সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

পৃথিবীর বাইরে পৃথিবীর খোঁজে

মহাবিশ্বের গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি, ছায়াপথ, ধূমকেতু সবকিছু নিয়েই মানুষ জানতে আগ্রহী। জ্যোতির্বিদরা মনে করছেন যে দৃশ্যমান মহাবিশ্বে প্রায় ১০০ বিলিয়ন গ্যালাক্সি রয়েছে। মানুষ জানতে চায় কীভাবে এই মহাবিশ্বের জন্ম হলো, প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হলো কীভাবে, প্রথম আলোর বিচ্ছুরণ কেমন ছিল এসব মানুষের আগ্রহের বিষয়বস্তু। এই বিশ্ব হলো এই বিশাল মহাবিশ্বের একটু ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। কারণ এই মহাবিশ্ব ঠিক কত বড় তার স্পষ্ট পরিমাপ নেই। কারণ মহাবিশ্ব এখনো প্রসারিত হচ্ছে।
অলোক আচার্য
  ০৮ জুলাই ২০২৩, ০০:০০

আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে ফুল ফুটেছে এই চমকপ্রদ খবরটি মাত্র বিশ্বে আলোড়ন তুলেছে। মূলত মহাকাশ ও মহাবিশ্বের মহারহস্য নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। এই মহাশূন্যের কোথায় কি ঘটছে তা জানতে মানুষ উদ্গ্রীব হয়ে আছে। এখানে মূলত একটি বিষয় স্পষ্ট যে, মানুষ চেষ্টা করছে এই পৃথিবীর বাইরে কোথায় অক্সিজেন পাওয়া যায়। আর অক্সিজেনের উৎস হলো গাছ। যদি পৃথিবীর বাইরে কোথাও গাছ রোপণ করা যায় তাহলে সেখানে অক্সিজেন পাওয়া সম্ভব। আর অক্সিজেন পেলেই সেখানে প্রাণী বিশেষত মানুষের বসতি সম্ভব। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে চাঁদ ও মঙ্গল। ১৯৭০-এর দশক থেকে মহাকাশে উদ্ভিদের চাষাবাদ নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করছেন। মহাকাশে ফুল ফোটানোর গবেষণাটি শুরু হয় ২০১৫ সালে। পৃথিবীর বাইরে বাসযোগ্য একটি গ্রহ বা চাঁদের মতো কাছের কোনো উপগ্রহতে যদি বাসস্থান গড়া যায় তাহলে পৃথিবীর জনসংখ্যা সমস্যাটির একটি স্থায়ী সমাধান সম্ভব হবে। বিজ্ঞানীদের এমনটাই ধারণা। মানুষ ছুটে চলেছে বাসযোগ্য গ্রহের খোঁজে। সে চেষ্টায় যে অসফল সে কথা বলা যায় না, বরং মানুষ বাসযোগ্য গ্রহের সন্ধানে একটু একটু করে সামনে এগোচ্ছে। বিজ্ঞানের কোনো সফলতা তো একদিনে আজকের পর্যায়ে আসেনি। গতবছর বিজ্ঞানীরা ২৩৫টিরও বেশি নতুন গ্রহ আবিষ্কার করেছেন। বিজ্ঞানীদের তথ্যে জানা যায়, আবিষ্কৃত এসব গ্রহের ৪ শতাংশ পাথর বা শিলা দিয়ে গঠিত, আমাদের পৃথিবী এবং প্রতিবেশী মঙ্গলের মতো। চলতি বছরেও সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ২০২২ সালের সর্বশেষ আবিষ্কৃত গ্রহের বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন এইচডি ১০৯৮৩৩ বি। মজার ব্যাপার হলো, আমাদের সৌরজগতের গ্রহ নেপচুনের সমান আকৃতির এই গ্যাসীয় গ্রহটি যে নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরছে তার আকার-আয়তন ও বয়স আমাদের সূর্যের মতোই। আবার বহু আলোকবর্ষ দূরের কোনো গ্রহে যদি সামান্য পরিমাণেও পানির অস্তিত্ব কোনোভাবে প্রমাণ করা যায় তাহলেও প্রাণের খোঁজ পেতে উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে পৃথিবীর মানুষ। আপাতত মহাবিশ্বের কোথাও প্রাণের খোঁজ পাওয়া না গেলেও কোনো দিন যে পাওয়া যাবে না তার নিশ্চয়তা নেই। উল্টো সে সম্ভাবনা ক্রমেই দৃঢ় হচ্ছে। আর এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞানই আমাদের পথ দেখাচ্ছে। এই যেমন সম্প্রতি একটি খবর হলো ২০১৯ সালের ২১ ডিসেম্বর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এক ধরনের অতি শক্তিশালী টেলিস্কোপ ব্যবহার করে এমন কিছু তরঙ্গ শনাক্ত করেন যা তাদের বিস্মিত করে। যেহেতু বিজ্ঞানীরা সবসময় কৌতূহল নিয়ে অন্য কোনো গ্রহে প্রাণ আছে কিনা তার জন্য অপেক্ষা করে ফলে এই তরঙ্গ তাদের বিস্মিত করে। বিজ্ঞানীরা হার্টবিটের মতো এক রহস্যময় বেতারতরঙ্গ শনাক্ত করলেন গবেষকরা। যাকে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ফাস্ট রেডিও বাস্ট বা এফআরবি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, হৃদস্পন্দনের অনুরূপ সংকেত প্রায় এক বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের এক গ্যালাক্সি থেকে এসেছিল। তবে তাদের কাছে এ সংকেতের প্রকৃত অবস্থান ও কারণ এখনো খুব পরিষ্কার নয়। যা ইতোমধ্যেই নেচার পত্রিকায় প্রকাশও করেছেন গবেষকরা। ২০২০ সালেও পৃথিবীর মতো দেখতে টিএএসএস অন্য একটি নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকা গ্রহ আবিষ্কার করেছিল বিজ্ঞানীরা। চলতি বছর মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর মতো দেখতে আরও একটি গ্রহের সন্ধান পেয়েছেন। পৃথিবী থেকে প্রায় শত কোটি আলোকবর্ষ দূরে টিওআই-৭০০ গ্রহটিতে তাপমাত্রা ও পানি আছে, যা প্রাণ বিকাশে উপযোগী। নাসার বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন, গ্রহটি পৃথিবীর প্রায় ৯০ শতাংশ। এটি নিজের কক্ষপথে ঘুরতে ২৮ দিন সময় নেয়। অর্থাৎ প্রাণের খোঁজে প্রতিনিয়ত ছুটে চলেছেন বিজ্ঞানীরা। চলতি বছর কানাডার মন্ট্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বাধীন একটি আন্তর্জাতিক গবেষক দল মহাকাশে অবিকল পৃথিবীর মতো গ্রহ খুঁজে পান। বিজ্ঞানীরা এই গ্রহের নাম দেন টিওআই-১৪৫২বি বা সুপার আর্থ। নাসার বিজ্ঞানীরা এক বিবৃতিতে জানান, আমাদের সৌরমন্ডলে কয়েকটি উপগ্রহের সঙ্গে এই সুপার আর্থের কিছুটা মিল রয়েছে। বরফের নিচে চাপা থাকা জলরাশির সম্ভাবনার কথাও জানান তারা। তবে সত্যিই এই গ্রহে পানির অস্তিত্ব আছে কিনা বা থাকলে সেই পানি কি অবস্থায় রয়েছে সে বিষয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। অর্থাৎ এই গ্রহের নিত্য-নতুন আবিষ্কার করা বিজ্ঞানীদের কাজের অংশ, তাদের উৎসাহের অংশ। একটি নতুন পৃথিবীর খোঁজ পেতে বিজ্ঞানীরা প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সেদিন অবশ্যই আনন্দের হবে যেদিন পৃথিবীর মতো একটি বাসযোগ্য গ্রহের সন্ধান পাওয়া যাবে। মহাবিশ্বের গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি, ছায়াপথ, ধূমকেতু সবকিছু নিয়েই মানুষ জানতে আগ্রহী। জ্যোতির্বিদরা মনে করছেন যে দৃশ্যমান মহাবিশ্বে প্রায় ১০০ বিলিয়ন গ্যালাক্সি রয়েছে। মানুষ জানতে চায় কীভাবে এই মহাবিশ্বের জন্ম হলো, প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হলো কীভাবে, প্রথম আলোর বিচ্ছুরণ কেমন ছিল এসব মানুষের আগ্রহের বিষয়বস্তু। এই বিশ্ব হলো এই বিশাল মহাবিশ্বের একটু ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। কারণ এই মহাবিশ্ব ঠিক কত বড় তার স্পষ্ট পরিমাপ নেই। কারণ মহাবিশ্ব এখনো প্রসারিত হচ্ছে। ঠিক এ কারণেই মহাবিশ্ব কত বড় তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। স্যার এডিংটনের মতে, প্রতি গ্যালাক্সিতে গড়ে দশ সহস্র কোটি নক্ষত্র রয়েছে। বিভিন্ন তত্ত্ব এবং তথ্য দিয়ে মহাবিশ্ব সম্পর্কে একটি ধারণা দাঁড় করানো হয়েছে মাত্র। তবে মানুষ থেমে নেই। জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত হওয়ার পর থেকেই মানুষ চেষ্টা করছে মহাবিশ্বের রহস্য জানার। অনন্ত নক্ষত্রবিথীর দিকে তাকিয়ে সেই রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করছে মানুষ। সেই আগ্রহের কারণেই সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী হৈচৈ পড়ে গেছে যার মূলে রয়েছে জেমন ওয়েব টেলিস্কোপ নামের একটি শক্তিশালী টেলিস্কোপের পাঠানো ছবি। এই টেলিস্কোপ দিয়ে বিজ্ঞানীরা মহাশূন্যের ১৩৫০ কোটি বছর আগের বিরল ছবি প্রকাশ করা হয়। আমরা গণমাধ্যমের সুবাদে তা দেখেছি। সত্যিই অত্যন্ত আশ্চর্যের হলেও আমরা এত এত কোটি বছর আগের ছবি দেখেছি। ছবিটি এ পর্যন্ত কালের মহাজগতের প্রাচীনতম অবস্থার ছবি। এই জেমস ওয়েব টেলিস্কোপটি গত বছর তার যাত্রা শুরু করে। ১৩৫০ বছর আগের মহাবিশ্বের ক্ষুদ্র একটি অংশের ছবি আমরা আজ দেখছি। হয়তো এভাবেই একদিন আমরা এই পৃথিবী সৃষ্টির রহস্যের কাছাকাছিও পৌঁছে যাবো। তবে এই অনন্ত মহাবিশ্বের রহস্যের খুব কমই এখন পর্যন্ত মানুষের চোখের সামনে উন্মোচিত হয়েছে। মহাবিশ্ব নিয়ে বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে ১ হাজার ৩৮০ কোটি বছর আগে ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির পর এখন যা যা আছে গ্যালাক্সি, গ্রহ ইত্যাদি ছাড়াও মানুষ কীভাবে এলো তাও জানতে চায়। বিগ ব্যাং মডেল অনুযায়ী মহাবিশ্বের শুরু হয়েছিল একটি ভিষণ ঘন ও উষ্ণ অবস্থা থেকে। তারপর থেকে এটি সম্প্রসারমান। এর ফলে এক গ্যালাক্সি অন্য গ্যালাক্সি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত সৌরজগতের এই গ্রহটিতেই প্রাণ রয়েছে। তবে থেমে নেই মানুষ। মানুষ ছুটছে প্রাণের খোঁজে। প্রাণ টিকে থাকার আবশ্যকীয় সম্ভাবনাগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে বিজ্ঞানীরা। এই মহাবিশ্বের রয়েছে অনন্ত রহস্য। এই রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করছে গ্রহের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষ। মানুষের সঙ্গে পৃথিবীর অন্য প্রাণীর পার্থক্য হলো মানুষের কাছে রয়েছে মস্তিষ্ক নামক একটি সম্পদ। এই সম্পদের জেরেই মানুষ অন্যসব প্রাণীকে তার বশে রেখেছে। পৃথিবীর সব প্রাণী মানুষের কাছে মাথানত করেছে। পৃথিবীতে দৃশ্যমান এবং অদৃশ্যমান বহু জীব, অণুজীব রয়েছে। মহাবিশ্বের কোথাও কি কোনো প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে? মানুষের বিশ্বাস যে ভিন গ্রহের প্রাণী আছে। প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই পানির অস্তিত্ব খুঁজছে মানুষ। কারণ পানি হলো প্রাণের প্রধান উপাদান। পানি থাকলেই প্রাণ থাকার সম্ভাবনা থাকে। মানুষ যখন প্রথম অ্যাপোলো-১১ তে চড়ে চাঁদের বুকে পা রাখল সেদিন থেকেই পৃথিবীর বাইরে মানুষের পদচারণার নবযাত্রা শুরু হয়েছিল। আজও চাঁদ নিয়ে মানুষ নিরন্তর গবেষণা চলছে। পৃথিবীর এই একমাত্র উপগ্রহের নানা প্রান্ত থেকে বিজ্ঞানীরা চাঁদের পাথর, মাটি সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করছেন। কোথাও পানির অস্তিত্ব আছে কিনা তা জানতে চেষ্টা করছেন। চাঁদের পর আরও দুটি সম্ভাবনাময় গ্রহ হলো মঙ্গল ও শুক্র। নাসার মহাকাশযান পারজিভারেন্স রোবট রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার পর সফলভাবে মঙ্গলের বুকে অবতরণ করেছে। চাঁদের পাশাপাশি মঙ্গলগ্রহ নিয়েও মানুষ গবেষণা করছে নিরন্তর। কারণ সেখানেও যে রয়েছে প্রাণের সম্ভাবনা। হয়তো সময়ের কোনো এক খেলায় তা বিলুপ্ত হয়েছে। আবার গবেষণার ফলে তা ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। তবে সেসব কেবল সম্ভাবনামাত্র। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় আজ সবই সম্ভব। হয়তো একদিন পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা আরও একটি পৃথিবী আবিষ্কার করতে সক্ষম হবে এই মহাবিশ্বেই।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে