সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

ইসলামী ব্যাংকের ৪০ বছর :প্রাপ্তি ও সম্ভাবনা

বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল কল্যাণমুখী আর্থিক সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে। আজ ইসলামী ব্যাংকিং তার পথ চলার ৪০ বছর পূর্ণ করেছে। এই পথ চলায় ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থা সুদমুক্ত ও কল্যাণধর্মী ব্যাংক ব্যবস্থাকে একটি বাস্তবমুখী ও সফল আর্থসামাজিক উদ্যোগ হিসেবে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে।
আশরাফুল ইসলাম
  ৩১ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

দেশে শিল্পায়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান ভূমিকা রাখতে পারে তা ৮০ দশকের আগে কল্পনাও করা যেত না। কিন্তু এ কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথমবারের মতো প্রতিষ্ঠিত হয় সুদমক্ত নতুন ধারার একটি ব্যাংক- ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। শুরুটা হয়েছিল ১৯৮৩ সালে। তবে এর আগে থেকেই ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল ১৯৭৪ সালে দ্বিতীয় ওআইসি সম্মেলনে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যোগদানের মাধ্যমে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় মুসলিম দেশসমূহের আন্তর্জাতিক ইসলামিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার। সে বছর জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ওআইসি দেশসমূহের অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু সরকারের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আইডিবি সনদ স্বাক্ষর করেন।

১৯৮৩ সালে সেই যে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো যার অনুসরণ করে আজ পূর্ণাঙ্গ রূপ নিয়েছে সুদমুক্ত তিন ডজন পূর্ণাঙ্গ ও আংশিক ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। গত ৪০ বছরে দেশের ইসলামী ব্যাংকিং ইতিহাসে ইসলামী ব্যাংকের অনুসরণ করেই ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সঙ্গে প্রচলিত ১১টি ব্যাংক তাদের ইসলামী ব্যাংকের শাখা স্থাপন করে ইসলামী ব্যাংকিং করছে। পাশাপাশি আরও ১৪টি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং উইনডোর মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকিং প্রসার ঘটিয়েছে।

গত ৪০ বছরে বিখ্যাত মুসলিম মনীষী ও অর্থনীতিবিদগণের দীর্ঘ গবেষণার মধ্য দিয়ে ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থা বাস্তবে অস্তিত্ব লাভ করে। মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে এ ব্যাংক ব্যবস্থা বিশ্ব অর্থনীতি ও ব্যাংকিং অঙ্গনে গৌরবময় অবস্থান তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছে। ইতোমধ্যে এটি 'বিগত কয়েক শতকের মধ্যে মুসলিম উম্মাহর শ্রেষ্ঠ অর্জন' বলে স্বীকৃত হয়েছে।

দেশের ব্যাংকিং খাতের মধ্যে ইসলামী ব্যাংকিং সিস্টেমের অবদান দিন দিন বেড়ে চলছে। বর্তমানে দেশে মোট ২১৩৯টি ইসলামী ব্যাংকিং শাখা ও উইন্ডোতে মোট ৪৯,৪৩৩ জন কর্মী রয়েছে। আমানতের অবস্থানের দিকে তাকালে দেখা যায়, বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের মোট আমানত প্রায় ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা- যা দেশের ব্যাকিং খাতের মোট আমানতের প্রায় ২৬ শতাংশ। আর বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ৪ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি- যা দেশের ব্যাকিং খাতের মোট বিনিয়োগের প্রায় ৩০ শতাংশ।

এদিকে রেমিট্যান্স আহরণের দিক থেকে বরাবরই শীর্ষে থাকে ইসলামী ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ডিসেম্বর ২০২২ এর শেষে ইসলামী ব্যাংকসমূহের আহরিত মোট রেমিট্যান্সের পরিমাণ ২৫৬.৯১ বিলিয়ন টাকা- যা দেশের মোট রেমিট্যান্সের প্রায় ৫৫ শতাংশ। এর মধ্যে কেবল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের মাধ্যমেই গত ৪০ বছরে দেশে প্রবাসী রেমিট্যান্স এসেছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। ২০২২ সালে দেশের মোট রেমিট্যান্সের ২২ শতাংশই এসেছে এ ব্যাংকের মাধ্যমে। প্রবাসীদের অর্থ প্রেরণ সহজ করার জন্য বিভিন্ন দেশে ব্যাংকটির প্রতিনিধি কর্মরত রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন দেশে ৬ শতাধিক ব্যাংক ও এক্সচেঞ্জ হাউসের সঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের রেমিট্যান্স অ্যারেঞ্জমেন্ট রয়েছে। বৈদেশিক বাণিজ্য ও রেমিট্যান্স আহরণের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকগুলো দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুতও একটি শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে এসেছে। বিগত ৪০ বছরে এসব ব্যাংক সংগৃহীত রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে দেশের রিজার্ভে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার যোগ করেছে। শুধু ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডই এ পর্যন্ত দেশের রিজার্ভে ১২ বিলিয়ন ডলার যোগ করেছে।

দেশের শিল্পায়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ইসলামী অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। দেশের হাজার হাজার শিল্পকারখানা ইসলামী ব্যাংকগুলোর অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে। গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল, স্পিনিং মিল, সুতা উৎপাদন, স্টিল রি-রোলিং, লোহা ও ইস্পাত শিল্পসহ বিভিন্ন শিল্প খাতে ইসলামী ব্যাংকগুলোর উলেস্নখযোগ্য বিনিয়োগ রয়েছে। ডিসেম্বর ২০২২-এর শেষে ইসলামী ব্যাংকসমূহের মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৪ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি- যা দেশের ব্যাংকিং খাতের মোট বিনিয়োগের প্রায় ৩০ শতাংশ। এর মধ্যে শিল্পে বিনিয়োগের মাধ্যমে ৮৫ লাখ মানুষের সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে ইসলামী ব্যাংক। শুধু হালকা ও ভারী শিল্পেই নয়, ইসলামী ব্যাংক সর্বোচ্চ এসএমই বিনিয়োগকারী ব্যাংক। এ ব্যাংকের অর্থায়নে ৬ হাজারের বেশি শিল্পকারখানা পরিচালিত হচ্ছে। আর আবাসন খাতে বিনিয়োগের দিক থেকেও সবার আগে রয়েছে ব্যাংকটি। এ পর্যন্ত ৪ লাখ পরিবারকে আবাসনের ব্যবস্থা করা হছে।

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের হাত ধরেই দেশে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে ১৯৯৫ সালে পলস্নী উন্নয়ন প্রকল্প (আরডিএস) চালু হয়। আর একে অনুসরণ করে অন্য ইসলামী ব্যাংকগুলো এ খাতে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ করে। এতে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি। যার প্রায় ৯০ শতাংশই নারী। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, শুধু ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডই ৩১ হাজার গ্রামে বিস্তৃত এ কার্যক্রমে প্রকল্পের ১৬ লাখ সদস্যের মধ্যে এ পর্যন্ত ৪৪ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ বিতরণ করেছে।

শুরুর দিকে ম্যানুয়ালি হিসাবনিকেশ সম্পন্ন করা হতো। তখন আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া ছিল না কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির সমারোহ ঘটেছে দেশের ব্যাংকিং খাতে। আর এ আধুনিক প্রযুক্তি থেকে পিছিয়ে নেই দেশের ইসলামী ব্যাংকগুলোর। বরং সেদিক থেকে ইসলামী ব্যাংকগুলোতেই সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সমারোহ দেখা যায়। ইসলামী ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, প্রায় ২ কোটি গ্রাহকের আস্থার ব্যাংক হিসেবে ইসলামী ব্যাংক দেশব্যাপী সাড়ে ৬ হাজার ইউনিটে তাদের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা দিয়ে আসছে। সর্বোচ্চ আমানত নিয়ে এখন ইসলামী ব্যাংক দেশের শীর্ষে অবস্থান করছে। রেমিট্যান্সের দিকে তাকালেও দেখা যাবে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আসে।

ইসলামী ব্যাংকসমূহ বিগত বছরগুলোতে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যোগ করেছে উলেস্নখযোগ্য পরিমাণ অর্থ- যা জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালীকরণে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। শুধু ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডই বিগত ৪০ বছরে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যোগ করেছে ২০ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা। এটি দেশের অন্যতম শীর্ষ এবং দেশীয় ব্যাংক ও আর্থিক খাতের মধ্যে সর্বোচ্চ করদাতা প্রতিষ্ঠান।

আর এ কারণেই এক যুগ ধরে বিশ্বসেরা ১ হাজার ব্যাংকের তালিকায় বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক। সম্প্রতি এ ব্যাংক বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী ইসলামী রিটেইল ব্যাংক এবং বাংলাদেশরে সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যাংক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচি (সিএসআর)-এর মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকসমূহ একটি মানবিক মূল্যবোধে বিকশিত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছে। ইসলামী ব্যাংকসমূহ করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য, দাতব্য প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন খাতে ব্যয় করেছে ২.২০ বিলিয়ন টাকা। শুধু ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডই এ পর্যন্ত ২ কোটি মানুষের মাঝে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকারও বেশি অর্থ ব্যয় করেছে।

বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল কল্যাণমুখী আর্থিক সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে। আজ ইসলামী ব্যাংকিং তার পথ চলার ৪০ বছর পূর্ণ করেছে। এই পথ চলায় ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থা সুদমুক্ত ও কল্যাণধর্মী ব্যাংক ব্যবস্থাকে একটি বাস্তবমুখী ও সফল আর্থসামাজিক উদ্যোগ হিসেবে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। এভাবেই আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক হয়ে ইসলামী ব্যাংক দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আর সম্মিলিত শক্তিতে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রা।

আশরাফুল ইসলাম :কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে