রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন

নারী-পুরুষের বৈষম্যতা দূর করে উভয়ের সম্মিলিত অংশগ্রহণের মাধ্যমেই দেশকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যস্থানে পৌঁছানো সম্ভব। আমাদের দেশে বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নারী-পুরুষের যে বৈষম্যতা লক্ষ্য করা যায় আর তা যদি চলমান থাকে তাহলে কখনো বাংলাদেশকে তার গন্তব্য স্থানে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। তবে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা আসার পর নারী-পুরুষের বৈষম্যতা দূরীকরণে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমাদের দেশে প্রতি বছর ৮ মার্চ সরকারি ও বেসরকারিভাবে অতি জাঁকজমকের সঙ্গে নারী দিবস পালন করা হয়।
ওসমান গণি
  ১২ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

'বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।' দেশ রাষ্ট্র সমাজব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে হলে নারী-পুরুষ উভয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই দেশকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। নারী-পুরুষের বৈষম্যতা দূর করে উভয়ের সম্মিলিত অংশগ্রহণের মাধ্যমেই দেশকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যস্থানে পৌঁছানো সম্ভব। আমাদের দেশে বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নারী-পুরুষের যে বৈষম্যতা লক্ষ্য করা যায় আর তা যদি চলমান থাকে তাহলে কখনো বাংলাদেশকে তার গন্তব্য স্থানে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। তবে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা আসার পর নারী-পুরুষের বৈষম্যতা দূরীকরণে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমাদের দেশে প্রতি বছর ৮ মার্চ সরকারি ও বেসরকারিভাবে অতি জাঁকজমকের সঙ্গে নারী দিবস পালন করা হয়। কিন্তু তারপরও কি আমাদের দেশে নারীদের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বা নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হয়নি, তার কারণ হলো নারীর ক্ষমতায়ন কি? সেটা আগে জানতে হবে। নারীর ক্ষমতায়নে নারীকে প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে বা নারী সমাজ ক্ষমতায়ন প্রাপ্ত হলে আমাদের দেশ বা রাষ্ট্রের কি সুবিধা বা অসুবিধা হবে তা সবার আগে আমাদের বুঝতে হবে- জানতে হবে। নারীদের ক্ষমতায়ন হলো যে, প্রক্রিয়ায় পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যকার অসমতা দূরীভূত করে নারী-পুরুষের সমকক্ষতা প্রতিষ্ঠিত করে সেটাই হলো নারীর ক্ষমতায়ন। ব্যাপক আত্মনির্ভরশীলতার অর্জনের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব। ক্ষমতায়ন হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে ধরে নেওয়া হয় যে নারীর গুরুত্বপূর্ণ বস্তুগত অবস্থাগত সম্পদের নিয়ন্ত্রণ গড়ে তোলার মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের দিকনির্দেশনাকে প্রভাবিত করতে পারবে। তারা নিজেরাই নিজেদের উন্নয়নের চালিকাশক্তি হবে অর্থাৎ ক্ষমতায়ন হলো ক্ষমতা চর্চার ক্ষমতা। জেন্ডার অসমতা, বৈষম্য, ক্ষুধামুক্ত ও আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন একান্ত প্রয়োজন। নারীকে অবদমিত রেখে কোনোভাবেই রাষ্ট্রের টেকসই উন্নয়ন অর্জন সম্ভব নয়। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেও দেখা যায়, নারীদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হলে দেশ বা সমাজের সফলতা সৃষ্টি হয়। আর্থিক কর্মকান্ডে নারী পুরুষের চাইতে অনেক বেশি সৃজনশীল ও দায়িত্ববান। নারী শিক্ষার হার বাড়লে সমাজে সামগ্রিক শিক্ষার হার বৃদ্ধি পায় এবং পরিবারে চিকিৎসা ব্যয় ও অপরাধ প্রবণতা কমে আসে। নারীরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হলে জেন্ডারবান্ধব আইন ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করা সম্ভব হয়।

তাই সারাদেশের নারীদের ক্ষমতায়ন লক্ষ্যে তৃণমূল পর্যায়ের একদল নারীকে সংগঠিত, ক্ষমতায়িত ও তাদের সামর্থ্য বিকাশের লক্ষ্যে নিবিড় ও ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ-কর্মশালার আয়োজন করে আসছে বিভিন্ন বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সত্তাসমূহ। প্রশিক্ষণের প্রথম ধাপ এবং ভিত্তি হলো স্থানীয় পর্যায়ে বাল্যবিয়ে, যৌতুক, পারিবারিক নির্যাতন ও যৌন হয়রানিসহ নারীর প্রতি সব সহিংসতার বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারাভিযান পরিচালনা করা, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা ও নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে কাজ করা। এছাড়াও কন্যাশিশু ও নারীদের অবস্থা ও অবস্থানের ইতিবাচক পরিবর্তনে কাজ করছে। কন্যাশিশু ও নারীদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় গণসচেতনতা সৃষ্টি ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করছে বিভিন্ন বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহ। নারীর ক্ষমতায়ন, চিকিৎসা ক্ষেত্রে উৎকর্ষ অর্জন এবং অবাধ সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড। নারীর ক্ষমতায়ন প্রকাশিত হয় নারীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণ, কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের হার, অবনমিত মাতৃমৃতু্য ও বাল্যবিয়ের হার দ্বারা। ধর্ম-সাম্প্রদায়িকতাহীন রাজনৈতিক পরিবেশে নারীর ক্ষমতায়ন দ্রম্নততর হয়। নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে যুক্ত আছে দেশে প্রবৃদ্ধির হার কী হবে, সর্বজনীন মানবাধিকার কতটা গভীরতা পেল এবং পরিশীলিত মুক্তমনা প্রজন্ম তৈরিতে আমাদের কতটা সফল হচ্ছে।

আর্থসামাজিকভাবে বাংলাদেশ করোনাকালীন অর্থনীতিতে কিছুটা পিছিয়ে পড়লেও বর্তমানে সেই সমস্যা কেটে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন অনেকটা অগ্রসর হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির চলমান ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে আমাদের নারী সমাজ। অর্থনীতি রূপান্তরের সঙ্গে বাংলাদেশে সামাজিক উন্নয়নের ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বাংলাদেশে সামাজিক উন্নয়নের মধ্যে নারীর ক্ষমতায়ন উলেস্নখযোগ্য। বিগত দশকে বাংলাদেশ নারীর জীবনমান উন্নয়নে অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছে। ২০০০ সালের পর থেকে মৃতু্যহার দুই-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। সরকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের পাশাপাশি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনায় জোর দিয়েছে। এই নীতির ফলে গ্রামাঞ্চলে নারীদের বিনামূল্যে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী প্রদান ও পরামর্শ প্রদান করা হয়। এর ফলে নারীর জন্মহার উলেস্নখযোগ্যভাবে কমে স্বাধীনতার সময়ে প্রায় ৭ থেকে ২০১৯-এ তা ২ দশমিক শূন্য ১-এ চলে এসেছে- যা উন্নত দেশের প্রতিস্থাপন হার ২ দশমিক ১-এর চেয়েও কম। পাশাপাশি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার ১৯৭৬ সালের ৮ শতাংশ থেকে ২০১৯-এ তা ৬৩ শতাংশে চলে এসেছে।

পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণের ফলে বাংলাদেশ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমানোর পাশাপাশি অন্যান্য সামাজিক সূচকে অগ্রগতিতে উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষত পরিবারে অর্থনৈতিক কান্ডে নারীর অংশগ্রহণের পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়নে অবদান রেখেছে। তাছাড়া নব্বইয়ের দশকে ব্যাপক হারে ছাত্রীদের উপবৃত্তি প্রদান স্কুলে মেয়েদের ভর্তির হার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অন্যতম নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছে।

বাংলাদেশে বাধ্যতামূলক ও বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচি শিক্ষাক্ষেত্রে এক বৈপস্নবিক পরিবর্তন এনেছে। প্রাথমিকের ক্ষেত্রে ভর্তির হার এখন ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের বেশি। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে যে সামাজিক পুঁজির উদ্ভব ঘটে, তার মূল কারণ সরকারের দূরদর্শী নীতির ফলে দলভিত্তিক ও ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে নারীদের মধ্যে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়।

বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে জেন্ডার সমতা, শিশু ও পাঁচ বছর বয়সের নিচে শিশুদের মৃতু্যহার কমানো, মাতৃমৃতু্যহার কমানো, টিকার পরিধি বাড়ানো এবং সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব কমানোর ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করে। ২০১০ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক এমডিজি-৪ এর অভীষ্ট শিশু মৃতু্যহার কমানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ এমডিজি পুরস্কার লাভ করেন। আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন কর্তৃক ২০১১ সালে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এমডিজি-৪ ও এমডিজি-৫ শিশু মৃতু্যহার ও মাতৃমৃতু্যহার কমানোর জন্য তিনি সাউথ সাউথ গেস্নাবাল হেলথ? অ্যান্ড চিলড্রেন পুরস্কার লাভ করেন।

গ্রামে নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দিতে হবে, যাতে গ্রামীণ নারীরা-পুরুষ অপেক্ষাকৃত ভালো জীবনযাপন করতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। ঊারফবহপব অপঃ ১৮৭২-এর ১৫৫ ধারা- যা ধর্ষিতা নারীর চরিত্র ও জীবনধারা নিয়ে প্রশ্ন করার এখতিয়ার প্রদান করে, সেই বৈষম্যমূলক এবং অপমানজনক ধারাটিকে আমাদের উচিত খুব তাড়াতাড়ি বাতিল করা। নেপোলিয়ন বলেছিলেন, 'আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি শিক্ষিত জাতি দেব।' আরেকটি কথা আছে, একজন পুরুষ মানুষকে শিক্ষা দেওয়া মানে একজন ব্যক্তিকে শিক্ষা দেওয়া। আর একজন নারীকে শিক্ষা দেওয়া মানে একটি গোটা পরিবারকে শিক্ষিত করে তোলা। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল একটি বৈষম্যহীন সমাজ গঠন। প্রচার মাধ্যমগুলোতে নারীর নেতিবাচক উপস্থাপন বন্ধ হতে হবে। নারী কোনো পণ্য নয়। এজন্য আইনের সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। নারী শিক্ষা ও নারীর মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিতে হবে। নারীকে তার কাজের যথাযথ স্বীকৃতি দিতে হবে। নারীর কাজকে ছোট করে দেখা চলবে না। নারীর ক্ষমতায়নে নারীকেই সবার প্রথম এগিয়ে আসতে হবে। নিজেরা সচেতন না হলে, নিজের উন্নয়ন নিজে না ভাবলে ক্ষমতায়ন অসম্ভব। তাই নারীদের যাবতীয় অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হতে হবে। পরিশেষে আমাদের উচিত কাজী নজরুল ইসলামের অমর বাণী কাজে লাগিয়ে হাতে হাতে কাজ করা।

সরকার প্রতি বছর বাজেট ঘোষণার সময় জাতীয় সংসদে জেন্ডার বাজেট উপস্থাপন করে। সেখানে নারী উন্নয়নে কোনো ধরনের নীতি, কৌশল ও কর্মসূচি প্রণয়ন করা হবে এবং তার জন্য মন্ত্রণালয়/বিভাগভিত্তিক কর্মকান্ড বাস্তবায়ন করবে, তার বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া থাকে। তাছাড়া নারীর কল্যাণে কর্ম সম্পাদন সূচক ও নারীর অধিকার সুরক্ষায় গৃহীত পদক্ষেপ বাজেট বরাদ্দে উলেস্নখ থাকে। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নারীরা অগ্রসর হলেও নারীর সার্বিক অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে আমাদের আরো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। বিশেষ করে বাল্যবিয়ে (৫৪ শতাংশ) রোধসহ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় নারীদের অধিকতর অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ এবং সর্বক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নারীর ক্ষমতায়ন একটা অপরিহার্য অংশ। ধর্ম-সাম্প্রদায়িকতাহীন, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদমুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ নারীর ক্ষমতায়নের জন্য অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণেই স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর শাসনকালসহ সব আওয়ামী লীগ শাসনকাল এ দেশের নারীর ক্ষমতায়নে উলেস্নখযোগ্য অবদান রেখেছে। আওয়ামী লীগ শাসনকালে মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। মৌলবাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আওয়ামী লীগের শক্তিশালী বিকল্প এখনো গড়ে ওঠেনি, এও শঙ্কার কারণ বটে। নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী পঙক্তি 'বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর' অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠুক সমাজ রূপান্তরের প্রত্যাশী আমাদের জন্য।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে