শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
সেলিম আল দীন

বাংলা নাটকের দিকপাল

সেলিম আল দীন এমন একটি নাম- যারা এ দেশের শিল্প-সংস্কৃতি সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা রাখেন তাদের বেশিরভাগই এই নামের সঙ্গে বেশ শক্তভাবেই পরিচিত। আগামীকাল ১৪ জানুয়ারি নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের ১৪তম প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে সংক্ষেপে তার সৃষ্টিকর্মের বিভিন্ন দিক তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন
মাতিয়ার রাফায়েল
  ১৩ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০

দেশের মঞ্চনাটকেন্দ্রিক এমন কিছু নাম আছে, যাদের এ দেশের শিক্ষিত ও সাধারণের প্রায় সবাই একনামেই চেনেন এবং জানেন। তাদের বেশিরভাগই অভিনয়শিল্পী ও নির্মাতা। তবে তাদের সবাই টিভি নাটকের মাধ্যমেই ব্যাপক পরিচিতি পান। কিন্তু যারা শুধুই লেখক তাদের তো সেই সুযোগ নেই। তখন নাটকের নেপথ্য লেখকদের পরিচিতি বড়জোর শিক্ষিতদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সেলিম আল দীন মঞ্চনাট্য ও গবেষণামূলক রচনার পাশাপাশি রেডিও ও টিভি নাটক, চলচ্চিত্রের সংলাপ রচনা ও মঞ্চনাট্যের নির্দেশক হিসেবেও কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন।

নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন এমন একটি নাম- যারা এ দেশের শিল্প-সংস্কৃতি সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা রাখেন তাদের বেশিরভাগই এই নামের সঙ্গে বেশ শক্তভাবেই পরিচিত। কারণ, তিনি যেসব মঞ্চনাটক ও টিভি নাটক লিখেছেন তার সব কয়টিই অত্যন্ত শক্ত বাঁধুনির সঙ্গে রচিত। মঞ্চনাটকের মতো টিভি নাটকগুলোও ছিল দর্শকের টিভি পর্দায় গেঁথে থাকার মতো।

অনেকের নাটকই খুব কমজোরি ও শ্লথ গাঁথুনির হয়ে থাকে। কিন্তু মঞ্চায়ন ও অভিনয়ের জোরেই সেগুলো উৎরে যায়। পাঠযোগ্য হয় খুব কম নাটকই। সেক্ষেত্রে সেলিম আল দীনের নাটক শুধু মঞ্চায়ন ও অভিনয়ের জন্যই নয়- পাঠের জন্যও খুবই সরেস ও আরামদায়ক। কারণ, বাংলার জল, হাওয়া, মাটি ও প্রাণের ভাষায় সিক্ত তার নাটকগুলো বাংলা নাটকের সব উপাদানকে ছুঁয়ে যায় উত্তর-আধুনিকের মন নিয়ে। তার রচনাকর্ম এ দেশের শেকড়ের কথা বলে। এ দেশের প্রান্তিক মানুষের কথা বলে। এ দেশের জনজীবনের কথা বলে। যদিও এই শেকড়ের কথা কোনো নাটকেই সরাসরি স্পষ্ট নয়। শেকড় মানেই তো সেই শেকড় কোনো না কোনো একটি গাছের শেকড়। আর সে শেকড়সম্বলিত গাছটি কোথাও না কোথাও প্রোথিত ছিল বা আছে। সেলিম আল দীনের লেখায় এই গাছটি কোথায় এবং কোন মাটির- তাও পরিষ্কার নয়। কারণ, শেকড়ের সঙ্গে যেকোনো গাছেরই একটা উৎসমূলও থাকে। মানুষের মতো পাখির চঞ্চুতে করে গাছের শেকড় উজ্জীবিত বীজও দেশান্তরিত হয়। তখন বীজের জাতীয় পরিচয়গত এই অস্পষ্টতার কারণেও সেলিম আল দীনের রচনায় পাঠক ও শ্রোতা একই অজানা রসে সিক্ত হন। একই রসে সিক্ত হয়ে মঞ্চের সামনের দর্শক ও শ্রোতাও একই সঙ্গে পাঠক হয়ে যান। সেলিম আল দীনের নাটকভাবনার শক্তি এখানেই।

এই অস্পষ্টতার আবছায়ার সঙ্গেই হাজার বছরের প্রাচীন বাঙালির মধ্যযুগীয় লোকজ পরিচয়কে অবলম্বন করে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের আল-বাঁধা পথে পথান্তরে রোদে-বৃষ্টিতে ঝালাই হওয়া সহজ-সরল অথচ স্বাবলম্বী জনজীবনের জলজ কাব্যের সহজাত ভঙ্গিটি অত্যন্ত অনায়াস মোচড়ে সেলিম আল দীন তার প্রতিটি নাটকের প্রতিটি পঙ্‌ক্তি ও চিত্রকল্প মূর্ত, জীবন্ত ও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।

ঢাকা থিয়েটারকে কেন্দ্র করে সেলিম আল দীনের আলোকিত আবির্ভাব মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই। লেখালেখিতে স্বাধীনতা পূর্বের হলেও লেখক হিসেবে তার আসল খুঁটি গাড়া হয় স্বাধীনতা পরবর্তীকালে। এ সময় থেকে বাংলা মৌলিক মঞ্চনাটকের নতুন যাত্রারও শুরু। কারণ, এর আগে বাংলাদেশে মঞ্চনাটক বলতে বেশির ভাগই ছিল বিদেশি নাটকের ভাবানুবাদ এবং দেশীয় নাটকের মধ্যে কিছু ছাড়া অধিকাংশই সস্তা ও দুর্বল নাটকের মঞ্চায়ন। সেলিম আল দীনের নাটকই বাংলা থিয়েটারের বহুযুগের প্রতীক্ষার অবসান ঘটায়। বাংলা মৌলিক নাটকের ক্ষেত্রে ইউরোপী শিক্ষায় শিক্ষিত সৈয়দ শামসুল হকের পর সেলিম আল দীনের প্রভাব একচেটিয়াই হয়ে ওঠে। মঞ্চনাট্যের ক্ষেত্রে সেলিম আল দীন এমন একটি নতুন নাট্যধারা তৈরি করেন যে, এটা সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে নাসির উদ্দীন ইউসুফকে সাথী করে গড়ে তোলেন বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার। গ্রাম থিয়েটারের প্রথম সংগঠন হিসেবে গড়ে তোলেন মানিকগঞ্জের 'তালুকনগর থিয়েটার'। তার নাটক বাংলাদেশসহ ভারতের কয়েকটি প্রভাবশালী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য। রবীন্দ্রোত্তরকালের বাংলা নাটকের প্রধান পুরুষ সেলিম আল দীন।

প্রজ্ঞা, মেধা, মনন ও দক্ষতায় যে ক'জন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এ দেশের লোকজ সংস্কৃতি ও প্রান্তিক জনজীবনের পরিচয়কে বিশ্বপরিমন্ডলে তুলে ধরেছেন সেলিম আল দীন তাদের অন্যতম। বাংলা নাটকে অসামান্য অবদানের জন্য দেশ-বিদেশে তিনি বহুবার সংবর্ধিত এবং জাতীয় পুরস্কারসহ বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তার মধ্যে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, দুইবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৪ ও ১৯৯৬), নান্দীকার পুরস্কার (আকাদেমি মঞ্চ কলকাতা), শ্রেষ্ঠ টেলিভিশন নাট্যকার (টেনাশিনাস পুরস্কার), একুশে পদক প্রভৃতি।

১৯৭৩ সালে সেলিম আল দীন রচিত 'সর্প বিষয়ক গল্প ও অন্যান্য নাটক' দেশের নাট্যাঙ্গনে ভালো সাড়া পড়ে। এরপর একে একে রচনা করেন- জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন, বাসন, তিনটি মঞ্চনাটক : মুনতাসির, শকুন্তলা ও কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল, প্রাচ্য, কিত্তনখোলা, হাতহদাই, যৈবতী কন্যার মন, চাকা, হরগজ, একটি মারমা রূপকথা, বনপাংশুল, নিমজ্জন, ধাবমান, স্বর্ণবোয়াল, ঊষা উৎসব ও স্বপ্নরমণীগণ (নৃত্যনাট্য), পুত্র ইত্যাদি। সেলিম আল দীনের নাটকের গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে একাধিক চলচ্চিত্র। ১৯৯৪ সালে তার 'চাকা' নাটকের চলচ্চিত্রায়ন করেন নির্মাতা মোর্শেদুল ইসলাম এবং ২০০১ সালে তার 'কিত্তনখোলা' নাটক নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন আবু সাইয়িদ।

নির্দেশক হিসেবেও সেলিম আল দীনের কৃতিত্ব অসামান্য। তার নির্দেশিত নাটকের মধ্যে মহুয়া, দেওয়ানা মদিনা, একটি মারমা রূপকথা, কাঁদো নদী কাঁদো, মেঘনাদবধ প্রভৃতি উলেস্নখযোগ্য। কাজের মধ্যেই সাফল্য তার হাতে এমনভাবে ধরা দিয়েছে যে, জীবদ্দশাতে তিনি শিষ্যদের মধ্যে এতটাই প্রভাব ফেলেছিলেন কোনো শিষ্যই এই নাট্যগুরুর চরণ ছুঁয়ে নিজ মাথা স্পর্শ করে থাকতে পারতেন না। যেখানেই যেতেন শত শত শিষ্য পরিবেষ্টিত থাকতেন। জাহাঙ্গীর নগর ক্যাম্পাস তার এবং শিষ্যদের পদভারেই সর্বদা মুখরিত থাকত। যেদিন তার মৃতু্য হয় ভক্তদের সবাই অশ্রম্ন বিসর্জন দিয়ে শোকাকুল থাকেন দিনের পর দিন। বাংলা মঞ্চনাটক তো বটেই টিভি নাটকেও তার শূন্যতা কখনোই পূরণ হওয়ার মতো নয়। ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট সীমান্তবর্তী ফেনী জেলার অন্তর্গত সমুদ্রতীরবর্তী সোনাগাজী উপজেলার সেনের খিলে জন্মগ্রহণ করা সেলিম আল দীন মৃতু্যবরণ করেন ২০০৮ সালের এই দিনে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে