সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫, ২ আষাঢ় ১৪৩২

গণপরিবহণে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন হোক

সম্ভবত বাংলাদেশই বিশ্বের একমাত্র দেশ যে দেশে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার তোয়াক্কা না করে গণপরিবহণ মালিক/কোম্পানির বেআইনিভাবে নির্ধারিত অতিরিক্ত ভাড়ায় গণপরিবহণ পরিচালনা করা যায়। যদিও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গণপরিবহণের ভাড়া নির্ধারণ, নির্ধারিত ভাড়ায় গণপরিবহণ চলা নিশ্চিতের জন্য সরকারি কর্তৃপক্ষ রয়েছে।
জহির চৌধুরী
  ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০
গণপরিবহণে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন হোক
গণপরিবহণে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন হোক

সড়ক পরিবহণ আইনের বিধিমালা প্রণয়ন না করে ভবিষ্যতে বাস-মিনিবাসসহ সব ধরনের গণপরিবহণের ভাড়া বাড়ানোর ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞাসহ একগুচ্ছ নির্দেশনা চেয়ে একজন আইনজীবী উচ্চ আদালতে একটি রিট করেছেন সম্প্রতি। গত ২৩ জানুয়ারি উচ্চ আদালতের একটি বেঞ্চে সেই রিটের প্রাথমিক শুনানি হয়েছে। শুনানির পর দেওয়া আদেশে সড়ক পরিবহণ আইন অনুযায়ী সারাদেশে বাস-মিনিবাসের স্টপেজ ও দৃশ্যমান জনসমাগমস্থলে গণপরিবহণের ভাড়ার তালিকা টাঙানো এবং ইলেক্ট্রনিক বিলবোর্ডে সেই তালিকা প্রদর্শন, বাস-মিনিবাসসহ গণপরিবহণে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত। আদেশে উচ্চ আদালতের দেওয়া নির্দেশনা এক মাসের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে।

সম্ভবত বাংলাদেশই বিশ্বের একমাত্র দেশ যে দেশে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার তোয়াক্কা না করে গণপরিবহণ মালিক/কোম্পানির বেআইনিভাবে নির্ধারিত অতিরিক্ত ভাড়ায় গণপরিবহণ পরিচালনা করা যায়। যদিও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গণপরিবহণের ভাড়া নির্ধারণ, নির্ধারিত ভাড়ায় গণপরিবহণ চলা নিশ্চিতের জন্য সরকারি কর্তৃপক্ষ রয়েছে।

1

\হবাংলাদেশে গণপরিবহণের ভাড়া নির্ধারণ এবং নির্ধারিত ভাড়ায় গণপরিবহণ পরিচালিত হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য যে সরকারি সংস্থাটি রয়েছে তাকে ইংরেজিতে 'বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)' বাংলায় 'বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ' বলা হয়। এক-দেড় দশক আগেও এ সংস্থার নির্ধারিত ভাড়া দেশের বিভিন্ন রুটের গণপরিবহণে ভাড়া নেওয়া হতো। একপর্যায় থেকে এ সংস্থার নির্ধারিত ভাড়া অগ্রাহ্য করে গণপরিবহণ মালিক/কোম্পানির বেআইনিভাবে নির্ধারিত ভাড়া আদায় শুরু হয় গণপরিবহণে। গণপরিবহণ মালিক সমিতি/কোম্পানির ধার্যকৃত ভাড়া আদায় শুরুর পর থেকে যাত্রীদের উপর অতিরিক্ত ভাড়ার জুলুম চেপেছে, নিরুপায় হয়ে যাত্রীরা প্রকৃত ভাড়ার কয়েকগুণ বেশি দিয়ে গণপরিবহণে চলাচল করা ছাড়া গত্যন্তর থাকছে না। সরকার নির্ধারিত ভাড়া অগ্রাহ্য করে যাত্রীদের কাছ থেকে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া আদায় প্রশাসনের নাকের ডগায় হলেও বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায় না।

দেশের গণপরিবহণে নৈরাজ্য-অরাজকতা, অতিরিক্ত ভাড়ার জুলুমসহ যাত্রীদের সঙ্গে গণপরিবহণ শ্রমিকদের দুর্ব্যবহার বন্ধের দাবি বহুদিনের। এ সব বন্ধের দাবিতে ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে এলে সরকার বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ আইন-২০১৮ প্রণয়ন করে। এ আইনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ আইন ২০১৮-এর 'গণপরিবহণের আসনসংখ্যা ও ভাড়া নির্ধারণ'সংক্রান্ত ৩৪(৩) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো গণপরিবহণ সহজে দৃশ্যমান স্থানে ভাড়ার চার্ট প্রদর্শন ছাড়া যাত্রী পরিবহণ করিতে পারিবে না।' ৩৪(৪) ধারায় বলা হয়েছে, 'কোনো গণপরিবহণের মালিক, চালক, কন্ডাক্টর, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান উপধারা(২)-এর অধীন নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া দাবি বা আদায় করিতে পারিবে না।' আইন করেও গণপরিবহণে সরকার নির্ধারিত ভাড়া কার্যকর, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, বিরাজমান নৈরাজ্য-অরাজকতা বন্ধ করা যায়নি। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে, আদালত গণপরিবহণে সরকার নির্ধারিত ভাড়া আদায় নিশ্চিতের জন্য কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। আদালতের নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন কতটা হবে তা নিয়ে সংশয়মুক্ত থাকা যায় না। কারণ, জনস্বার্থে দেওয়া আদালতের নির্দেশনা এ দেশে বাস্তবায়নের নজির তেমন একটা নেই।

গণপরিবহণে অতিরিক্ত ভাড়ার জুলুম, বিরাজমান নৈরাজ্য-অরাজকতা বন্ধ করা দীর্ঘদিনের জনদাবি। এ জনদাবি বরাবরই অপূরণীয় রয়ে গেছে। সাধারণ মানুষ অতিরিক্ত ভাড়ার জুলুমে নিষ্পেষিত হয়েও প্রতিকার না পাওয়ায় হতাশ হয়ে অতিরিক্ত ভাড়ার জুলুমকে কপালের লিখন ধরে নিয়েছে। সরকারের আইন-বিধি-বিধান অমান্য করে গণপরিবহণ কর্তৃপক্ষগুলো সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার কয়েকগুণ নির্ধারণ, যাত্রীদের কাছ থেকে সে ভাড়া আদায় করেও পার পেয়ে যাওয়া, জবাবদিহি করতে না হওয়া দুনিয়ায় নজিরবিহীন। গণপরিবহণ মালিক-শ্রমিক সংগঠন ও গণপরিবহণ কোম্পানিগুলোর কর্মকান্ডে প্রতীয়মান হয় গণপরিবহণ খাতে সরকারের আইন-হুকুম-কর্তৃত্ব কার্যত অচল। সম্প্রতি সরকার ডিজেলের মূল্য ২৩ শতাংশ বাড়িয়েছে। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সরকার গণপরিবহণের ভাড়া বাড়িয়েছে ২৭ শতাংশ। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির হারের চেয়ে ৪ শতাংশ বেশি ভাড়া বাড়িয়েও গণপরিবহণ মালিক/কোম্পানিগুলোর খায়েশ মেটানো যায়নি। বরাবরের মতো এবারও সরকার নির্ধারিত ভাড়া কার্যকর করেনি গণপরিবহণ মালিকরা। টাউন সার্ভিস, আঞ্চলিক রুটসহ আন্তঃজেলায় চলাচলকারী গণপরিবহণগুলো বরাবরের মতোই সরকার নির্ধারিত ভাড়ার তোয়াক্কা না করে গণপরিবহণ মালিক সমিতি/কোম্পানির বেআইনিভাবে নির্ধারিত অতিরিক্ত ভাড়া আদায় অব্যাহত রেখেছে। গণপরিবহণের ভাড়া সরকারিভাবে বৃদ্ধির পর কয়েকদিন বিআরটিএ রাস্তায় মোবাইল কোর্ট বসিয়ে সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় ও নিয়মে গণপরিবহণ চালানোর চেষ্টা করেছে। মোবাইল কোর্টের কার্যক্রম চলাকালে কিছু কিছু গণপরিবহণ বাদে বেশির ভাগ গণপরিবহণ সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় ও নিয়মে চলাচল করতে দেখা গেছে। মোবাইল কোর্টের কার্যক্রম শিথিল/বন্ধ হওয়া মাত্রই প্রায় সব গণপরিবহণে আগের মতো অতিরিক্ত ভাড়া আদায় চলছে। ওয়েবিল/চেকারের অজুহাত দেখিয়ে কোনো কোনো গণপরিবহণ এখনো এক কিলোমিটারের কম দূরত্বে ১৫ থেকে ২০ টাকা ভাড়া আদায় অব্যাহত রেখেছে। গণপরিবহণে ভাড়া নৈরাজ্য কবে বন্ধ হবে, কে বন্ধ করবে, আদৌ বন্ধ হবে কিনা তা যাত্রীদের জানা নেই।

গণপরিবহণে যাত্রী জিম্মি করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়সহ বিদ্যমান অনিয়ম বন্ধ আইনের কঠোর প্রয়োগ ছাড়া সম্ভব নয় তা বলা প্রয়োজন পড়ে না। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়সহ নানা অনিয়মের অভিযোগে বিআরটিএ গত ডিসেম্বরে ২৫টি বাস কোম্পানির রুট পারমিট বাতিলের প্রস্তাব পাঠিয়েছে 'রিজওয়ানাল ট্রান্সপোর্ট কমিটি'র (আরটিসি) কাছে। এর পরও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় থেকে বিরত হয়নি গণপরিবহণগুলো, 'আরটিসি'ও আজতক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। পরিবহণ মালিক/কোম্পানি সরকার নির্ধারিত ভাড়া অগ্রাহ্য করে, 'ড্যাম কেয়ার'ভাব দেখিয়ে বেআইনিভাবে অতিরিক্ত ভাড়া প্রশাসনের নাকের ডগায় যাত্রীর ওপর চাপানো প্রকারান্তরে প্রকাশ্যে ডাকাতি। এ ডাকাতি চলতে দেওয়া যায় না। গণপরিবহণ সেক্টরে রাষ্ট্রের আইন কেন চলবে না? গণপরিবহণ মালিক-শ্রমিকদের ঔদ্ধত্যের কাছে রাষ্ট্রের আইন পরাজিতই হচ্ছে, এটা হতে পারে না। রাষ্ট্রের আইনের কাস্টডিয়ান আদালত। সাধারণ মানুষের শেষ ভরসার স্থল এবং রাষ্ট্রের আইনের কাস্টডিয়ান আদালত বেআইনিভাবে আদায় করা অতিরিক্ত ভাড়ার জুলুম অবসানে এগিয়ে আসায় সবাই আশান্বিত। সবাই আশা করছে এবার গণপরিবহণে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের জুলুম থেকে রেহাই মিলবে, গণপরিবহণ সেক্টর সরকারের আইন-বিধি-বিধান অনুযায়ী চলবে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মান্যের বাধ্য-বাধকতা গণপরিবহণে অতিরিক্ত ভাড়ার জুলুম, নৈরাজ্য-অরাজকতা, যাত্রী হয়রানি বন্ধে উচ্চ আদালতের দেওয়া নির্দেশনা দ্রম্নত বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক করেছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন দ্রম্নত হবে আশা করে সবাই।

জহির চৌধুরী : কলাম লেখক

পযড়ফিযঁৎুুধযরৎ@ুধযড়ড়.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে