সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

উচ্চশিক্ষা অর্জনে নারীর সমস্যাবলি

নারী উন্নয়ন সংক্রান্ত নীতিগত নির্দেশিকা প্রণয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী সৃষ্টি, জীবনমুখী প্রশিক্ষণ প্রদান, ক্ষুদ্রঋণ প্রাপ্তির সুযোগ ও নারীবান্ধব ব্যাংকিং ব্যবস্থা, নারী উদ্যোক্তাদের জামানতবিহীন ঋণ সুবিধা, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প সৃষ্টির মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তা, বিশেষভাবে সব উন্নয়নের মূল নারী শিক্ষার কথা। নারী শিশুদের শিক্ষামুখী করতে সরকার নারীদের জন্য ব্যবস্থা করে উপবৃত্তির বা মাসিক টাকা প্রদানের। প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত প্রদান করা হয় উপবৃত্তি। এছাড়া, সরকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে বিতরণ করছে বই। দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিশুদের দেওয়া হচ্ছে দুপুরের খাবার। এতে গ্রামের দরিদ্র শিশুরা বিশেষ করে নারী শিশুরা অধিকহারে বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করে।
সামিয়া মোস্তফা
  ১৪ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০

নারী অধিকার রক্ষা, নারী উন্নয়ন, মেধা বিকাশ, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ ও নারীদের কর্মক্ষেত্র তৈরি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে দেশ-বিদেশের সুধীমহলে চলছে ব্যাপক আলোচনা। নারী উন্নয়নে কাজ করার জন্য ১৯৭৬ সালে গঠিত হয় টহরঃবফ ঘধঃরড়হং উবাবষড়ঢ়সবহঃ ঋঁহফ ঋড়ৎ ডড়সবহ আর

\হনারীর অধিকার রক্ষায় ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘে গৃহীত হয় ঈঊউঅড সনদ। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারও গ্রহণ করে বিভিন্ন পদক্ষেপ। নারী উন্নয়ন সংক্রান্ত নীতিগত নির্দেশিকা প্রণয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী সৃষ্টি, জীবনমুখী প্রশিক্ষণ প্রদান, ক্ষুদ্রঋণ প্রাপ্তির সুযোগ ও নারীবান্ধব ব্যাংকিং ব্যবস্থা, নারী উদ্যোক্তাদের জামানতবিহীন ঋণ সুবিধা, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প সৃষ্টির মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তা, বিশেষভাবে সব উন্নয়নের মূল নারী শিক্ষার কথা। নারী শিশুদের শিক্ষামুখী করতে সরকার নারীদের জন্য ব্যবস্থা করে উপবৃত্তির বা মাসিক টাকা প্রদানের। প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত প্রদান করা হয় উপবৃত্তি। এছাড়া, সরকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে বিতরণ করছে বই। দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিশুদের দেওয়া হচ্ছে দুপুরের খাবার। এতে গ্রামের দরিদ্র শিশুরা বিশেষ করে নারী শিশুরা অধিকহারে বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করে। ফলে আমাদের দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে নারী-শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ গ্রাম-শহর সর্বস্তরে চোখে পড়ার মতো।

এক সময় কলকাতার সঙ্গে দূরত্ব, শিক্ষার অভাব এবং রক্ষণশীলতার বাধা পেরিয়ে মুসলমান পরিবারের মেয়েরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে যাবে এমন ভাবনা ভাবত না অধিকাংশ পরিবার। পশ্চাৎপদ সামাজিক অবস্থা থেকে উত্তরণের স্বপ্ন তৈরি করে সে সুযোগ তৈরি করেছিল ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ১৯২১ সালে মাত্র একজন নারী শিক্ষার্থী (লীলা নাগ) ভর্তি হয়েছিল যে বিদ্যাপীঠে, ১৯২৭ সালে সেখানে ছাত্রী ছিলেন নয়জন। ছাত্রী সংখ্যা বাড়তে থাকে ধীরে ধীরে। ১৯৩৪-৩৫ সালে ছাত্রী ছিলেন ৩৯ জন। ষাটের দশকের প্রায় শেষদিকে, অর্থাৎ ১৯৬৭-৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীর সংখ্যা হয় ১,৩৩৬ জন। আর ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ সমাবর্তনের সময় প্রকাশিত তথ্যে মতে বর্তমান ছাত্রীর সংখ্যা ১৩ হাজার ১৯৫ জন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সানজিদা আখতারের মতে এ অঞ্চলে নারীর উচ্চশিক্ষা গ্রহণে প্রতিষ্ঠান হিসেবে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কেননা, উচ্চশিক্ষা লাভ করে প্রায় প্রতিটি ছাত্রী; বিশেষ করে শুরুর দিককার ছাত্রীরা সমাজে একেকজন নারীশিক্ষার রোল-মডেল হিসেবে কাজ করেছেন। তবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেলেও, বৃদ্ধি হচ্ছে না নারীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হয়েও বিশ্ববিদ্যালয়টি জরাজীর্ণ হয়ে আছে বিভিন্ন সংকটে।

আমরা যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের আবাসন ব্যবস্থার দিকে তাকাই, তাহলে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে এক করুণ চিত্র। নারীদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে উপস্থিতি বৃদ্ধি পেলেও, সেই হারে বাড়েনি হলে সিটের ব্যবস্থা। লিগ্যাল রুমগুলোতে দেখা যাচ্ছে একটা আসনের বিপরীতে বরাদ্দ থাকে একাধিক শিক্ষার্থীর নাম। প্রায় সময় একটা ৬ জনের লিগ্যাল রুমে থাকতে হচ্ছে অনেককে। আবার অনেক শিক্ষার্থীকে ২/৩ মাস এক রুমে থাকার পর খুঁজতে হচ্ছে নতুন কক্ষ। আবার অনেক সময় আসন পাওয়ার জন্য কোনো কোনো শিক্ষার্থীকে অপেক্ষা করতে হয় অনার্স ফাইনাল ইয়ার পর্যন্ত। এক্ষেত্রে আন্দোলন, আশ্বাসের গল্প কিছু শোনা গেলেও তা দেখেনি আলোর মুখ। এটাতো হচ্ছে লিগ্যাল রুমের কথা। এবার যদি গণরুমের দিকে তাকাই, তাহলে বলতে হয় এটা যেন কোনো একটা শরণার্থী শিবিরের চিত্র। ৫ জনের রুমে কখনো কখনো থাকতে হয় ২০-২৫ জনেরও বেশি। এই হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের আবাসন অবস্থা। এবার তাদের খাবারের প্রসঙ্গে আসি। শিক্ষার্থীদের জন্য নেই পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা। বারবার ক্যান্টিনের খাবারের মান নিয়ে কথা হলেও নেই তেমন কার্যকর পদক্ষেপ। অন্যদিকে, মেয়ে শিক্ষার্থীরা রান্না করে খেতে চাইলেও শামসুন নাহার, মৈত্রী ও রোকেয়া হলে রান্নাঘরের সুবিধাও তেমন নেই। শুক্রবার, শনিবার দিনগুলোতে ওয়াসরুমগুলোর সামনে পড়ে লম্বা সিরিয়াল। হলগুলোতে আত্মহত্যা বেড়ে যাওয়ার অজুহাতে দেওয়া হয় না সিলিং ফ্যান।

এবার আসি যাতায়াত ব্যবস্থায়। অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্যও নেই পর্যাপ্ত বাসের ব্যবস্থা। প্রতিদিন ক্লাস শেষে গাদাগাদি করে ফিরতে হয় বাড়ি। অন্যদিকে, মেয়েদের দূরবর্তী হলগুলোর চক্রাকার বাসের ব্যবস্থাও শোচনীয়। বাসের অভাবে বাস আসার নির্দিষ্ট সময় হওয়ার ১৫/২০ মিনিট আগে থেকে অপেক্ষা করতে হয় বাসের সিট ধরার জন্য। এরপর বাস এলে গাদাগাদি করে আবার কখনো ঝুলে ঝুলে আসতে হয় ক্লাসে। আবার ট্রিপের সংখ্যা পর্যাপ্ত না। অনেক সময় দেখা যায়, ট্রিপের স্বল্পতার কারণে ২টার ক্লাস করার জন্য ১টার মধ্যে প্রস্তুত হতে হচ্ছে।

আবার ক্যাম্পাসে থাকাকালীন সময়েও কিছু সমস্যার মোকাবিলা হতে হয়। কলাভবনসহ বিভিন্ন বিভাগে ক্লাসরুম স্বল্পতা, শিক্ষক স্বল্পতা, অপরিকল্পিত ক্লাস শিডিউলের কারণে ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে হয় সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত। এ সময় ছাত্রীদের অবস্থানের জন্যও নেই পর্যাপ্ত কমনরুমের সুবিধা। কমনরুমগুলোতে অতিরিক্ত ছাত্রী অবস্থানের কারণে ভ্যাপসা গরমে গন্ধময় অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে, কলাভবনের কমনরুমে অপর্যাপ্ত পত্রিকা, খাবারের ব্যবস্থা, স্যানিটারি ন্যাপকিন, ইন্টারনেট ব্যবস্থা, টয়লেট, অযুর ব্যবস্থা কিছুটা থাকলেও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে এসবেরও সুযোগ নেই। মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্যও নেই নামাজ আদায়ের স্থান। ফলে অনেক মুসলিম শিক্ষার্থীকে নামাজ আদায় করতে হয় কমনরুমে। আবার কখনো কখনো নারী শিক্ষার্থীদের তাদের পোশাক, বিশেষ করে তাদের হিজাব ও নিকাবের জন্য হতে হয় নির্যাতনের শিকার। ক্যাম্পাসে নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাহীনতায়ও ভুগতে হয়। অনেক সময় হতে হয় রিকশাওয়ালা, পাগল, নেশাখোর, ছিনতাইকারীদের ইভটিজিংয়ের শিকার। কিন্তু এসবেও প্রশাসনকে দেখা যায় নীরব ভূমিকায়। ফলে নিরাপত্তা ইসু্যতে সন্ধ্যার পরে হওয়া বিভিন্ন অনুষ্ঠান, কর্মশালায় কমছে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ। এছাড়া আরও এমন অসংখ্য সমস্যায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে নারীদের শিক্ষা গ্রহণ।

তাই নারীদের সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে যথেষ্ট সচেতন হতে হবে। এরজন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করা। তাদের জন্য নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ে তোলা। তাদের দাবি ও কথাগুলো শোনার চেষ্টা করা। তাহলে নারী শিক্ষা, নারী অধিকার ও নারী উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। অন্যথায় ধীরে ধীরে নারীরা উচ্চশিক্ষা বিমুখ হয়ে পড়বে এবং সমাজে পিছিয়ে পড়বে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে