বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রামেন্দু মজুমদার :থিয়েটারের বাতিঘর

মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের কয়েকটি অনুষ্ঠানে অংশ নেন বরেণ্য নাট্যজন রামেন্দু মজুদার। এ সময়ে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা, বিবৃতির একটি ইংরেজি সংকলন সম্পাদনা করে দিলিস্ন থেকে প্রকাশ করেন। তার সময়ের অনেক বরেণ্য অভিনেতাই বর্তমানে নেই। সেক্ষেত্রে এ দেশের পথিকৃৎ নাট্যদল থিয়েটারের কান্ডারি রামেন্দু মজুমদার যেন এখনো নিঃসঙ্গ শেরপা'র মতো তার পথচলা অব্যাহত রেখেছেন।
মাতিয়ার রাফায়েল
  ১৮ মে ২০২৩, ০০:০০

দেশের থিয়েটার কেন্দ্রিক মঞ্চ নাটকে যারা বিশিষ্টতা লাভ করেছেন তাদের অন্যতম পথিকৃৎ স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত এবং একুশে পদকে ভূষিত নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার। প্রচুর টিভি নাটকেও তার রাশভারী কণ্ঠের অভিনয় দিয়ে দর্শকের মাঝে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন। ৮১ বছরের এই 'তরুণ' নাট্যজন একাধারে অভিনেতা, মঞ্চ নির্দেশক এবং নির্মাতা। কয়েকটি জীবনঘনিষ্ঠ চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছেন তিনি। চিত্রা নদীর পারে, নদীর নাম মধুমতী, জীবনঢুলী, রূপসা নদীর বাঁকে, লালন, এই তো প্রেম- তার উলেস্নখযোগ্য চলচ্চিত্র।

বাংলাদেশের নাট্য জগতে রামেন্দু মজুমদারের পদচারণা পাঁচ দশক জুড়ে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে গ্রম্নপ থিয়েটার আন্দোলনের শুরু থেকেই বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের ক্রমবিকাশে তার দল থিয়েটারের অসামান্য ভূমিকা রয়েছে। তার সুদীর্ঘ অভিনয় জীবনে মঞ্চ ও টেলিভিশনে বহু স্মরণীয় প্রযোজনায় অভিনয় করেছেন। বাংলাদেশের আরেক বরেণ্য নাট্যজন ফেরদৌসী মজুমদার তার জীবনসঙ্গিনী।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের কয়েকটি অনুষ্ঠানে অংশ নেন বরেণ্য নাট্যজন রামেন্দু মজুদার। এ সময়ে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা, বিবৃতির একটি ইংরেজি সংকলন সম্পাদনা করে দিলিস্ন থেকে প্রকাশ করেন। তার সময়ের অনেক বরেণ্য অভিনেতাই বর্তমানে নেই। সেক্ষেত্রে এ দেশের পথিকৃৎ নাটদল থিয়েটারের কান্ডারি রামেন্দু মজুমদার যেন এখনো নিঃসঙ্গ শেরপা'র মতো তার পথ চলা অব্যাহত রেখেছেন। গত কয়েক মাসের ব্যবধানে দুটি নতুন নাটক মঞ্চে এনেছে তার দল থিয়েটার। একটি 'পোহালে শর্বরী' অপরটি 'লাভ লেটারস' বা 'প্রেমপত্র'। হিন্দি ভাষার সাহিত্যিক সুরেন্দ্র বর্মার 'সুরয কি অন্তিম কিরণ সে সুরয কি পহেলি কিরণ তক' রচনা থেকে 'পোহালে শর্বরী' অনুবাদ করেছেন অংশুমান ভৌমিক। অন্যদিকে, মার্কিন নাট্যকার এ আর গার্নির 'লাভ লেটারস' থেকে ভাবানুবাদ করেছেন আবদুস সেলিম। যেহেতু এ আর গার্নি মার্কিন নাট্যকার তার 'লাভ লেটার্সে' মার্কিন প্রেক্ষাপট ও আবহ থাকবে- সেটাই স্বাভাবিক। তবে রূপান্তরিত নাটকে মূলভাবটুকু ছাড়া এ আর গার্নির কিছুই নেই। নাটকটির ভাবানুবাদ করতে গিয়ে অনুবাদক এতটাই অসীম স্বাধীনতার আশ্রয় নিয়েছেন যে, গার্নি রচিত নাটকটির পুরো খোল-নলচেই বদলে দিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশের আলোকে ও প্রেক্ষাপটে রূপান্তর করতে গিয়ে নাটকটির বিষয়-বস্তুতে এতটাই বিচু্যতি ঘটানো হয়েছে যে, নাটকটিকে আর এ আর গার্নির নামে চালানোই যেন বড় বেমানান হয়ে যায়। এটা আবদুস সেলিমেরই নিজস্ব চিত্রনাট্যে তৈরি নাটক।

নাটকটি আরও কয়েক বছর আগেই প্রয়াত নাট্যজন আলী যাকেরকে সঙ্গে নিয়েই আনার প্রস্তুতি ছিল। তার অসুস্থতা ও মৃতু্যর কারণে সেটা বিলম্বিত হয়। দীর্ঘ প্রচেষ্টা শেষে অবশেষে সম্প্রতি রাজধানীর বেইলি রোডের বাংলাদেশ মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে নাটকটির মঞ্চায়ন করা হয়। নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন ত্রপা মজুমদার। সম্পূর্ণ নতুন বিষয়বস্তুতে নিয়ে আসা এই নাটকটিতে পাঠ্যাভিনয় করেছেন অনন্ত শাহেদ চৌধুরীর ভূমিকায় দেশের বরেণ্য মঞ্চ অভিনেতা রামেন্দু মজুমদার এবং মাইশা ইসলামের চরিত্রে ফেরদৌসী রহমান। এ নিয়ে যায়যায়দিনের পক্ষ থেকে বিশিষ্ট নাট্যজন রামেন্দু মজুমদারের একটি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। প্রথমেই জানতে চাওয়া হয় দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফসল নাটকটির মঞ্চায়নের স্বার্থকতা বিষয়ে। তিনি বলেন, 'আমরা আসলে নাটকটা নিয়ে আসতে প্রথমে আলী যাকেরের বাসায় ২০১৭ সালে পাঠ্যাভিনয়ের কাজটি শুরু করি। তখন আলী যাকের ও ফেরদৌসী মিলে এর জন্য মহড়া শুরু করেছিলেন। তাদেরই দুটো চরিত্রে অভিনয় করার কথা ছিল। গতবারই যখন এটা মঞ্চে আনার উদ্যোগ নিই তার আগেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারপরে হয়তো বুঝতে পারেন তিনি আর বাঁচবেন না- তখন তিনিই আমাকে বলেন, 'তোমরা কাজটি শুরু করে দাও'। তবে এর আগে আমরা 'পোহালে শর্বরী' নাটকটি নিয়ে আসি। তারপরেই এটা নিয়ে আসি। এর পেছনে অবশ্য ত্রপার (ত্রপা মজুমদার) একটা কৃতিত্ব রয়েছে। নাটকের সেট নির্মাণ বিষয়ে ত্রপার ভেতরে আত্মবিশ্বাস আছে প্রচন্ড। অনেক যত্ন করেছে এটার জন্য। মিউজিক, সেট লাইট, ভিডিওসহ ও এটার সঙ্গে অনেক কিছু যুক্ত করেছে।'

নাটকটির রচয়িতা বিদেশি হলেও এর প্রেক্ষাপট যেভাবে তুলে আনা হয়েছে সেখানে বিদেশের কিছুই থাকে না। নাটকটিতে নিয়ে আসা হয় এ দেশের স্বাধিকার আন্দোলনের প্রথম পাঠ ছয় দফা, তারপরে গণ-অভু্যত্থান, '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং এর পরবর্তী সময়ের যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রভৃতি। এর বর্ণনা আসে প্রেমের সম্পর্কে আবদ্ধ দুটি চরিত্র অনন্ত শাহেদ চৌধুরী এবং মাইশা ইসলাম তাদের পরস্পরের পত্র চালাচালির মাধ্যমে। প্রেমের সম্পর্ক থাকলেও দুজনই মনোলোকের ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী দুটি ভিন্ন জগতে বসবাস করেন। অনন্ত শাহেদ চৌধুরী নিয়মানুবর্তিতা মানা মানুষ, আর মাইশা ইসলাম তা না মানা এবং দুজনের সম্পর্কই শেষ পর্যন্ত আলাদা হয়ে যায়। এই বিষয়টি সামনে এনেই স্বাধীনতা ও একুশে পদকে ভূষিত এ অভিনেতাকে প্রশ্ন করা হয়- তাহলে কি তাদের এই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার মতোই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন যেটা একটা দেশের প্রেমের পরিণতি থেকে ঘটে কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই দেশপ্রেমটি আর দেশটির নাগরিকদের মাঝে একইভাবে অক্ষুণ্ন থাকে না? তখন তিনি বলেন, 'না, না, না- বিষয়টি সে রকম নয়। বিভিন্ন দেশেই এই নাটকটি বিভিন্নভাবে রূপান্তরিত হয়েছে। আমাদের এখানেও এটার রূপান্তরণে চরিত্রগুলো বদলে দেওয়া হয়। প্রেক্ষাপটগুলো নিয়ে আসা হয় ভিন্ন আঙ্গিকে। তাদের প্রেম-বিচ্ছেদ একান্তই ব্যক্তিগত। বাংলাদেশ জন্ম হওয়ার পেছনে যে 'দেশপ্রেম' ছিল সে রকম 'প্রেম' নয়। তাদের বিয়োগান্তক বিষয়টি সে অর্থে আসেনি। বিষয়টি একান্তই ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে এসেছে। রাষ্ট্রীয় অর্থে নয়।'

নাটকটিতে দুটি মানুষের ব্যক্তিগত প্রেমের মধ্যেও দেশপ্রেম সম্পর্কের 'ছয় দফা' থেকে শুরু করে একাত্তরের যুদ্ধ এবং পরবর্তীকালের যুদ্ধাপরাধ সব ধরা দিলেও বিস্ময়করভাবে দেশপ্রেমের প্রথম পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ মহান একুশে ভাষা আন্দোলনকে এড়ানো হয়েছে। দুটি চরিত্রের প্রেমের সম্পর্কেও দেশপ্রেমের এই ভাষা আন্দোলনের বিষয়টিও কি জুড়ে দেওয়া যেত না? এমন প্রশ্নে এ বরেণ্য অভিনেতা বলেন, 'আসলে এটা তাদের চলার পথের ষাট বছরের কথা বলা হয়েছে। নাটকের প্রেক্ষাপটটিও ওইভাবেই এসেছে- দুজনের জীবন চলার পথে যতটুকু সময় আছে ততটুকুই এসেছে।'

ভাবানুবাদে দেশে প্রচুর মঞ্চ নাটক হয়েছে। নাটকের রচয়িতা হিসেবে কোনো বিদেশির নাম থাকলেও তার চিত্রনাট্য সবই হয় অনুবাদকের; মূল নাট্যকারের নয়। এগুলো এমন জনপ্রিয়ও হয়েছে- যা মৌলিক নাটকেও হয়নি। অথচ বিষয়বস্তু বা চিত্রনাট্য যতই মৌলিক ও বাংলাদেশীয় হোক সেগুলো সে রকম দর্শকপ্রিয় হচ্ছে না। সেখানে যদি মূল রচয়িতা হিসেবে বিদেশি বিখ্যাত নাট্যকারের নাম দেখানো হতো তাহলে কি এগুলোও জনপ্রিয় হতো? এমন বিষয়ে রামেন্দু মজুমদার বলেন, 'আমাদের এখানে আসলে সেই মানের ভালো রাইটার হচ্ছে না। সৈয়দ শামসুল হক, সেলিম আল দীন, আবদুলস্নাহ আল মামুনের মতো নাট্যকার আসছেন না। তারা যে মানের নাটক রচনা করেছেন তাহলে অভিনয় শিল্পও সে মান অনুযায়ী ভালো হতো।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে