শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মেয়েদের স্বপ্ন দেখতে বাধা দেবেন না

মেয়েদের এমনভাবে বড় করতে হবে, যাতে তারা আত্মবিশ্বাসী, শক্তিশালী, উচ্চাকাঙ্ক্ষী, সাহসী, স্বাধীনচেতা ও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। ছেলেদের অবশ্যই মেয়ে ও নারীদের সম্মান করার শিক্ষা দিতে হবে। লেখক, শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা বাস্তবধর্মী এবং অনুপ্রেরণামূলক গল্প ও নারী চরিত্র সৃষ্টি করতে পারেন।
লায়লা খন্দকার
  ০৩ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০

কথা হচ্ছিল ঠাকুরগাঁও ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ তাজুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি প্রায় ১০ বছর আগে রাণীশংকৈল উপজেলায় রাঙ্গাটুঙ্গী প্রমীলা ফুটবল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। আনন্দের সঙ্গে তিনি বলেন, 'এই একাডেমির পাঁচজন খেলোয়াড় জাতীয় দলের বিভিন্ন বয়সি গ্রম্নপে প্রতিনিধিত্ব করছে। কয়েকজন শুধু খেলোয়াড় হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সুযোগ পেয়েছে। ফলে এলাকার মেয়েদের মধ্যে ফুটবলে আগ্রহ বেড়েছে। কিছু ক্রীড়ামোদী মানুষের প্রচেষ্টায় একাডেমিটি ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে।'

এলাকার বেশির ভাগ মানুষের বাস দারিদ্র্যসীমার নিচে। নানান প্রতিকূলতা পেরিয়েই ১০-২০ বছর বয়সি প্রায় ৫০ জন মেয়ে এই একাডেমির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এর ফলে চাপ বেড়েছে সংগঠকদের ওপর। প্রশিক্ষণ উপকরণ, কোচ, খেলারসামগ্রী, মাঠপ্রস্তুতি, চিকিৎসা ও যাতায়াতসংক্রান্ত খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। একটি ব্যায়ামাগারেরও প্রয়োজন। বিচ্ছিন্ন কিছু সহযোগিতা পাওয়া গেলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা যথেষ্ট নয়। প্রান্তিক পরিবার থেকে আসায় মেয়েদের পুষ্টির অবস্থাও ভালো নয়। প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হলে এলাকার মেয়েরা ক্রীড়াঙ্গনে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে বলেই সংগঠকরা মনে করেন।

বাংলাদেশের মেয়েদের খেলার খবরে আশান্বিত হই। কিন্তু মন ভারাক্রান্ত হয় বাল্যবিবাহের ঘটনায়। পপুলেশন কাউন্সিলের এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনাকালে দীর্ঘদিন বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় এবং পরিবারের আয় কমে যাওয়ায় বাল্যবিয়ের হার বেড়ে গেছে। গবেষণায় শেরপুর, কুষ্টিয়া ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে পরিচালিত জরিপের উত্তরদাতাদের (১২-১৯ বছর বয়সি মেয়ে) ১০০ ভাগ নিজের এলাকায় বাল্যবিয়ে ঘটতে দেখেছে; শতকরা ২৩ ভাগ মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। মহামারির সময় মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে কম ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছে এবং ঘরের কাজে বেশি সময় দিয়েছে- যা তাদের পড়াশোনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

বাল্যবিবাহ ছাড়াও যেসব কারণে মেয়েদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটছে, তা মনে পড়ল ঢাকার একটি ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ের বিজ্ঞাপন দেখে। দুজন কিশোর রোবোটিকস এবং গণিত শিখছে আর একটা মেয়ে ভায়োলিন বাজাচ্ছে। ছবিগুলো দেখে অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা কী ধারণা পাবে? গণিত, রোবোটিকস, সঙ্গীত ছাত্রছাত্রী উভয়ের শেখা প্রয়োজন। এ ধরনের প্রচার এক ধরনের ভুল বার্তা দেয়। এ রকম আরও উদাহরণ আছে, যেখানে নারী ও পুরুষদের জন্য আলাদা কাজ নির্দিষ্ট বলে শিশুদের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে।

এক গবেষণায় দেখা যায়, ১৬ বছর বয়সি মেয়েদের বিজ্ঞানীর ছবি আঁকতে বলা হলে মাত্র ২৫ শতাংশ মেয়ে কোনো নারী বিজ্ঞানীর ছবি আঁকে। গবেষণায় আরও জানা যায়, ১৫ বছর বয়সের মধ্যেই মেয়েরা সায়েন্স, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যাথমেটিকসসংক্রান্ত (স্টেম) বিষয়ে পড়াশোনা করার আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে- যা ছেলেদের ক্ষেত্রে হয় না। শিশুদের নারী ও পুরুষের কাছে সমাজের প্রত্যাশিত আচরণের সংকীর্ণ গতিতে (জেন্ডার স্টেরিওটাইপ) আটকে রাখার কারণেই মানুষ হিসেবে তাদের সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে।

সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে কিশোরীদের জীবনটা সংকুচিত হয়ে যায়; অনেক ক্ষেত্রেই মা-বাবা তাদের ঘরের বাইরে যেতে দিতে ভয় পান। সমাজটাকে মেয়েদের জন্য নিরাপদ করার দায়িত্ব আমাদের।

মেয়েদের এমনভাবে বড় করতে হবে, যাতে তারা আত্মবিশ্বাসী, শক্তিশালী, উচ্চাকাঙ্ক্ষী, সাহসী, স্বাধীনচেতা ও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। ছেলেদের অবশ্যই মেয়ে ও নারীদের সম্মান করার শিক্ষা দিতে হবে। লেখক, শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা বাস্তবধর্মী এবং অনুপ্রেরণামূলক গল্প ও নারী চরিত্র সৃষ্টি করতে পারেন। মা-বাবাকে খুব সতর্কতার সঙ্গে শিশুদের জন্য বই, কার্টুন, চলচ্চিত্র, খেলনা ইত্যাদি বাছাই করতে হবে; মেয়ে ও ছেলেশিশুকে সমানভাবে বড় করাটা গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারে নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক সম্পর্ক থাকা জরুরি, কারণ শিশুরা তা দেখেই শেখে। গণমাধ্যমকে অবশ্যই এমন নারীদের তুলে ধরতে হবে, যারা ইতিবাচক রোল মডেল।

সম্প্রতি ঢাকার এক বিদ্যালয়ের কয়েকজন কিশোরীর সঙ্গে কথা বলছিলাম। আমাদের জীবনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব শুরু করে পরিবেশ রক্ষায় কী করণীয় সব বিষয়ে তাদের নিজস্ব বিশ্লেষণ ও চিন্তাভাবনা আছে। তাদের কেউ অনলাইনে উপন্যাস লিখছে, কয়েকজন বিদেশি ভাষা শিখছে, কারও আগ্রহ কারাতে শেখায় আর কেউ গ্রাফিক ডিজাইনে পারদর্শী। সমাজের নানা দিক নিয়ে, মানুষের অধিকার নিয়ে তাদের মতামত জেনে আমি আশাবাদী হলাম।

সুইডিশ লেখক এস্ট্রিড লিন্ডগ্রেন সৃষ্টি করেছেন পিপ্পি লংস্টকিং নামে একটি চরিত্র, যে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী মেয়ে। পিপ্পি তার ঘোড়া এবং একটি বানর (মি. নিলসন) নিয়ে থাকে এবং যে কোনো কাজ করার সাহস রাখে। সম্পূর্ণ নিজের মতো করে চলা, কাউকে ভয় না পাওয়া এবং অন্যদের প্রতি সহানুভূতিশীল এই অসাধারণ মেয়েটির গল্প চিরকালীন সাহিত্যের অংশ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের মেয়েরা পিপ্পির চেয়েও সাহসী ও স্বাপ্নিক। লালমনিরহাটের চর থেকে সুনামগঞ্জের হাওর পর্যন্ত তেমন মেয়েদের দেখা আমি পেয়েছি।

মেয়েদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুরক্ষা এবং খেলাধুলায় বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ। করোনা মহামারিতে মেয়েদের শিক্ষায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নিতে উদ্যোগ নিতে হবে। যাদের বিয়ে হয়ে গেছে, তাদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনা জরুরি।

বাংলাদেশের মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে। তারা আকাশ ছুঁতে চায়। আমরা যদি মেয়েদের স্বপ্ন দেখতে উৎসাহিত করি, তাহলে তারা বিজ্ঞানী থেকে খেলোয়াড় পর্যন্ত সব ধরনের পেশায় সাফল্য লাভ করে সমাজে অর্থপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। আমরা কি আমাদের দায়িত্ব পালনে তৈরি এবং আগ্রহী?

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে