শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
জেনেসিস-২০২২

জাপানের আদর্শে দেশের কৃষি সম্ভাবনা

জাপানের মতো আমাদেরও কৃষিক্ষেত্রে যান্ত্রিকীকরণ যেমন কম্বাইন হারভেস্টর, রাইস ট্রান্সপস্নান্টার ইত্যাদি যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়াতে হবে। দেশে এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন কিছুটা কঠিন। তবে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ বাস্তবায়িত হলে খুব কম শ্রমেই অধিক ফলন পাওয়া সম্ভব।
তানিউল করিম জীম
  ২৫ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

কৃষি যান্ত্রিকীকরণে বিশ্বের স্বনামধন্য দেশগুলোর মধ্যে জাপান অন্যতম। আজ থেকে ২২ বছর আগেও জাপানের কৃষিকাজে ২০ লাখ ট্রাক্টর এবং ১২ লাখ কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহার হতো। দেশটির কৃষি খাতে বর্তমানে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৬ জনেরই বয়স ৬০ বছরের ওপরে। এই বয়স্ক কৃষদের কায়িক শ্রম কমাতেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় এগিয়ে চলার পথ বেছে নিয়েছে দেশটি। পরে যন্ত্রের ব্যবহার জাপানের কৃষিকে করেছে সমৃদ্ধ। জাপানের মোট জমির কেবল ১৩ শতাংশ চাষযোগ্য। অন্যদিকে বাংলাদেশে যার পরিমাণ ৫৮ শতাংশ। এর পরেও দেশটির হেক্টরপ্রতি চাল উৎপাদন বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি। যন্ত্রের ব্যবহার ও কৃষির টেকসই উন্নয়নে নিজেকে গড়ে তুলছে আধুনিক আদর্শ হিসেবে।

তাদের দায়িত্ববোধটা এতটাই বেশি যে তারা মনে করে আদর্শ ধারণ করাটাই দায়িত্বের শেষ নয়। সেটি বুঝে জাপান সরকার বহু আগেই শুরু করে আদর্শ বিনিময়ের কাজ। তারই অংশ হিসেবে সার্কভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক বন্ধুত্ব এবং সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য জাপান সরকারের সার্বিক তত্ত্বাবধানে প্রতি বছরই জেনেসিস (জাপান-ইস্ট এশিয়া নেটওয়ার্ক অফ এক্সচেঞ্জ ফর স্টুডেন্ট অ্যান্ড ইয়ুথস) নামক বিনিময় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন (জেআইসিই) সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনায় ৭ দিন স্থায়ী হয় এ অনুষ্ঠানের মেয়াদকাল। ছদ্মনামে অনেকেই এই আয়োজনকে 'পিপল টু পিপল এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামথ বলে থাকে। এতে বিভিন্ন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়ে থাকে। মূলত জাপানের অর্থনীতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিক্ষা-ব্যবস্থা, সমাজ-সংস্কৃতি, রাজনৈতিক ব্যবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রদানের জন্যই জাপান সরকার এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে।

করোনার ধাক্কা সামলে এ বছর জেনেসিস-২০২২ সার্ক অনুষ্ঠিত হয়। এবারের জেনেসিসে প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল কৃষি। পহেলা ফেব্রম্নয়ারি থেকে ৭ ফেব্রম্নয়ারি মোট ৭ দিনে অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয়। এই আয়োজনের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে যুক্ত হয়েছিলেন ৯ জন প্রতিযোগী (৫ জন স্নাতক পর্যায়ের এবং ৪ জন কলেজের শিক্ষার্থী) এবং একজন টিম লিডার (শিক্ষক)। শিক্ষার্থীদের মধ্যে দুজন ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শিক্ষার্থী। তারা হলেন- কৃষি অনুষদের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী আল সাউদ সৌহার্দ্য এবং পশুপালন অনুষদের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ওয়াসিফ আহমেদ। জাপানের দেখা আসা কৃষি ব্যবস্থা ও বাংলাদেশে কি সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে তা নিয়ে কথা হয় তাদের সাথে।

জাপানে দেখা কৃষি ব্যবস্থা নিয়ে আল সাউদ সৌহার্দ্য বলেন, এক সপ্তাহের এই বিনিময় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ আমাকে নতুন অনেক অভিজ্ঞতা দিয়েছে। জাপানের দুটি প্রদেশ টোকিও ও টোচিগিতে জেনেসিস অনুষ্ঠিত হয়। জাপান মূলত এসডিজি তথা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রতি খুবই যত্নশীল। এ লক্ষ্যে তারা কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈবসারের ব্যবহার শতভাগ নিশ্চিত করতে চায়। তাদের আবাদযোগ্য কৃষিজমির প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ জমিতে সেটি বাস্তবায়নও করেছে তারা। বিশেষ করে জাপানের প্রায় কৃষিজমিতে গ্রিন হাউসের ব্যবহার আমাকে অবাক করেছে।

তবে জাপানের কৃষি নিয়ে যে কথাটি বলতেই হয় সেটি হলো কৃষি যান্ত্রিকীকরণ এবং প্রিসিশন এগ্রিকালচারে তারা প্রায় সফল। টোকিও ইউনিভার্সিটি অব এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজির শিক্ষার্থীদের সাথে কৃষিভিত্তিক জ্ঞান বিনিময়ে আধুনিক কৃষির একেবারে ভিত্তিগঠন পর্যায়ের জ্ঞানও পেয়েছি। এছাড়া ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক আমাদের শেখালেন কীভাবে একটি বিশেষ স্থানে সবুজ অবকাঠামো গঠন করতে হয়। এ ছাড়া গ্রিন হাউস এবং শেড হাউসে পূর্ণ হর্টিকালচারাল খামার পরিদর্শন, জৈব সার উৎপাদক খামার পরিদর্শন আমাকে দিয়েছে অঢেল অভিজ্ঞতা। তবে কৃষক হোস্ট পরিবারে একদিন যাপন, নাসু স্রাইন (বৌদ্ধ মঠ) পরিদর্শন আমাকে সবচেয়ে বেশি বিমোহিত করেছে। সত্যি বলতে, এটি ছিল একটি অসাধারণ অভিজ্ঞতা।

জাপানের কৃষি ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের সম্ভাবনা নিয়ে ওয়াসিফ আহমেদ বলেন, জাপানের মতো আমাদেরও কৃষিক্ষেত্রে যান্ত্রিকীকরণ যেমন কম্বাইন হারভেস্টর, রাইস ট্রান্সপস্নান্টার ইত্যাদি যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়াতে হবে। দেশে এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন কিছুটা কঠিন। তবে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ বাস্তবায়িত হলে খুব কম শ্রমেই অধিক ফলন পাওয়া সম্ভব। আরেকটি বিষয় হলো রেস্টুরেন্টের বেঁচে যাওয়া ভোজ্যতেল দিয়ে জাপানে ট্র্যাক্টর চালিত হয়। বাংলাদেশেও এটি করা গেলে পরিবেশ সুরক্ষার পাশাপাশি কিছু ব্যয় বাঁচানো যাবে। জাপানিরা জুডো বা উডো নামক পাহাড়ি গাছ থেকে জৈব সার উৎপাদন করে যা গাছকে একই সঙ্গে পটাশিয়াম ও ফসফরাস সরবরাহ করে। বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলেও এই গাছ দেখা যায়। এই ধরনের কিছু গাছ ব্যবহার করে আমরাও জৈব সার উৎপাদন করতে পারি। ফলস্বরূপ রাসায়নিক সারের ব্যবহার হ্রাস পাবে এবং বিদেশ থেকে আমদানি ব্যয়ও কমবে। পরিবেশবান্ধব সবুজ অবকাঠামো তৈরি করে পরিবেশে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ এবং পরিবেশ দূষণ কমানো যাবে। পলিথিন বা পলিথিনজাতীয় পণ্য ৪৫০ বছর পর্যন্ত ভূ-গর্ভস্থ মাটিতে অবস্থান করতে পারে এবং মাটির গুণাগুণ নষ্ট করে। তাই বাজারের ব্যাগ থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে পলিথিন ব্যাগ পরিত্যাগ করে পরিবেশবান্ধব ব্যাগের প্রচলন শুরু করতে হবে। কৃষির বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি আমাদের সম্ভাবনাও রয়েছে প্রচুর। জেনেসিসের মতো আয়োজন সেই সম্ভাবনাগুলো খুঁজতেই সাহায্য করে। সব দেশের কৃষিকে আধুনিক কৃষিতে রূপান্তরের লক্ষ্যেই জেআইসিইর আয়োজনে জেনেসিসের পথচলা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে