বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১

নারীদের নিরাপত্তা কি কখনোই নিশ্চিত হবে না?

নারী নির্যাতনের ঘটনার বিচারে দীর্ঘসূত্রতা অনেকাংশে নারী নির্যাতনের জন্য দায়ী। সঠিক সময়ে অপরাধের সঠিক বিচার হলে এই অপরাধ বাড়তো না। সগিরা মোর্শেদ নামে এক নারীকে হত্যা করা হয় ১৯৮৯ সালে। তাকে হত্যার ৩০ বছর পর বিচারকার্য শুরু হয়। এরকম হাজারো উদাহরণ রয়েছে। একে তো বিচার হয় না অধিকাংশ ঘটনার বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে ধর্ষণ বেড়েই চলেছে।
সুকান্ত দাস
  ২৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
নারীদের নিরাপত্তা কি কখনোই নিশ্চিত হবে না?

মেয়েটা শুধু ভুল করে অন্য ট্রেনে উঠেছিল, আর এতে তার জীবনের ট্রেনই অন্য পথে চলে গেল। হঁ্যা, বলছিলাম গত মঙ্গলবার রাতে ঢাকা থেকে লালমনিরহাটগামী 'লালমনি এক্সপ্রেস' ট্রেনে ভুলবশত উঠে ধর্ষণের শিকার হওয়া আমাদের দুর্ভাগা বোনটির কথা। সরকার বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছে, বেসরকারি সংস্থাগুলো চেষ্টা করছে, সর্বোচ্চ শাস্তি মৃতু্যদন্ড করা হয়েছে তবুও থামছে না ধর্ষণ। তবুও নিরাপদ না আমাদের মেয়েরা, আমাদের বোনেরা।

আর আমাদের সমাজব্যবস্থায় অপরাধীর তুলনায় ভুক্তভোগীকে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বিশেষ করে এ ধরনের নির্যাতনের ক্ষেত্রে। ওই মেয়েটির বাবা বলেছে, তাকে নিয়ে আর গ্রামে ফিরবে না। কারণ এলাকার মানুষের বাক্যবাণে তার মেয়ে সারাটা জীবন জর্জরিত হবে। হয়তো শহরে থাকবে যেখানে তাদের কেউ চিনবে না।

দৈনিক পত্রিকায় একটা প্রতিবেদন দেখে চোখ আটকে গেল। ২০২২ সালের ২ আগস্ট কুষ্টিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জগামী ঈগল পরিবহণের চলন্ত বাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগী ওই নারীর গ্রামের লোকজন তাদের সঙ্গে ঝগড়া হলেই সেই কথা তুলে গালমন্দ করে। যেখানে তার কোনো দোষ নেই সেখানে তাকেই প্রতিনিয়ত কথা শুনতে হচ্ছে।

কয়েক বছর আগে একটি গ্রম্নপের এমডি ও এক তরুণীর সম্পর্কের কথা এবং মেয়েটির মৃতু্য নিয়ে মিডিয়াপাড়া ও ফেসবুকে তোলপাড় হয়ে যায়। মেয়েটির মৃতু্য রহস্য বের করার দায়িত্ব পুলিশের এবং বিচারের দায়িত্ব আদালতের। কিন্তু সবচেয়ে অবাক করা বিষয় ছিল সেই ঘটনায় সবাই মেয়েটির চরিত্রের কাটাছেঁড়া করতে থাকে। একটা মেয়ে মারা গিয়েছে কোথায় সবার চাওয়া থাকবে যেন সঠিক তদন্ত হয়, মৃতু্যর বিচার হয়। কিন্তু কিসের কি, সবাই মেয়েটির আগে কতগুলো সম্পর্ক ছিল তা বের করতে ব্যস্ত।

নজরুলের ভাষায় 'পৃথিবীতে যা কিছু মহান চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর'। অর্থাৎ সব কল্যাণকর ব্যাপারে যতটুকু পুরুষের অবদান ঠিক ততটুকুই নারীর অবদান। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি অবদান নারীর। কিন্তু তারপরও সমাজে নারীকে পুরুষের সমান মর্যাদা দেওয়া হয় না। নারী পুরুষ সম অধিকার এই বিষয়টা এখনো অনেকাংশে কাগজে কলমে থেকে গেছে। সংবিধানে বলা হয়েছে সব নাগরিক নারী-পুরুষ সবার সমান অধিকার থাকবে। কিন্তু এই নিয়মগুলো যখন কাজে করা হয় বা বাস্তবে ঘটতে দেখি তখনই ঝামেলা শুরু হয়ে যায়।

আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে নারীদের যোগ্য সম্মান না দেওয়াটা বেশি দেখা যায়। কুসংস্কার এবং সুবিধাভোগী মনোভাব এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে বেশি।

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। সবদিক থেকে এগিয়ে চলছে কিন্তু নারীর প্রতি সহিংসতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আন্দোলনের মুখে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃতু্যদন্ডের বিধান রেখে আইন পাস করেছে সরকার। ধারণা করা হয়েছিল ধর্ষণের সংখ্যা আস্তে আস্তে কমে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। নির্যাতনের হার দিন দিন বেড়েই চলেছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ১৯ হাজার ৫৬টি, ২০২১ সালে ২২ হাজার ১২৪টি, ২০২০ সালে ২২ হাজার ৫০১টি, ২০১৯ সালে ২৭ হাজার ৭৫২টি, ২০১৮ সালে ১৬ হাজার ২৩৪টি মামলা হয়েছে। গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে ১৮ হাজার ৫৩টি মামলা হয়েছে। ২০২৩ ও ২০২২ সালে মামলার ৫২ শতাংশ ছিল ধর্ষণের, আগের চার বছরে এ হার ৪৮ শতাংশের নিচে ছিল।

নারী নির্যাতনের ঘটনার বিচারে দীর্ঘসূত্রতা অনেকাংশে নারী নির্যাতনের জন্য দায়ী। সঠিক সময়ে অপরাধের সঠিক বিচার হলে এই অপরাধ বাড়তো না। সগিরা মোর্শেদ নামে এক নারীকে হত্যা করা হয় ১৯৮৯ সালে। তাকে হত্যার ৩০ বছর পর বিচারকার্য শুরু হয়। এরকম হাজারো উদাহরণ রয়েছে। একে তো বিচার হয় না অধিকাংশ ঘটনার বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে ধর্ষণ বেড়েই চলেছে।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে নারীরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, রাজপথে আন্দোলন করেছেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীরা অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং সম্মুখ যুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি যুদ্ধ করেছেন। স্বাধীনতার জন্য তিন লাখ মা-বোন তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছেন। এসব তো অনেক আগের ঘটনা। তখন খুব কমসংখ্যক মানুষ শিক্ষিত ছিল। আর এখন শিক্ষার আলো সমাজের কোণে কোণে আলোকিত করেছে। মানুষের চিন্তাধারার উন্নতি হয়েছে কিন্তু যখনই নারীর অধিকারের প্রশ্ন সম্মুখে এসেছে তখনই এই সমাজের মানুষের কথায়, চিন্তাধারা দেখে মনে হয় সমাজের অগ্রযাত্রা হয়তো আরো দুইশ' বছর পেছনে চলে গেছে।

অনেকে নারীর পোশাক নিয়ে কথা বলে। পোশাকের জন্য নাকি ধর্ষণ বেড়ে যাচ্ছে। এটা একেবারেই অবান্তর কথা। কারণ যদি পোশাকের জন্যই ধর্ষণ হয় তাহলে মাদ্রাসার সেই মেয়েটা যে পর্দা করেছিল তার ধর্ষণ কেন হলো? তিন বছরের শিশু কি দোষ করেছিল? সত্তর বছরের সন্ন্যাসিনীর কি দোষ ছিল? পোশাকের দোষ নেই, পুরুষের মানসিকতাই বেশি দায়ী এ ব্যাপারে।

দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা নারী। আর নারীরা যে শুধু বাইরে হেনস্তার শিকার হচ্ছে তা নয়, ঘরেও হচ্ছে। সব খবর হয়তো বাইরে আসে না কিন্তু ঘরে হেনস্তার শিকার নারীর সংখ্যা নেহাতই কম নয়। কোনো দেশের অর্ধেক জনসংখ্যাই যদি প্রতিনিয়ত ঘরে বাইরে হেনস্তার শিকার হতে থাকে তাহলে দেশ ও জাতি কীভাবে এগিয়ে যাবে।

১৯৯১ সাল থেকে গত জাতীয় সংসদের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী দুইজনই নারী এই সংসদের প্রধানমন্ত্রীও নারী, স্পিকার নারী, সংসদ উপনেতা নারী। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব সারাবিশ্বে রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়।

কিন্তু এতকিছুর পরও নারীদের অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে দমিয়ে রেখে কখনোই দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব না। প্রমাণিত হয়েছে ধর্ষণ এবং নির্যাতন শুধু আইন করে বন্ধ করা যাবে না। তাই এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে। তাহলেই নারী নির্যাতন কমে আসবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অবদান রাখতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে