সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যতিক্রম কেবল মন্দিরা

মাতিয়ার রাফায়েল
  ১৬ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০

সেই ছোটবেলা থেকে একজন নৃত্যশিল্পী হিসেবে নিজেকে বিকশিত করে আসছিলেন মন্দিরা। পারিবারিক নাম মন্দিরা চক্রবর্তী। কৈশোরে ২০১২ সালে চ্যানেল আই আয়োজিত 'সেরা নাচিয়ে' নামের একটি নৃত্য প্রতিভা অন্বেষণ প্রতিযোগিতা দিয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করেন তিনি। এ প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় রানার্সআপ হয়েছিলেন। এরপর নাচের পাশাপাশি নাটকেও নিয়মিত অভিনয় করে আসছিলেন। সেই যে নৃত্যশিল্পী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর মন্দিরা এরপর হঠাৎ করেই হয়ে গেলেন চলচ্চিত্রের অভিনয় শিল্পী। ঢাকাই শোবিজে নৃত্যশিল্পী থেকে অভিনয় শিল্পী হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। তবে মন্দিরা নাচের পাশাপাশি টুকটাক নাটকে অভিনয় করলেও চলচ্চিত্রে পা রেখেছেন একেবারে সরাসরি নায়িকা হিসেবেই। সেই অভিষেক সিনেমাটির পরিচালকও পেয়ে গেলেন 'মনপুরা' সিনেমা দিয়ে রাতারাতি তারকা বনে যাওয়া গিয়াস উদ্দিন সেলিমকে। একেই বলে পয়মন্ত কপাল!

যখন এই পরিচালকের সিনেমায় নায়িকা হিসেবে যুক্ত হলেন মন্দিরা তখন সিংহভাগ মানুষের কাছে আধো চেনা, আধো অচেনা। অনেকেই ভাবছিলেন এ নায়িকা আবার কে? তাও এমন জাঁদরেল পরিচালকের সিনেমায়? সত্যিই একজন আনকোরাকে নিয়ে এসে এ পরিচালক তার সিনেমায় যেন একটা জুয়াই খেলতে যাচ্ছেন!

৪০০ বছর আগের একটি ক্লাসিক রূপকথাভিত্তিক ময়মনসিংহ গীতিকার 'কাজল রেখা' অবলম্বনে তৈরি

'কাজল

রেখা'। জীবনের প্রথম ছবিটিতেই এই চিত্তাকর্ষক গল্পের নাম ভূমিকায় অভিনয় করলেন মন্দিরা। সিনেমাটি এখন মুক্তির অপেক্ষায়।

এই যে মন্দিরার মতো একদম আনকোরাকে নিয়ে এমন একটি বহু জনশ্রম্নত লোক কাহিনীভিত্তিক সিনেমা বানালেন, সফল হবে তো? এর উত্তর খুঁজতে গেলে পরিচালকের সঠিক বিবেচনারই পরিচয় পাওয়া যায়। নয়ত, এমন একটা ঐতিহাসিক ধ্রম্নপদী গল্পের সিনেমায় স্টার নায়িকা দিয়ে বানালে কঠিন অবিবেচকের কাজই হতো। কারণ, যারা 'মৈমনসিংহ' গীতিকা পড়েছেন তারাই বুঝবেন, সিনেমাটিতে তারকা অভিনেত্রী থাকলে দর্শকই সেই অকৃত্রিম 'কাজল রেখা'র কাজল রেখাকে খুঁজে পেতেন না সেরকম বাণিজ্যিক অভিনেত্রীর মধ্যে। এটা এমনই ধ্রম্নপদ জীবনঘনিষ্ঠ কাহিনী, এমনই লৌকিক জীবনের কালজয়ী গল্প যে, এর নায়িকা তারকা বা বাণিজ্যিক শিল্পী দিয়ে বানালেই বরং গল্পটি কৃত্রিম হয়ে উঠত। একটু অচেনা-অচেনা গন্ধী শিল্পী দিয়েই বরং এমন গল্পের সিনেমা ভালো হয়। 'মনপুরা' সিনেমার ব্যবসায়িক সাফল্যের রহস্যও ছিল তাই। সিনেমাটিতে সুপার-ডুপার তারকা শিল্পী রাখলে মনে হয় না সিনেমাটি এত সাফল্য পেত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারকা শিল্পীরা মানানসই বরং কমার্শিয়াল অ্যাকশনধর্মী সিনেমাতেই।

একটি সিনেমার কাহিনীই যদি তার সবকিছুর 'হিরো' হয় তখন আলাদাভাবে কোনো হিরো বা তারকা লাগে না। 'কাজল রেখা' সেরকমই গ্রাম-বাংলার কাহিনী। 'মৈমনসিংহ' গীতিকার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে রয়েছে রূপকথা 'কাজল রেখা' পালা। এক সময় যাত্রাপালা কিংবা বইয়ের পাতায় উঠে এসেছে এই কল্পকাহিনীটি। অসংখ্য দর্শক-শ্রোতা মুগ্ধ হয়েছেন এই পালাটি দেখে। এ কাহিনী অবলম্বনে ছোটপর্দায়ও দীর্ঘ ধারাবাহিক হয়েছে। প্রচারিত হয়েছে দীপ্ত টিভিতে। এখন বড়পর্দায় এটা দেখতে কেমন হয় সেটার জন্য মুক্তির আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সিনেমাটির মেকিং, অ্যাকটিং, লোকেশন সেরকম মনমাতানো হলে এটা ব্যবসা না করে পারে না। যদি কাহিনীর সঙ্গে চরিত্রের স্বার্থক রূপায়ন ঘটে তাহলে বলা যায়, প্রথম সিনেমাটির মধ্য দিয়েই মন্দিরা একটি উজ্জ্বল ক্যারিয়ার গড়তে যাচ্ছেন।

সেদিক থেকে 'কাজল রেখা' যেহেতু কমার্শিয়াল উদ্দেশ্যে বানানো সিনেমা নয় (ব্যবসা করলে কমার্শিয়াল হবে), সে কারণে, এই ছবিটির মধ্য দিয়ে মন্দিরা চক্রবর্তীর একটা ভালো কিছু করার সম্ভাবনা আছে। আর সেটা সিনেমাটিতে ব্যবহৃত গল্পের ঐতিহাসিক গুরুত্বের জোরেই। এখন দেখার বিষয় এই সিনেমাটি 'মনপুরা'র জনপ্রিয়তাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে কিনা।

বাংলার খুব কম মানুষই আছেন যারা 'মৈমনসিংহ' গীতিকার কাহিনীগুলোর সঙ্গে পরিচিত আছেন। এই কাহিনী অবলম্বনে ষাট দশকেও সিনেমা হয়েছে। এর মধ্যে আছে সৈয়দ আউয়াল পরিচালিত 'গুণাই বিবি', আলী মনসুর পরিচালিত 'মহুয়া', ফাল্গুনীগোষ্ঠী পরিচালিত 'মলুয়া' প্রভৃতি। তবে সেই এই ছবিগুলো সালাহউদ্দিনের 'রূপবান'-এর জনপ্রিয়তার সঙ্গে পেরে উঠতে না পারায় এই প্রচেষ্টা সে সময়ের মতো আর তেমন আগায়নি।

দীর্ঘ কয়েক দশক পর আবার গিয়াস উদ্দিন সেলিম সেই ময়মনসিংহ গীতিকার একটি কাহিনী 'কাজল রেখা' অবলম্বনের সিনেমা বানিয়েছেন। সিনেমাটির নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন মন্দিরা চক্রবর্তী। জীবনের প্রথম সিনেমাটিতেই একদিকে যেমন পেয়ে গেলেন একজন খ্যাতিমান পরিচালককে পাশাপাশি এমন একটি আখ্যানের নাম ভূমিকায় অভিনয় করার সুযোগ পেলেন মৈমনসিংহ গীতিকার একটা কালজয়ী ধ্রম্নপদী কাহিনী। যে 'মৈমনসিংহ' গীতিকা বহু বিশ্ববিদ্যালয়েও পাঠ্য।

ছবিটি মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল এ বছরেই। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আগামী বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে এ জন্য। দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা নিয়ে ও অনেক উচ্চাশা নিয়ে ছবিটি বানিয়েছেন পরিচালক। 'কাজল রেখা' নিয়ে টিভি সিরিয়াল হওয়ার অনেক আগে থেকেই এই পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন সিনেমাটির পরিচালক। হয়ত 'মনপুরা'কে ছাড়িয়ে যাওয়ার স্বপ্ন নিয়েই এত দীর্ঘ পরিকল্পনায় বানিয়েছেন সিনেমাটি। নয়ত মৈমনসিংহ গীতিকার মতো বহুল জনশ্রম্নত একটি চরিত্র নিয়ে ছবিটি বানাতেন না। এখন মন্দিরাকে যদি সেই 'মৈমনসিংহ' গীতিকার 'কাজল রেখা'র অকৃত্রিম লুকে তুলে ধরতে পারেন, সংশয় নেই গিয়াস উদ্দীন সেলিম ঢাকাই চলচ্চিত্রে আরও একটি ইতিহাস হয়ে থাকবেন। সেইসঙ্গে নতুন অভিনেত্রী হিসেবে মন্দিরা চক্রবর্তী তো বটেই।

কথা ছিল, মন্দিরা 'কাজল রেখা' মুক্তির আগে নতুন সিনেমায় যুক্ত হবেন না। দর্শক ছবিটিতে তাকে কেমনভাবে নিলেন সেটা দেখেই নতুন সিনেমায় যুক্ত হবেন। তবে এরই মধ্যে নতুন একটি সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হয়ে গেছেন মন্দিরা চক্রবর্তী। ছবিটির নাম 'নীলচক্র'। বললেন, যখন জানলাম এই ছবিটিতে আমার বিপরীতে থাকছেন আরিফিন শুভ তখন আর এটা না করতে পারলাম না। কারণ, আমার বিপরীতের নায়কটিই যে ছিলেন আমার শৈশবের প্রথম ক্রাশ!

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে