সোমবার, ০৯ জুন ২০২৫, ২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বাংলাদেশের কাগজশিল্প :ব্যবহার ও ভবিষ্যৎ

প্রাচীন বাংলার বিভিন্ন স্থানে, বিশেষত মুর্শিদাবাদ, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর ও টাঙ্গাইলে দেশীয় পদ্ধতিতে কাগজ প্রস্তুত করা হতো মেস্তা এবং পাটগাছ থেকে। কয়েক প্রকার কাগজ প্রচলিত ছিল, তার মধ্যে আফসানি ও তুলোট কাগজ উলেস্নখযোগ্য। তুলোট কথাটি সম্ভবত তুলা থেকে এসেছে। কারণ তুলার মন্ড থেকে এক সময় কাগজ তৈরি হতো। আফসানি বা জার আফসান কাগজ ছিল স্বর্ণ বা রৌপ্য চূর্ণমিশ্রিত কাগজ। রাজা-বাদশারা এ কাগজ ব্যবহার করতেন। একসময় পাটনা কাগজের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। তাকে বলা হতো পাটনাই কাগজ। উইলিয়াম কেরি যখন শ্রীরামপুর মিশনে ছাপাখানা স্থাপন করেন তখন তিনি প্রথমে পাটনাই কাগজ ব্যবহার করতেন। পরে শ্রীরামপুরে কাগজ তৈরির কারখানা স্থাপিত হলে সব গ্রন্থ সেখানকার কারখানায় প্রস্তুত কাগজে ছাপা হতো।
আরাফাত রহমান
  ২৩ মার্চ ২০২১, ০০:০০
বাংলাদেশের কাগজশিল্প :ব্যবহার ও ভবিষ্যৎ

আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে কাগজ একটি আবশ্যকীয় প্রয়োজনীয় উপকরণ। ধারণা করা হয়, দ্বিতীয় শতাব্দীতে চীনে আধুনিক কাগজের উদ্ভব হয়েছিল যদিও এর আগে কাগজ ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। কাগজের উদ্ভাবনকে প্রাচীন চীনের চারটি বিশাল উদ্ভাবনের অন্যতম একটি বিবেচনা করা হয়। প্রাচীন চীনে মন্ড দ্বারা তৈরি কাগজ দ্বিতীয় শতাব্দীর গোড়ার দিকে হান জাতির চাই লুন নামের একজন আবিষ্কার করেন। চীনে সিল্কের সাশ্রয়ী ও কার্যকর বিকল্প হিসেবে কাগজ ব্যবহার শুরু হয়। কাগজের প্রচলন চীন থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে মুসলিম বিশ্বের মাধ্যমে এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মধ্যযুগের ইউরোপে কাগজের উৎপাদন শুরু হয়।

সেখানে সর্বপ্রথম পানিচালিত কাগজ উৎপাদনের কাগজকল ও কলকব্জা আবিষ্কার ও নির্মাণ করা হয়। চিঠি, সংবাদপত্র ও বইয়ের মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদান শুরু হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী পরিবর্তন আসে এবং এর সাশ্রয়ী উপাদান হিসেবে কাগজ তৈরি করা ঊনবিংশ শতাব্দীতে নতুন শিল্পরূপে আবির্ভূত হয়। ১৮৪৪ সালে, কানাডিয়ান উদ্ভাবক চার্লস ফেনারটি এবং জার্মানি উদ্ভাবক এফজি কেলার যৌথভাবে কাগজ তৈরির মূল উপাদান হিসেবে কাঠের মন্ড তৈরি করার মেশিন ও প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেন। এটা ছিল ২০০০ বছরের পুরনো ও প্রচলিত কাগজ উৎপাদন প্রক্রিয়ার সময়ের শেষ ও নতুন পদ্ধতির মাধ্যমে নিউজপ্রিন্ট ও অন্যান্য কাগজ উৎপাদন কালের শুরু।

1

কাগজ শব্দটি 'পেপার' শব্দের পারিভাষিক প্রতিশব্দ। 'কাগজ' একটি ফারসি শব্দ। প্রাচীন মিশরের 'প্যাপিরাস' নামক লেখার বস্তুর গ্রিক নাম থেকে 'পেপার' শব্দটি এসেছে। প্যাপিরাস গাছের বাকল থেকে এই প্যাপিরাস তৈরি হতো। প্রাচীন গ্রিকে সাইপ্রাস পেপিরাস নামক উদ্ভিদ থেকে প্যাপিরাস শব্দটি এসেছে। প্যাপিরাস মোটা কাগজসদৃশ্য বস্তু যা প্যাপিরাস উদ্ভিদের কান্ডের মধ্যবর্তী নরম শাঁস দ্বারা প্রস্তত হতো। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে কাগজের প্রচলন হওয়ার আগেই প্রাচীন মিশরে ও ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় প্যাপিরাস লেখার কাজে ব্যবহার হতো। যদিও কাগজের ইংরেজি শব্দ 'পেপার' প্যাপিরাস শব্দ থেকে এসেছে কিন্তু এদের উৎপাদন পদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং বর্তমান কাগজের উন্নয়নও প্যাপিরাসের উন্নয়ন থেকে পৃথক। প্যাপিরাস হচ্ছে স্বাভাবিক উদ্ভিদকে স্তরে স্তরে বিন্যস্ত করা অন্যদিকে কাগজ উৎপাদন হয় তন্তু বা আঁশ থেকে যেখানে উদ্ভিদের অংশকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন করা হয়।

কাগজের বহুবিধ ও বহুমুখী ব্যবহার রয়েছে। লেখালেখির কাজে এবং ছাপানোতে কাগজের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হলেও মোড়ক তৈরি করার কাজেও কাগজ বহুল ব্যবহৃত বস্তু। অনেক পরিষ্কারক দ্রব্যে, বেশকিছু সংখ্যক কারখানায় এমনকি নির্মাণ কাজেও কাগজের ব্যবহার রয়েছে। ২০১১ সালে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের সহজলভ্য ও পরিবেশবান্ধব ধঞ্চে গাছের আঁশ দিয়ে কাগজ তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করে। এটি খুব সাশ্রয়ী পদ্ধতি। ধঞ্চে জমির উর্বরতা বাড়ায়। সাধারণ বায়ুচাপে ৬০ থেকে ৮০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় সম্পূর্ণ সালফার ও ক্লোরিনমুক্ত পদ্ধতিতে এই কাগজ তৈরি করা যায়। পরিবেশবান্ধব ক্লোরিন ডাইঅক্সাইড ব্যবহার করে একই সঙ্গে ডাইজেসন ও বিস্নচিংয়ের কাজ সম্পন্ন হয় তাই এতে জ্বালানি খরচও খুব কম। এছাড়া কলকারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া থেকে কাগজ তৈরির কাঁচামাল প্রিসিপিটেটেড ক্যালসিয়াম কার্বোনেট তৈরি করা যায়।

প্রাচীন বাংলার বিভিন্ন স্থানে, বিশেষত মুর্শিদাবাদ, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর ও টাঙ্গাইলে দেশীয় পদ্ধতিতে কাগজ প্রস্তুত করা হতো মেস্তা এবং পাটগাছ থেকে। কয়েক প্রকার কাগজ প্রচলিত ছিল, তার মধ্যে আফসানি ও তুলোট কাগজ উলেস্নখযোগ্য। তুলোট কথাটি সম্ভবত তুলা থেকে এসেছে। কারণ তুলার মন্ড থেকে একসময় কাগজ তৈরি হতো। আফসানি বা জার আফসান কাগজ ছিল স্বর্ণ বা রৌপ্য চূর্ণমিশ্রিত কাগজ। রাজা-বাদশারা এ কাগজ ব্যবহার করতেন। এক সময় পাটনা কাগজের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। তাকে বলা হতো পাটনাই কাগজ। উইলিয়াম কেরি যখন শ্রীরামপুর মিশনে ছাপাখানা স্থাপন করেন তখন তিনি প্রথমে পাটনাই কাগজ ব্যবহার করতেন। পরে শ্রীরামপুরে কাগজ তৈরির কারখানা স্থাপিত হলে সব গ্রন্থ সেখানকার কারখানায় প্রস্তুত কাগজে ছাপা হতো।

সে সময় আমাদের দেশে তৈরি কাগজ শক্ত বা ক্যালেন্ডার করার জন্য ভাতের মাড় ব্যবহৃত হতো। এতে কাগজে কীটপতঙ্গের সংক্রমণ ঘটত। কেরী সাহেব ভাতের মাড় ব্যবহার না করে অন্য উপায়ে কাগজ শক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। ১৮২০ সালে কাগজের মন্ড তৈরির জন্য শ্রীরামপুরেই সর্বপ্রথম বাষ্পচালিত ইঞ্জিন ব্যবহৃত হয়েছিল। ব্রিটিশ ভারতে বেশ কয়েকটি উন্নতমানের কাগজকলের প্রতিষ্ঠা হয়, যেগুলোর মধ্যে টিটাগড়ের কাগজকল ছিল প্রসিদ্ধ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর চট্টগ্রামে কর্ণফুলি নদীর তীরে সরকারি উদ্যোগে কর্ণফুলি পেপার মিল, খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল ও পাবনায় নর্থ বেঙ্গল পেপার মিল স্থাপন করা হয়। এসব কাগজকলে ব্যবহার হতো যথাক্রমে বাঁশ, সুন্দরবনের গেওয়া কাঠ ও আখের ছোবড়া। সিলেটে প্রতিষ্ঠিত মন্ড মিলে ব্যবহার হতো ঘাস। পাটের আঁশ ব্যবহারের চেষ্টা করা হলেও তা পদ্ধতিগত কারণে ব্যর্থ হয়।

বর্তমানে বাংলাদেশের আধুনিক কাগজ তৈরির কারখানায় প্রধানত আমদানিকৃত রাসায়নিক মন্ড ব্যবহার করে উন্নতমানের কাগজ তৈরি করা হয়। আবার এখানে পুরাতন কাগজকে আবার মন্ডে রূপান্তর করে কাগজ তৈরির ব্যবস্থাও রয়েছে। এছাড়া পাটের কাটিং ও শলা মন্ড তৈরির কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব কাগজকলে বছরে প্রায় ৫ লাখ ৫০ হাজার টন কাগজ উৎপন্ন হয়। সরকারি ও বেসরকারি কাগজের কলগুলো মিলে বাংলাদেশের বর্তমান চাহিদার মোট ৬০% পূরণ করতে পারে। বাকী ৪০% কাগজ বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। কাগজের প্রকৃতি, মান ও গুণের দিক থেকে কাগজকে কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে যেমন নিউজপ্রিন্ট, বুক পেপার বা প্রিন্টিং পেপার, লেজার কাগজ, কভার ও কার্ড বোর্ড।

নিউজপ্রিন্ট কাঠের মন্ড থেকেই তৈরি হয়ে থাকে। সাধারণত পাইন, দেবদারু, হেমলক, ফার প্রভৃতি গাছের কাঠ থেকে এ মন্ড তৈরি হয়। আমাদের দেশে প্রধানত সুন্দরবনের গেওয়া কাঠ থেকে নিউজপ্রিন্টের মন্ড তৈরি হয়। বু্যরো অব স্ট্যাটিসটিকস (বিবিএস) কাগজকে চারটি প্রধান শ্রেণিতে ভাগ করেছে, যেমন লেখার কাগজ, ছাপার কাগজ, নিউজপ্রিন্ট এবং প্যাকেজিং জাতীয় কাগজ। বিবিএসের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে ১৫% লেখার কাগজ, ৩৫% ছাপার কাগজ, ৪০% নিউজপ্রিন্ট এবং ১০% প্যাকেজিংয়ের কাগজ উৎপাদিত হয়। তবে মন্ড, কাগজ ও কাগজকেন্দ্রিক দ্রব্যাদি উৎপাদনের এ হার স্থানীয় চাহিদার তুলনায় কম। বর্তমানে বাংলাদেশে আমদানিকৃত মন্ড, বর্জ্য কাগজ, লেখার কাগজ, কাগজের বোর্ড ইত্যাদির ব্যয় বার্ষিক প্রায় ৪ বিলিয়ন টাকা।

নিউজপ্রিন্ট সবচেয়ে সস্তা এবং কম টেকসই। দীর্ঘকাল সংরক্ষণের জন্য কোনো কিছু এ কাগজে ছাপানো সঠিক নয়। কিছুদিন পর এর রঙ লালচে হয়ে যায় এবং এটি ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। নিউজপ্রিন্ট বা কাঠের মন্ডে রেজিনের পরিমাণ বেশি থাকে যা আলো-বাতাসের সংস্পর্শে অক্সিডাইজড হয়। ফলে যত দিন যায় কাগজ তত লালচে হয় ও ভঙ্গুরতা লাভ করে। যে কাগজ যত অস্বচ্ছ, মুদ্রণের জন্য সে কাগজ তত ভালো। স্বচ্ছতা কমিয়ে আনার জন্য কাগজকে পুরুভাবে তৈরি করা হয়। এরপর কাগজকে যখন খুব ভালোভাবে মসৃণ বা ক্যালেন্ডার করা হয় তখন তা আর্ট কাগজ বা কোটেড কাগজে উন্নীত হয়।

সুইডেনে প্রাকৃতিক সেলুলোজ ন্যানোফাইবার থেকে তৈরি ন্যানোপেপার নামের একটি কাগজ উদ্ভাবন করা হয়েছে, যা স্টিলের মতোই মজবুত। স্টকহোমের সুইডিশ রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির মতে, কাগজ তৈরির জন্য কাঠ থেকে মন্ড তৈরির সময় এর ভেতরের প্রাকৃতিক আঁশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দুর্বল হয়ে পড়ে। এই আঁশগুলো অক্ষত অবস্থায় সংগ্রহ করার একটি প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করা হয়েছে। ন্যানোপেপারের সেলুলোজ ফাইবারগুলো অক্ষত এবং নেটওয়ার্কের মতো সজ্জিত অবস্থায় থাকে তাই এটি এত শক্ত। ফাইবারগুলো একটির সঙ্গে অন্যটির কঠিন বন্ধন তৈরি করে রাখে। প্রচলিত কাগজের আঁশের চেয়ে এই সেলুলোজ ফাইবার অনেক ছোট। পরীক্ষায় দেখা গেছে, এর চাপ সইবার ক্ষমতা অনেক বেশি।

কাগজ উৎপাদন এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে পরিবেশের উপর একটি প্রতিকূল প্রভাব রয়েছে। বিগত ৪০ বছরে বিশ্বব্যাপী কাগজের ব্যবহার ৪০০% বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বন উজাড় হওয়ার ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কাটাগাছের ৩৫% কাগজ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। বেশির ভাগ কাগজ উৎপাদন সংস্থাগুলো বনকে পুনরায় সাজানোর জন্য গাছ লাগায়। কাগজ বর্জ্য প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত মোট বর্জ্যের ৪০% যা কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই প্রতি বছর ৭১.৬ মিলিয়ন টন পেপার বর্জ্য যোগ করে। উড পাল্প যা কাগজ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়, ক্লোরিনযুক্ত ডাইঅক্সিনসহ প্রচুর পরিমাণে ক্লোরিনযুক্ত জৈব যৌগ তৈরি করে এবং পরিবেশে ছেড়ে দেয়।

ডাইঅক্সিন পরিবেশদূষণকারী হিসাবে স্বীকৃত। ডাইঅক্সিনগুলো অত্যন্ত বিষাক্ত এবং মানুষের স্বাস্থ্যের উপর প্রজনন, বিকাশ, ইমিউনিটি এবং হরমোনজনিত সমস্যা সৃষ্টি করে। এগুলো কার্সিনোজেনিক হিসাবে পরিচিত। কিছু প্রতিষ্ঠান পস্নাস্টিকের প্যাকেজিংয়ের জন্য একটি নতুন ও উলেস্নখযোগ্যভাবে আরও পরিবেশবান্ধব বিকল্প ব্যবহার শুরু করেছে। কাগজ থেকে তৈরি এবং বাণিজ্যিকভাবে পেপার ফোম হিসাবে পরিচিত নতুন প্যাকেজিংয়ের পস্নাস্টিকের প্যাকেজিংয়ের মতো কিছু বর্ধিত যান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে তবে এটি বায়োডিগ্রেডেবল এবং সাধারণ কাগজের সাহায্যে পুনর্ব্যবহারযোগ্য।

আরাফাত রহমান : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে