শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্মৃতির পাতায় বেকার হোস্টেল

সুমন্ত গুপ্ত
  ২৫ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

'আমি খুব রাগী ও একগুঁয়ে ছিলাম, কিছু বললে কড়া কথা বলে দিতাম। কারও বেশি ধার ধারতাম না। আমাকে যে কাজ দেয়া হতো আমি নিষ্ঠার সঙ্গে সে কাজ করতাম। কোনো দিন ফাঁকি দিতাম না। ভীষণভাবে পরিশ্রম করতে পারতাম। সেজন্য আমি কড়া কথা বললেও কেউ আমাকে কিছুই বলত না। ছাত্রদের আপদে-বিপদে আমি তাদের পাশে দাঁড়াতাম। কোন ছাত্রের কী অসুবিধা হচ্ছে, কোন ছাত্র হোস্টেলে জায়গা পায় না, কার ফ্রি সিট দরকার, আমাকে বললেই প্রিন্সিপাল ড. জুবেরী সাহেবের কাছে হাজির হতাম। আমি অন্যায় আবদার করতাম না। তাই শিক্ষকরা আমার কথা শুনতেন। ছাত্ররাও আমাকে ভালোবাসত।' বন্ধুরা নিশ্চয়ই ভাবছেন এই কথাগুলো কার আর কে সেই ব্যক্তি যাকে সবাই পছন্দ করত। তিনি আর কেউ নন আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টুঙ্গিপাড়ার গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়ায় হাতেখড়ি নেয়ার পর বাবার কর্মস্থল মাদারীপুর ইসলামিয়া হাইস্কুল ও গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে লেখাপড়া করেছেন। পরে তিনি ১৯৪২ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরে কলকাতার ওয়েলেসলি স্কয়ারের ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমান মাওলানা আজাদ কলেজ) মানবিক বিভাগে ভর্তি হন। কলকাতার তালতলার স্মিথ লেনে অবস্থিত সরকারি বেকার হোস্টেলে বঙ্গবন্ধু রুম নং ২৪-এর আবাসিক ছাত্র ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের জাতির পিতা। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৬ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসে অনার্সসহ ব্যাচেলার ডিগ্রি লাভ করেন। আমাদের কলকাতা ভ্রমণের দ্বিতীয় দিন আমাদের গন্তব্য আমাদের জাতির পিতার স্মৃতি ধন্য স্থান সেই বেকার হোস্টেল। সকাল ৭টা আমি আর আমার মা বের হয়ে গেলাম ঢাকা শহরের মতোই সবাই কর্মব্যস্ত এক দ্রম্নতগতি টাইম মেশিনের মাধ্যমে চলছে যে যার মতো চলছে আমরা প্রথমে কলকাতার খবরের কাগজগুলোতে চোখ মেলালাম আনান্দবাজার পত্রিকা, সংবাদ প্রতিদিন, এইসময়, আজকাল প্রভৃতি প্রতিটি খবরের কাগজে বাংলাদেশের চলমান ঘটনাবলি বেশ গুরুত্ব দিয়েই ছাপে দেখলাম তবে আমাদের দেশের মতো এত ভিন্ন আঙ্গিকে তাদের পত্রিকা প্রকাশিত হয় না এদিক থেকে আমরাই সেরা। যাত্রাপথে দেখা মিলল টি স্টলের মা সকালবেলায় চা খেয়ে অভ্যস্,ত্ম আজ সকালে চা খাওয়া হয় নাই তাই চা স্টল দেখেই চা খাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলেন। আমিও না বললাম না, দেখলাম চা স্টলের দোকানি পরম যত্নের সঙ্গে চা বানিয়ে দিলেন তাও আবার মাটির ভাঁড়েতে। যদিও আমি চা খাইনা তার পরেও মাটির ভাঁড়েতে চা দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না মনে পড়ে গেল নচিকেতার সেই বিখ্যাত গান মাটির ভাঁড়েতে চা মজা আলাদাই তাতে ভেজা মাটির গন্ধ পাই ... সেই ভেজা মাটির গন্ধ পেতেই আমি চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। আমাদের দোকানির নাম জানতে চাইলে বললেন হরাধন নাগ তার বাড়ি ফরিদপুরে দেশভাগের সময় সপরিবারে চলে আসেন কলকাতাতে আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি শোনার পর তার চেহারাটাই পরিবর্তন হয়ে গেল। আমাদের কাছ থেকে কোনো টাকাই নিলেন না। কলকাতা নিউ মার্কেট পেরিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি প্রায় দুই কিলোমিটার যাওয়ার পর এসে পৌঁছালাম তালতলাতে, এর কিছুদূর যাওয়ার পরই চোখে পড়ল বেকার হোস্টেলের বিরাট সাইনবোর্ড। সামনে এগোতেই সবুজ রঙের লোহার গেট পার হলেই ভেতরে বেশ পুরনো স্থাপনা। অনেকটা জায়গাজুড়ে ছাত্রাবাস। তিনতলা দালান, লম্বা লম্বা জানালা-দরজা। দূর থেকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছিল। সামনে গিয়ে কাঠের সিঁড়ি দেখতে পেলাম সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই দেখা মিলল বেকার হোস্টেলের কর্মী শেখ গোলাম গোওসের, আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনতেই বেশ আগ্রহসহকারে আমাদের নিয়ে গেলেন আমাদের জাতির পিতার স্মৃতি বিজড়িত ২৩ ও ২৪ নাম্বার রুমে। তিনি বলছিলেন কলকাতা শহরের বেকার হোস্টেলটি পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম ছাত্রদের জন্য একরকম আশীর্বাদ। এখানে খুবই সামান্য টাকায় থেকে-খেয়ে লেখাপড়া শেখার সুযোগ রয়েছে। এক নামে বেকার হোস্টেলকে সবাই চেনে। ভারতবর্ষের রাজনীতির অবিস্মরণীয় সব ইতিহাস বেকার হোস্টেলকে সমৃদ্ধ করেছে। সেই বেকার হোস্টেলকে আরও বেশি স্মরণীয়-বরণীয় করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমরা ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে চলছি সেই ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেয়া সেই কক্ষের দিকে তৃতীয় তলায় ঢুকেই চোখে পড়ল আমাদের পিতার জীবন ও কারাজীবন পাথরে খোদাই করে লিপিবদ্ধ করা। আমরা দাঁড়িয়ে তার জীবন ও কারাজীবন সংক্ষিপ্ত ইতিহাস পড়ে সামনের দিকে এগিয়ে চললাম, সামনে গিয়ে দেখা মিলল চোখে চশমা, মুজিব কোট পরিহিত শ্বেতপাথরে নির্মিত বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ভাস্কর্য। ১৯৯৮ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বেকার হোস্টেলের ২৪ নম্বরের সঙ্গে ২৩ নম্বর কক্ষটিকে যুক্ত করে বঙ্গবন্ধু স্মৃতিকক্ষ গড়ার উদ্যোগ নেন। পরে ওই বছরের ৩১ জুলাই বঙ্গবন্ধু স্মৃতিকক্ষের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন উচ্চশিক্ষামন্ত্রী সত্যসাধন চক্রবর্তী। বঙ্গবন্ধুকে জানার জন্য প্রতিদিনই কেউ না কেউ এখানে আসেন। বাঙালি জাতির জনকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। কলকাতার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোক এসেছে আমাদের পিতার স্মৃতি বিজড়িত রুম দেখতে। ২৪নং কক্ষে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর পড়ার চেয়ার-টেবিল, একটি কাঠের আলমারি ও খাট। আমি জাতির পিতার খাটের সামনে গিয়ে কিছু সময় দাঁড়িয়ে ছিলাম মনে মনে ভাবছিলাম আবার যদি দেখতে পেতাম আমাদের পিতা তার কক্ষে এসে হাঁটাহাঁটি করছেন হঠাৎ মা ধাক্কা দিলেন বললেন চল সামনে এগিয়ে যাই পরে আমরা সাথের কক্ষে গেলাম এই কক্ষে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর একটি আলোকচিত্র আর বেশকিছু বই-পুস্তক। স্মৃতি কক্ষ দেখতে আসা পর্যটক ও বঙ্গবন্ধুর ভক্তদের বেকার হোস্টেলের কর্মী শেখ গোলাম গোওস সহযোগিতা করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর ছাত্রজীবনের গল্প শোনান। তিনি বললেন, 'বঙ্গবন্ধু ২৩নং রুমে লেখাপড়া করেছেন। আর ২৪নং রুমে রাতে ঘুমিয়েছেন।' সরকারি এই বেকার হোস্টেলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শেখ ফরিদ গোলাম বলেন, 'বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকক্ষ দেখার জন্য বাংলাদেশ থেকে অনেকে এখানে আসেন। ভারতের লোকরাও আসেন। তারা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে চান। আমরা তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করি। বেকার হোস্টেলের ফটক, গাছপালা, দরজা-জানালা, কামরার আসবাবপত্র, কাঠের খাড়া সিঁড়ি, এমনকি সাদাকালো ছবিগুলো আমাকে ভীষণভাবে আলোকিত করে তুলছিল। আমি খুঁজতে এসেছি, আমার চেতনার শেকড়। ঘড়ির কাঁটায় সময় এগিয়ে চলছে এদিকে আমাদের বিদায় নেয়ার সময় হয়ে এলো। আমরা পেছনে ফেলে এলাম শতকের ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেয়া বেকার হোস্টেলের প্রাঙ্গণ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে