বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫, ৫ আষাঢ় ১৪৩২

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও অদৃশ্য সিন্ডিকেট

শুধু একটি নির্দিষ্ট পণ্য নয়, মানুষের দৈনন্দিন চাহিদার প্রায় সব পণ্যের দামই বাড়ছে। কখনো কখনো তা হয়ে যাচ্ছে লাগামছাড়া। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারি বাজারে সব ধরনের সবজি কেজিতে গড়ে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়েছে। কয়েক দিনের ব্যবধানে পেঁয়াজ প্রতি কেজিতে বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা।
সাহাদাৎ রানা
  ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও অদৃশ্য সিন্ডিকেট

বর্তমানে করোনার কারণে সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ কঠিন সময় পার করছেন। এর বাইরে নয় বাংলাদেশও। বাংলাদেশে করোনার কারণে অনেকের জীবন যাত্রায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। অসংখ্য মানুষ কাজ হারিয়ে হয়ে গেছেন বেকার। অনেকের কমে গেছে আয়ের পরিমাণও। এসব কারণে মানুষ রয়েছে অস্বস্তিতে। অস্বস্তি রয়েছে আরও অনেক জায়গায়। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে। এমনিতেই সবসময় সাধারণ মানুষ নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি নিয়ে সমস্যায় থাকেন। করোনার সময়ে এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঊর্ধ্বমূল্য সাধারণ মানুষকে ফেলেছে চরম ভোগান্তিতে। যার শেষ কোথায় আসলে এখনো কেউ বলতে পারছে না। অবশ্য আমদানিকারক ও পাইকারি বিক্রেতাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে চাহিদার বিপরীতে জোগান একদম কম, এ কারণে দাম বাড়ছে। মূলত নিয়মিত বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকায় খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা তাদের খেয়াল খুশিমতো দাম বাড়াচ্ছেন। আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের ইচ্ছাই মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ।

বর্তমানে যেসব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পাচ্ছে এসব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে নেই যৌক্তিক কোনো কারণ। কোনো কারণ ছাড়াই তরতর করে শুধুই বাড়ছে দ্রব্যমূল্য। আজ এক দামে কোনো একটি পণ্য কিনে নিয়ে গেলে পরদিন দেখা যায় সেই পণ্যের দাম কেজিতে বেড়ে গেছে কয়েক টাকা। এ বিষয়ে দোকানির সহজ ও সেই কমন যুক্তি- চাহিদার চেয়ে পণ্যের জোগান কম। আবহাওয়া খারাপ, এমন যুক্তিও মাঝে মাঝে দেখানো হয়। শুধু তাই নয়, পাইকারি বাজারের সঙ্গে নেই খুচরা মূল্যের সামঞ্জস্যও। অথচ দুঃখের বিষয় বাজার থেকে সাধারণ ক্রেতা যে দামে পণ্য কিনছেন, উৎপাদক সেই দাম কল্পনাও করতে পারেন না। এর সুফল নিচ্ছেন এক শ্রেণির প্রতারক মধ্যস্বত্বভোগীরা। যারা সাধারণ ক্রেতাদের জিম্মি করছেন, জিম্মি করছে কৃষকদেরও। কিন্তু যারা নিজেদের সর্বোচ্চ শ্রম দিয়ে পণ্য উৎপাদন করছেন, সেই কৃষক বঞ্চিত হচ্ছেন ন্যায্যমূল্য থেকে। এক্ষেত্রে শুধু লাভবান হচ্ছেন একশ্রেণির ব্যবসায়ীরা। আর ঠকছেন কৃষক ও সাধারণ ক্রেতা। এমন ঘটনা আমাদের জন্য অবশ্য নতুন নয়। কয়েক মাস আগে পেঁয়াজের ইসু্য আমাদের সেটাই মনে করিয়ে দিচ্ছে।

শুধু একটি নির্দিষ্ট পণ্য নয়, মানুষের দৈনন্দিন চাহিদার প্রায় সব পণ্যের দামই বাড়ছে। কখনো কখনো তা হয়ে যাচ্ছে লাগামছাড়া। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারি বাজারে সব ধরনের সবজি কেজিতে গড়ে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়েছে। কয়েক দিনের ব্যবধানে পেঁয়াজ প্রতি কেজিতে বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা।

যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে খুচরা বাজারেও। এক্ষেত্রে অবশ্য বিক্রেতারা অজুহাত দেখাচ্ছেন বন্যাকে। তবে ক্রেতা মাত্রই জানেন, এটা শুধু দাম বৃদ্ধির অজুহাত। সবজির বাইরে আমাদের প্রধান খাদ্য ভাত। সেই ভাতের চালের দামও বাড়ছে কোনো কারণ ছাড়াই। এছাড়া নাভিশ্বাস উঠেছে ভোজ্য তেল, মসলা, ডালসহ নিত্যপণ্যের সবকিছুরই দাম বৃদ্ধিতে। এখন প্রায় প্রতি সপ্তাহের নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি যেন সবার কাছে সাধারণ ঘটনা। মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ ঘটনা হলেও বিপরীতে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়েনি। বর্তমান সরকারের উন্নয়নমুখী নানা উদ্যোগের ফলে আমাদের জীবনযাত্রার মান যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে ব্যয় ক্ষমতাও। এটা হয়েছে সময়ের চাহিদার কারণে। কিন্তু সেই চাহিদার সঙ্গে পালস্না দিয়ে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সমন্বয় হয়নি সেভাবে। এর পেছনে রয়েছে অনেকগুলো কারণ। প্রধান কারণ হলো- একশ্রেণির আমদানিকারক ও পাইকারি পর্যায়ের ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। যারা মূলত তাদের স্বার্থের জন্য বাজার কারসাজি করছে। জিম্মি করছে ক্রেতাকে। তবে এক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এর দায় এড়াতে পারে না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব এসব সিন্ডিকেট বন্ধ করা। কিন্তু মন্ত্রণালয় কতটুকু করতে পারছে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ।

বাস্তবতা হলো সরকারের ইতিবাচক কাজে মানুষের মধ্যে যেমন উচ্ছ্বাস রয়েছে তেমনি নিত্যপণ্যের বাজারের নিয়ন্ত্রণহীনতা মানুষকে ফেলেছে চরম অস্বস্তিতে। এখন এই অস্বস্তি সরকারকে দূর করতে হবে। আর সেই স্বস্তি আসতে পারে শুধু বাজারে সরকারের ইতিবাচক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই। অবশ্য এর জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। যারা বাজার সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত তাদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এই ঊর্ধ্বগতি রোধে এখন বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। বিশেষ করে সবার আগে প্রয়োজন সরকারের স্বদিচ্ছার বাস্তবায়ন। এরপর যে জিনিসটি প্রয়োজন তা হলো- পণ্যসামগ্রীর চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা। কারণ পণ্যের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য না থাকলে কখনো বাস্তবিক লক্ষ্য পূরণ হবে না। এর জন্য দেশের সবত্র কৃষি পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে। পাশাপাশি আমদানি ও রপ্তানির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বিশেষ করে উৎপাদন ব্যবস্থার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া পণ্যবাজারের ওপর সরকারের সজাগ দৃষ্টি প্রয়োজন। যাতে অসাধু ব্যবসায়ীরা তাদের ইচ্ছে মতো কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি করে দাম বৃদ্ধি করতে না পারে। পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির একটি বড় কারণ। বিভিন্ন এলাকা থেকে পণ্য দ্রব্য ঢাকা বা অন্যান্য জায়গায় যাওয়ার সময় চাঁদাবাজির ঘটনা যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। এসব অনিয়মের মধ্যে আঘাত আনতে হবে। চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। উৎপাদন উপকরণগুলোর সরবরাহ, যতটা সম্ভব প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ছেড়ে দেয়া প্রয়োজন। কারণ এক্ষেত্রে সর্বত্রই প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করা ছাড়া বাজার ব্যবস্থার সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। বিশেষ করে যখন উৎপাদক কৃষক শ্রেণি। যাদের কেন্দ্র করে কৃষিপণ্য উৎপাদিত হয়। দুঃখের বিষয় এসব ক্ষেত্রে সেই উৎপাদক শ্রেণিই সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হয়।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে যে, ব্যবসায়ী ও উৎপাদক শ্রেণি হচ্ছে অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। এদের মধ্যে যথাযথ সমন্নয় প্রয়োজন। বিশেষ করে উৎপাদক শ্রেণির মধ্যে আস্তা ফিরিয়ে আনা সবার আগে জরুরি। বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে, তারা যে পণ্য উৎপাদন করবেন তার সঠিক ও ন্যায্যমূল্য পাবেন। কোনো সিন্ডিকেটের কাছে তাদের প্রাপ্য মূল্য চলে যাবে না। থাকবেন না জিম্মি হয়ে। আরও একটি বিষয় খুবই জরুরি। সেটা হলো ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান। যা আমরা শুধু রমজান মাসেই বেশি দেখি। বাস্তবতা হলো ভেজাল খাদ্যের বিষয়ে যেমন অভিযান প্রয়োজন তেমনি অতিরিক্ত মজুত ও ইচ্ছে মতো মূল্যবৃদ্ধি রোধেও ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান এখন খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। এখন সরকারকে এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে সবার আগে।

আমদানির ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট একটি কমন বিষয়। অধিকাংশ সময়ে আমাদের দেশে মূলত রাজনৈতিক কারণে আমদানির অনুমতি মেলে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। রাজনৈতিক ব্যবসায়ীদের সংশ্লিষ্টতার কারণে সিন্ডিকেটগুলো বেশি মুনাফালোভী মানসিকতা সাধারণ মানুষকে কষ্ট দেয় এক্ষেত্রে। এখন ওই সিন্ডিকেটগুলো ভাঙার ব্যবস্থা করাই হচ্ছে সরকারের প্রথম ও প্রধান কাজ। কারণ এটা পরিষ্কার আমাদের দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে সিন্ডিকেটের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। তাই এসব অসাধু সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে। কোনো একটি নিদিষ্ট সময়ে অভিযান পরিচালনা না করে সারা বছরই অভিযান পরিচালনার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। তবেই আমরা হয়তো অসাধু ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেটের হাত থেকে মুক্তি পাব।

সাহাদাৎ রানা : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে