে সংসার ভেঙে যাওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। বিয়ে বিচ্ছেদের সংখ্যা রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি। গত বছর ঢাকায় প্রতি ৪০ মিনিটে ১টি করে তালাক হয়েছে। বিচ্ছেদ বাড়ছে ঢাকার বাইরেও। বিচ্ছেদের আবেদন নারীরা বেশি করছেন। নির্যাতন-পীড়ন থেকে আত্মমর্যাদাবান নারীরা তালাকে খুঁজছেন মুক্তি হিসেবে। বিচ্ছেদের আবেদনের পর সমঝোতা হয়েছে খুবই কম ৫ শতাংশের নিচে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এবং জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে বিয়ে বিচ্ছেদের এই চিত্র পাওয়া গেছে।

বিয়ে বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন এখনো চলমান। এ আইন অনুযায়ী, রাজধানীতে তালাকের আবেদন পাঠাতে হয় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রের কার্যালয়ে। আবেদন প্রথমে সেখানে নথিবদ্ধ হয়। মূলত স্ত্রী যে ঠিকানায় থাকেন, আবেদনটি সেখান থেকে পাঠানো হয় সে অঞ্চলের কার্যালয়ে।

ঢাকার দুই সিটির মেয়রের কার্যালয়ের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালে তালাকের আবেদন এসেছিল মোট ১৩ হাজার ২৮৮টি। এর মধ্যে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৭ হাজার ৬৯৮টি, উত্তর সিটিতে ৫ হাজার ৫৯০টি। এ হিসেবে রাজধানীতে প্রতিদিন ভেঙে যাচ্ছে প্রায় ৩৭টি দাম্পত্য সম্পর্ক, অর্থাৎ তালাকের ঘটনা ঘটছে ৪০ মিনিটে ১টি করে। আর চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রম্নয়ারি মাসে আবেদনের সংখ্যা ২ হাজার ৪৮৮।

২০২০ ও ২০২১ সালেও রাজধানীতে বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদনের সংখ্যা ছিল ১২ হাজারের বেশি। ঢাকার দুই সিটির মেয়রের কার্যালয়ের তথ্য অনুসারে, এই দুই বছরে আবেদন জমা পড়েছে যথাক্রমে ১২ হাজার ৫১৩ এবং ১৪ হাজার ৬৫৯টি। গত চার বছরে তালাক হয়েছে ৫২ হাজার ৯৬৪টি।

বিয়ে বিচ্ছেদ যে কয়েক বছর ধরে বাড়ছে, তা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) তথ্যেও দেখা যায়। বেশি বাড়ছে শিক্ষিত দম্পতিদের মধ্যে। বিবিএসের ২০২১ সালের 'বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস' শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৫ বছর ধরে তালাকের হার ঊর্ধ্বমুখী। সবচেয়ে বেশি রাজশাহী বিভাগে, কম সিলেটে।

বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়লে কর্তৃপক্ষ আবেদনকারী ও বিবাদী দুই পক্ষকেই আপসের নোটিশ পাঠায়। দুই পক্ষে সমঝোতা না হলে কর্তৃপক্ষের আর কোনো দায়িত্ব থাকে না। আবেদনের ৯০ দিনের মধ্যে কোনো পক্ষ আপস না করলে বা আবেদন তুলে না নিলে তালাক কার্যকর হয়ে যায়। সিটি করপোরেশন এলাকায় এ ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ হচ্ছেন আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তারা। তারা আপসের নোটিশ পাঠান। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে গত বছর তালাকের আবেদন জানিয়েছিলেন ৫ হাজার ৫৯০ জন। আপস হয়েছে মাত্র ১২৮টি। আবেদনের তুলনায় আপস ২ শতাংশের মতো।

সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রী সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে তালাকের আবেদন করেন। স্ত্রী বা স্বামী কারও আবেদনের নোটিশে সাধারণত অপর পক্ষ আসে না। দুই পক্ষ কখনো এলেও আপস করার মতো পরিস্থিতি থাকে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ৯০ দিন পর তালাক কার্যকর হয়ে যায়।

ঢাকার বাইরের ছবিও আলাদা কিছু নয়। বরিশাল সিটি করপোরেশন পূর্ণাঙ্গ তথ্য দিতে পারেনি। তাদের দেওয়া আংশিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ ১৯৭টি তালাকের আবেদনে আপসের চেষ্টা করে সফল হয়েছে মাত্র ৪টিতে। এই হারও ২ শতাংশ।

দুই সিটি করপোরেশনের তথ্যে বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন বেশি আসতে দেখা যাচ্ছে স্ত্রীদের পক্ষ থেকে। প্রতি ১০টি আবেদনের প্রায় ৭টি করেছেন স্ত্রী।

২০২২ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মোট তালাক হয়েছে ৭ হাজার ৬৯৮টি। এর মধ্যে স্ত্রীরা আবেদন করেছিলেন ৫ হাজার ৩৮৩টি, যা মোট আবেদনের ৭০ শতাংশ। ঢাকা উত্তরের চিত্রও একই। ২০২২ সালে সেখানে তালাকের আবেদনের ৬৫ শতাংশ নারীর।

দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, আগে বিয়ে বিচ্ছেদ হওয়া নারীদের প্রতি সমাজের আচরণ ছিল অতি বিরূপ। নিজের পরিবারও মেয়েকে আশ্রয় দিতে চাইত না। এখন সচেতনতা বেড়েছে। সংসার জীবনের নির্যাতন থেকে বাঁচাতে মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে পরিবার। আর্থিক স্বাবলম্বিতার সঙ্গে সঙ্গে নারীদের বেড়েছে আত্মমর্যাদা।

ঢাকার বাইরেও চিত্র আলাদা নয়। সেখানেও নারীদের তালাকের আবেদন বেশি। তবে সব রেজিস্ট্রার কার্যালয় ও সিটি করপোরেশনে এ তথ্য আলাদা করে রাখা হয় না। বরিশাল সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত নারীরা তালাক দিয়েছেন ১৩১টি, পুরুষরা ৭৬টি।

তালাক দিতে ইচ্ছুক অনেককে পরামর্শ দিয়ে থাকে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। আসকের পরিচালক নীনা গোস্বামী বলেন, বিবাহিত মেয়েদের সিংহভাগ স্বামীর পরিবারে শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার। লাগাতার নির্যাতনে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তালাকের সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। তাদের মধ্যে যারা শিক্ষিত ও আত্মমর্যাদাবান, তারা তালাকের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন সহজে।

তালাক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাও বলেছেন, তালাক আর পারিবারিক নির্যাতনের একটা যোগ আছে। কয়েক বছর আগে বিবিএসের একটি জরিপে দেখা গেছে, দেশের বিবাহিত নারীদের প্রতি ১০ জনে ৮ জন কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হন। ২০২০ সালের মার্চে করোনার অতিমারির সময়কার সাধারণ ছুটিতে পারিবারিক নির্যাতন বেড়ে গিয়েছিল। বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের ২০২০ সালের মে মাসে প্রকাশিত সমীক্ষায় দেখা গেছে, আগে কখনো নির্যাতনের শিকার হননি, এমন অনেক নারীও সে সময় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

তালাকের আবেদনের ছক আইনজীবীদের কাছে প্রস্তুত অবস্থাতেই থাকে। শুধু বিভিন্ন পক্ষের নাম-পরিচয়-ঠিকানাই পাল্টে যায়। বাকি সব এক। হঠাৎ দুয়েকটি ক্ষেত্রে সামান্য হেরফের হয়। সিটি করপোরেশনের আবেদনগুলোতে তাই বিয়ে বিচ্ছেদের জন্য দেখানো কারণগুলো একেবারেই গৎবাঁধা।

প্রায় সব আবেদনেই বিচ্ছেদের কারণ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে 'বনিবনা না হওয়া'। এর বাইরে আছে পারিবারিক কলহ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক, যৌতুক, মাদক সেবন করে নির্যাতন, প্রবাসী স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা, যৌন অক্ষমতা, সন্দেহ, উদাসীনতা, ব্যক্তিত্বের সংঘাতসহ আরও কিছু অভিযোগ।

গত বছর বিয়ে বিচ্ছেদ হওয়া রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার এক নারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'আমাদের বিয়ে হয়েছিল পারিবারিক আয়োজনে। ভিন্ন ভিন্ন মনমানসিকতা সত্ত্বেও সংসার চলে যাচ্ছিল। কিন্তু বছর কয়েক পর স্বামী অন্য মেয়ের প্রতি দুর্বল হয়ে তালাক দিলেন।' তাদের তিন বছরের একটি কন্যা রয়েছে। এখন পারিবারিক আদালতে মামলা চলছে ভরণপোষণ নিয়ে।

সর্বশেষ পাঁচ বছরে প্রতি বছরই তালাকের ঘটনা বেড়েছে চট্টগ্রামে। সবচেয়ে বেশি বিচ্ছেদ হয়েছে ২০২২ সালে, ৫ হাজার ৯৭৬টি।

রংপুর সিটি কর্পোরেশনসহ পুরো জেলায় ২০১৯ সালে বিয়ে বিচ্ছেদ হয়েছিল ৬ হাজার ৯৬৭টি। ২০২২ সালে এসে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ২১৫তে।

রংপুরের জেলা রেজিস্ট্রার আবদুস সালাম প্রামাণিক বলেছেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য, লাঞ্ছনাসহ বেশ কিছু কারণে তালাক বেড়েছে। বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কও একটি কারণ। সেখানেও আবেদনের পর সমঝোতা খুব বেশি হয় না। হলেও সংসার পরে টেকে না।

ময়মনসিংহ জেলায় তিন বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে তালাকের ঘটনা বৃদ্ধির তথ্য পাওয়া গেছে। জেলার রেজিস্ট্রার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পুরো জেলায় ২০২২ সালে তালাক হয়েছে ৬ হাজার ৩৯০টি। দিনে তালাকের ঘটনা গড়ে ১৮টি। ২০২০ ও ২০২১ সালে ময়মনসিংহে বিয়ে বিচ্ছেদ হয়েছিল যথাক্রমে ৫ হাজার ৫৩২ এবং ৫ হাজার ৯১১টি।

গত পাঁচ বছরে খুলনা নগরে বিয়ে বিচ্ছেদ হয়েছে ৯ হাজার ৫২টি। এর মধ্যে গত দুই বছরের সংখ্যাই প্রায় ৪ হাজার। এ বছরের প্রথম তিন মাসে সেখানে ৫০০টি বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে।

বিয়ে বিচ্ছেদ বেড়ে যাওয়ার এ প্রবণতা সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ফাতেমা রেজিনা পারভীন বলেন, সমাজে সহিষ্ণুতা কমছে। নগর জীবনের চাপ, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, সঙ্গীর পছন্দ-অপছন্দ, জৈবিক চাহিদা পূরণ না হওয়া ইত্যাদি বিষয় দাম্পত্য সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলছে।

নারীরা সংসারে নিজের মর্যাদা না পেয়ে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। স্বামী-স্ত্রীর সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যও বড় হয়ে উঠছে। তিনি বলেন, প্রেম করে বা পরিবারের সিদ্ধান্তে যেভাবেই বিয়ে হোক, সতর্কভাবে সঙ্গী নির্বাচন করা দরকার। সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির মিলও বেশ জরুরি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে