বর্তমানে আমাদের দেশে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়েদের দ্রম্নত বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পারিবারিক চাপ মারাত্মক ভূমিকা পালন করছে। এ ক্ষেত্রে মেয়েদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো সুযোগ দেয়া হয় না কিংবা তাদের থেকে জানতে চাওয়া হয় না, মেয়েটি বিয়ে করবে কিনা। সব সিদ্ধান্ত বাবা-মা, বড় ভাই-বোন বা অন্য সদস্যদের ওপর বর্তায়। বিয়ে 'না' করার কথা বলার সুযোগ দেয়া হয় না। সর্বাংশে তাদের মতামতকে অসমর্থন করা হয়, অযৌক্তিক ভাবা হয়। তারা উচ্চশিক্ষার কথা চিন্তা করলেই পারিবারিক আক্রোশ দেখা দেয়। লেখাপড়ার বিষয়ে অসহযোগী মনোভাব পোষণ করা হয়। বিয়েতে না বসলে রীতিমতো নির্যাতনের শিকার হতে হয়। দেশে সংঘটিত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালে বিবাহিত মেয়েদের থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করলে বিষয়টি কতটা সত্য, তা উপলব্ধি করা সম্ভব।
আইরিন অনার্স প্রথমবর্ষে পড়াশোনা করছেন। পড়াশোনা চালাতে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হচ্ছে তাকে। ইচ্ছা অনেক, স্বপ্ন অফুরন্ত। মেধাও রয়েছে। পড়াশোনার পাশাপাশি আয়ও করেন। কিন্তু পরিবার থেকে বিয়ের চাপ যেন তার মানসিকতাকে অবসাদগ্রস্ত করে তুলেছে। তিনি বলেন, 'এ যাবৎ আমাকে বিশের অধিক ছেলের সামনে কনে সেজে দাঁড়াতে হয়েছে। পরিবার জোরপূর্বক বিয়ে দিতে চায়। অনেক অজুহাতে এগুলো ঠেকিয়ে চলেছি। আর পারছি না। আমি চাই উচ্চশিক্ষিত হতে। চাকরি করতে। নারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চাই।' তিনি আরও বলেন, 'আমি মনে করি, আমার এখনই বিয়ে হলে উপযুক্ত পাত্র পাব না। সাংসারিক কাজে মনোযোগ দিতে হবে। এতদিনের লালিত স্বপ্ন বিনষ্ট হবে। এটি নারী স্বাধীনতার পরিপন্থি।'
জানা গেছে, আইরিনের পরিবার সচ্ছল। তাকে পড়ানোর মতো সামর্থ্য পরিবারের রয়েছে। কিন্তু কিছু অপ্রাসঙ্গিক যুক্তি আর কতিপয় দুষ্টুচক্রের আবর্তে পরিবার বারবার মেয়ের বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লাগছে। একজন সম্ভাবনাময় নারীর স্বপ্ন নষ্ট করতে কুপরামর্শই যথেষ্ট। আমাদের সমাজে যখন একটি মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি ক্ষুদ্র আয় (টিউশনি, সেলাই, স্যোসাল বিজনেস ইত্যাদি) শুরু করে, তখন সমাজ থেকে না প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হতে থাকে। রীতিমতো তাদের অপরাধী বানানো হয়। নারীরা কেন সমাজের বাইরে ছুটবে? কেন তারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটবে? এসব বিভ্রান্ত মতবাদের পেছনে কিছু অসাধু ঘটক, অসচেতন পরিবার, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, ধর্মীয় গোঁড়ামি প্রবলভাবে দায়ী। অনার্স পড়ুয়া আইরিন এবং তার মতো সব কলেজগামী মেয়ের ক্ষেত্রে একই অবস্থা বিদ্যমান। এ থেকে আইরিনরা নিশ্চিত মুক্তি চায়।
কথা হয়েছিল কলেজে পড়াকালে বিয়ে হয়ে যাওয়া শিক্ষার্থী জেরিনের সঙ্গে। যখন তার এইচএসসি পরীক্ষা আসন্ন, তখন তার বিয়ে হয়। পরিবারকে মানাতে পারেন না তিনি। তিনি বলেন, 'পরিবারের সিদ্ধান্তেই আমার বিয়ে হয়। আমার কাকুতি-মিনতি কেউ শোনেনি। এখন আমি পড়াশোনা করতে পারছি না। অথচ আমার বান্ধবীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে।' একই ঘটনা বিরাজমানের কারণে আজকাল উচ্চ শ্রেণিগুলোতে ছাত্র ও ছাত্রীর অনুপাতে আকাশ-পাতাল ব্যবধান লক্ষণীয়। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, ৪৫ জন ছাত্রের বিপরীতে মাত্র ৫ জন ছাত্রী টিকে রয়েছে। কিছুসংখ্যক ছাত্রী ছিল, ভর্তি পরবর্তী সময়ে তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এমন ঘটনা সত্যই দুঃখজনক। একজন ছাত্রী ত্যাগ-তিতিক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখল, আর অমনি পরিবার জোরপূর্বক বিয়ে দিয়ে স্বপ্নকে ধ্বংস করল। বিপদগামী পরিবার কি কখনো জাতির এ অপরিমেয় ক্ষতিপূরণ করতে পারবে? আজ যদি মেয়েগুলো উচ্চশিক্ষা অর্জনের সুযোগ পেত, তবে তাদের মধ্যে কেউ কেউ সফল ইঞ্জিনিয়ার, বিসিএস ক্যাডার, সর্বোপরি একজন আদর্শ নাগরিক হতো। রান্না করা, কাপড়-চোপড় ধোঁয়া, ঘর গোছানোর কাজ তো আজকাল পুরুষও করছে, ঘরের কাজে পুরুষ সবসময়ই নারীকে সাহায্যের মানসিকতা রাখে। তাহলে উভয়ই যদি শিক্ষিত সচেতন হন, নারীরাও পুরুষের সঙ্গে কর্মে নামতে পারবে।
আমাদের দেশে নারীদের উচ্চশিক্ষার হার বাড়ছে, তবে এটি আশানুরূপ নয়। উচ্চশিক্ষার পথ থেকে ঝরে পড়ার হার বেশি। পরিবারের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে অনেক মেয়ের উচ্চশিক্ষার পথ রুদ্ধ হয়েছে, হচ্ছে। বেশির ভাগ পরিবার ভাবেন, মেয়েরা দ্রম্নত স্বামীর ঘরে যাক, ঘর-সংসার করুক, বেশি পড়াশোনা করলে পরে বিয়ে দেয়া সম্ভব হবে না। অনেক পরিবারের চিন্তা-চেতনা এমন, সবসময় ভালো ছেলে জোটে না। তাই সুযোগ এলে হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। এই ধরনের নারী শিক্ষা বিদ্বেষী মনোভাব থেকে আজকাল অনেক মেয়েরা উচ্চশিক্ষা অর্জনের পথে বাঁধাগ্রস্ত। পরিবারের বড় মেয়ের যখন এমন পরিণতি হচ্ছে, ছোট মেয়েরও তখন অনীহার সৃষ্টি হচ্ছে। পড়ে কী লাভ, আমার তো বিয়ে হয়ে যাবে। সমাজে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। প্রশ্ন হতে পারে, অনেক নারীই তো উচ্চশিক্ষিত রয়েছে। অবশ্যই, নারীদের উচ্চ শিক্ষিত হওয়ার যে পরিসংখ্যান চোখে পড়ছে, তা হয় মেয়েদের আত্মপ্রচেষ্টা, পারিবারিক বাধা দূরীকরণে সক্ষম কিংবা সচেতন পরিবার হওয়ার কারণে সম্ভব হয়েছে। অঞ্চলভিত্তিক এই হারটা নগণ্য। শহরের তুলনায় গ্রামে এ হার অনেক কম।
'পড়ুয়া মেয়েদের জোরপূর্বক বিয়ে' প্রসঙ্গে 'স্টপ চাইল্ড ম্যারেজ অর্গানাইজেশন'-এর সদস্য জেলি আক্তার বলেন, 'আমাদের আগে উত্তর খুঁজতে হবে, মেয়েদের জোরপূর্বক বিয়ে কেন দেয়া হচ্ছে? অধিকাংশ পরিবার ভাবেন, মেয়েদের উচ্চশিক্ষিত করে লাভ নেই, তারা পরের বাড়িতে থাকবে, বৃদ্ধ বয়সে দেখাশোনা ছেলেরাই করবে। এ ধারণা থেকে তাদের উচ্চশিক্ষার পথ বন্ধ হয়। পরিবার ভাবেন, মেয়েদের অনার্স কিংবা মাস্টার্স পাস করতে যে বয়স হবে তাতে হয়তো বিয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্র পাওয়া যাবে না। একই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাল্যবিয়েও হয়ে থাকে। যত আগে বিয়ে, তত ভালো বর।' তিনি আরও বলেন, 'সামাজিক ভিন্নতা বিবেচনায় কিছু পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। যাদের কারণে আমরা এতদূর আসতে পারছি। সমস্যা হলো, বিয়ের ক্ষেত্রে আজকাল ছেলেদের বয়সের হিসাব করা হয় না, কিন্তু মেয়েদের বয়স ২৩-২৪ বছর পার হলেই কুদৃষ্টিভঙ্গিতে বিবেচনা করা হয়। কেন মেয়েটির বিয়ে হচ্ছে না? কবে বিয়ে? ইত্যাদি নানা বাজে মন্তব্য। পড়ুয়া মেয়েদের জোরপূর্বক বিয়ে ঠেকাতে সমাজের বয়সের দৃষ্টিভঙ্গির আক্রোশ ঠেকাতে হবে, লিঙ্গবৈষম্য হ্রাস করতে হবে। একই উদ্যোগে বাল্যবিয়েও প্রতিরোধ সম্ভব।'
আমরা মনে করি, সমাজ ও দেশকে প্রগতিশীল করতে পুরুষদের উচ্চশিক্ষার যেমন দরকার আছে, তেমনি নারীদেরও। এতে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাজে তাদের সরাসরি অংশগ্রহণ বাড়বে। নারী শিক্ষিতরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলে নারীদের অধিকার আদায় সহজ হবে, নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ হ্রাস পাবে, যৌন নির্যাতন নির্মূল হবে, পুরুষরা বহু বিবাহের সুযোগ পাবে না। নারীরা যদি উচ্চশিক্ষিত হওয়াকে তাদের অধিকার হিসেবে দাঁড় করাতে না পারে, তবে এই পুরুষশাসিত সমাজ তাদের কখনই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেবে না। নারী হবে দাসী অথবা কাজের মানুষ। শিক্ষিত নারীরা যখন, শিক্ষিত পুরুষকে বিয়ে করার সুযোগ পাবে, তখন সংসারজীবনে তারা সুখী হবে। পরবর্তী প্রজন্ম শিক্ষিত সচেতন হবে। পরিবারে নারীরও মতপ্রকাশের জায়গা তৈরি হবে।