বাংলাদেশের গর্বিত এক সংস্কৃতিকর্মী রাহুল আনন্দ। একই সঙ্গে টিভি, মঞ্চ ও গানের মানুষ। মূলত গানের মাধ্যমে তিনি দেশ, প্রকৃতি ও মানুষের বন্দনা করেন। সবুজ পৃথিবী গড়ার পাশাপাশি সম্প্রীতি এবং অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও রাষ্ট্রের কথা বলেন। প্রাচ্যনাট নাট্যদলের জ্যেষ্ঠ সদস্য রাহুল থিয়েটার চর্চার সূত্রে তৈরি সঙ্গীতের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা এবং মায়াময় প্রেম থেকেই নিজেকে সঁপে দেন একনিষ্ঠ সঙ্গীত সাধনায়। সবুজ প্রকৃতি ও বৈচিত্র্যময় জীবন থেকে নেয়া নানা ভাবনা ও শব্দের সমন্বয়ে কথা ও সুর তৈরির খেলা করেন। হোক সেটা মঞ্চে কিংবা নিজ ঘরে বা স্টুডিওতেই। নতুন নানা আবিষ্কার তিনি উপহার দেন দর্শকদের, সঙ্গীতপ্রেমীদের। সঙ্গীতের প্রতি তীব্র নেশা ও সাধনার যুথবদ্ধ চর্চার নিমিত্তে ২০০৬ সালে বন্ধু-সহশিল্পীদের নিয়ে 'জলের গান' ব্যান্ড গঠন করেন। পরবর্তী সময়ে দলের হয়ে বেশ কিছু নন্দিত গান যেমন উপহার দিয়েছেন তেমনি দেশীয় সুরের বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে আলাদা পরিচয় তৈরি করেছেন তিনি। শুধু তাই নয়, প্রচলিত বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি রাহুল নিজেও একাধিক বাদ্যযন্ত্র তৈরি করেছেন। যা তাকে আলাদা করেছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন শিল্পী থেকে। সেই রাহুল ফের নতুন করে আলোচনায় এসেছেন সম্প্রতি। কারণ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বাংলাদেশ সফরে এসে রাহুলের বাসায় দেড় ঘণ্টারও বেশি সময় কাটিয়েছেন। আর তাতেই নতুন করে সাড়া পড়ে যায় রাহুল আনন্দকে ঘিরে। সঙ্গীত নিয়ে আলোচনা এবং চর্চা শুরু হয়। তাদের সেই চর্চায় স্পষ্ট হয়েছে এ ঘটনায় কতটা আপস্নুত ও গর্বিত দেশবাসী। তবে অন্য কিছু নয়, রাহুল সঙ্গীত দিয়েই আপ্যায়ন করেছেন অতিথিকে, তাতে বিস্মিত ও মুগ্ধতা ছুঁয়ে গেছে স্বয়ং ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবং তার সফর সঙ্গীদের মনে। বিষয়টিকে রাহুল সাধারণ হিসেবে দেখলেও এই ঘটনাকে গর্বচিত্তে উপভোগ করেছেন দেশের সঙ্গীতপ্রেমীরা। পাশাপাশি তাদের আগ্রহ কেন রাহুল আনন্দের বাড়িতেই পা রাখলেন ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ? এ প্রসঙ্গে রাহুল আনন্দ বলেন, 'ফ্রান্স অ্যাম্বাসির উদ্যোগে বেলজিয়ামের এক শিল্পীর সঙ্গে সাইকেল এবং রিকশা যন্ত্রাংশের শব্দ নিয়ে যে পারফর্ম করেছিলাম, সে অনুষ্ঠানটি উপস্থিত দর্শক তো বটেই সেই পারফরম্যান্সের খবর শুনে অ্যাম্বাসির মাধ্যমে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন, সেই সুবাদে তিনি আমার বাসায় এসেছিলেন। তাকে আমি যথাযথ আপ্যায়ন করার চেষ্টা করেছি, গান শুনিয়েছি। তিনি আমার স্টুডিও ঘুরে দেখেছেন। খুব ভালো একটা আনন্দ লাগার সময় ছিল।' ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের মতো মানুষ একজন শিল্পীর বাসায় এসেছেন; এতে শিল্পী জীবনে কোনো প্রভাব পড়বে কিনা- এ প্রসঙ্গে রাহুল আনন্দ বলেন, 'না মোটেও তা নয়, আমি অভিভূত বটে- তবে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট আমার বাসায় আসা কোনো পস্নাস পয়েন্ট নয় আমার জন্য। বরং আপনি বা অতি কোনো সাধারণ মানুষও যদি আমার স্টুডিওতে আসেন তাতে একইরকম খুশি হব। বলতে পারি, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এবং বিদেশি অন্য অতিথিদের সামনে আমি আমার বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছি, তাদের আমার মিউজিকের মাধ্যমে আপ্যায়ন করার চেষ্টা করেছি- এই যা। তার আগমন আমার ক্যারিয়ারে কোনো প্রভাবই ফেলবে না, আমি যা তাই। আমি অতি সাধারণ একজন মানুষ, গানের মানুষ, যে কোনো মানুষ আমার কাছে এলে আমার গান শুনলে আমি খুশি হই। প্রধানত আমি বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র নিয়ে পরীক্ষানীরিক্ষা করতে পছন্দ করি। দেশীয় বাদ্যযন্ত্রে বিভিন্ন যন্ত্রে কাঠের ব্যবহার করি, দেশি জিনিসপত্র ব্যবহার করি। গান বাজনা করতে পছন্দ করি, সাধনা করি এটা সাধারণ ব্যাপার। এর বেশি কিছু নয়।' বিষয়টি আরও খোলাসা করে সব ধরনের ভক্তদের উদ্দেশ্যে রাহুল বলেন, 'ঢাকায় নিযুক্ত ফরাসি সংস্থা আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের সঙ্গে আগে নানা আর্ট ও মিউজিক প্রজেক্টে কাজ করেছি। কর্তৃপক্ষ চেয়েছেন তাদের রাষ্ট্রপতিকে বিভিন্ন মাধ্যমের কিছু শিল্পীর সঙ্গে কথা বলাতে এবং বাংলাদেশের পারিবারিক আবহ দেখাতে। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে তিনি আমার স্টুডিওতে এসেছিলেন। আর উনি চেয়েছেন আমার স্টুডিও দেখতে, বাদ্যযন্ত্র দেখতে। ঘটনাক্রমে, আমার স্টুডিও এবং যন্ত্র তৈরির কারখানা আমার বাড়িতেই। আমি যে বাড়িতে থাকি, তা শত বছরের পুরানো স্থাপত্য, যার কারণে ইতিহাসের একটা চিহ্ন আছে। হয়ত সেও এক আকর্ষণীয় ব্যাপার ছিল। রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে আমি এ দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র। তবে এ ঘটনায় সত্যি আমি অভিভূত। পুরো সময় আমি বিস্ময়ের এক ঘোরে ছিলাম! আমি আমার দেশের নাগরিক তথা সরকার ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাকে যথাযোগ্য সম্মান ও আমাদের সংস্কৃতি অনুযায়ী বরণ করতে চেষ্টা করেছি। অতিথিসেবা আমাদের পূর্বপুরুষের সংস্কৃতির প্রধান অঙ্গ এবং দায়িত্ব, সেই জন্যই করেছি। তাকে আমাদের স্টুডিওতে আতিথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত কোনো আবেগ, লাভ-লোকসান, লেনাদেনা বা উদ্দেশ্য ছিল না। বরং তাকে মানুষের ভালোবাসার কথা, একটা সুন্দর সবুজ পৃথিবী গড়ার কথা বলেছি।' কিন্তু যে শিল্প উপস্থাপনার সূত্রে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট রাহুলের বাসায় এসেছিলেন তাতে কী ছিল? ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশের ইউনিক পস্নাস্টারের সাংস্কৃৃতিক আদান-প্রদানের অংশ হিসেবে কিছু দিন আগে ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে গ্যালারি হলে রাহুল আনন্দ এবং বেলজিয়ামের বেস্ট ভেন্ডারম্যাক্স মাল্টি ডিসিপিস্ননারি মিউজিক থিয়েটার প্রকল্পের ব্যতিক্রমী এক উপস্থাপনা করেছিলেন। তারা তাদের সেই উপস্থাপনায় বহুমাত্রিক শব্দের জন্য তারা বেছে নিয়েছিলেন রিকশা, সাইকেলের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ এবং পথে ঘাটে পরে থাকা খুব সাধারণ বিভিন্ন পস্নাস্টিকের বোতল। এসব থেকে শব্দ হয়, ছন্দ তৈরি হয় এবং এসব থেকে এক সময় একটি সম্পর্ক তৈরি হয় এবং এক সময় সঙ্গীত হয়। অনবদ্য শব্দের খেলার মাধ্যমে ঠিক তাই যেন মূর্ত করে তুলেছিলেন দুই শিল্পী। এ প্রসঙ্গে তারা জানান, সঙ্গীতের প্রধান অনুষঙ্গই হলো শব্দ। তাই নতুন শব্দের খোঁজে, নতুন কোনো সঙ্গীতের আবহ তৈরি সন্ধানের নেমেছিলেন পৃথিবীর দুই প্রান্তের এই দুই শিল্পী। এক ঘণ্টার পারফরম্যান্সে তারা দু'জন দেখান একটি ছেলের বাইসাইকেল নিয়ে একটি নাট্যযাত্রার পাশাপাশি বাংলাদেশ ও বেলজিয়ামের সংগীতের লড়াই। তবে লক্ষণীয় তারা শব্দের খেলায় মেতে উঠলেও একপর্যায়ে তারা যে যার শিকড়ে ফিরে আসেন। নতুনকে আবিষ্কার করলেও তারা তা গহণ করে নিজেদের ভেতরের সঙ্গীতের মাধ্যমে, যেমন করে রাহুলের কণ্ঠে লালন এবং বেলজিয়ামের ম্যাক্সের কণ্ঠেও তেমনিভাবে উঠে আসে তার দেশের প্রাচীন কোনো সুর-শব্দ। ব্যতিক্রমী এই আয়োজন প্রসঙ্গে রাহুল আনন্দ বলেন, শব্দ দিয়েই তো সঙ্গীত হয়, সেই শব্দগুলোকে বিন্যাসের মধ্য দিয়ে সেই সঙ্গীতের পথে মানুষকে নিয়ে ভ্রমণ করতে পারব। এই পারফরম্যান্স অনেকটাই তাই। কারণ এখানে শুধু মিউজিক না, এখানে মিউজিক থিয়েটার, সবকিছু এক সঙ্গে আছে। সব শেষে বলা যায় চর্চার প্রচার এবং প্রসারে নিয়তই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মঞ্চে পারফর্ম করে থাকেন রাহুল আনন্দ।