বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১

সোনালি আঁশ কি রুপালি ইতিহাস হয়েই থাকবে?

জিনিয়া ফেরদৌস জুঁই শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
  ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
সোনালি আঁশ কি রুপালি ইতিহাস হয়েই থাকবে?

পৃথিবীতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আঁশ ফসল হিসেবে তুলার পর পাটের অবস্থান। বাংলাদেশের পাট চাষের ইতিহাস প্রাচীন। ১৯৪৭ পূর্ববর্তী সময় বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানিপণ্য ছিল পাট আর এর বাজার ছিল কলকাতা। পূর্ব বাংলার পাটের ওপর নির্ভর করে কলকাতায় গড়ে উঠেছিল অসংখ্য পাটমিল। বাংলা বিভক্ত হওয়ায় প্রথমবারের মতো বাংলার পাটশিল্প হুমকির মুখে পড়ে। আশির দশকে পলিথিনের ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে পাটের ব্যবহার কমে। কিন্তু বর্তমানে পরিবেশবান্ধব পণ্যের বিশ্বব্যাপী চাহিদা বাড়ায় বাংলাদেশের পাটশিল্পের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।

রাসায়নিক সার, কীটনাশক ব্যতীত চাষ হওয়া পাট বাংলাদেশের গৌরব। বর্ষজীবী এই ফসল যেমন- সেচ ছাড়াই চাষ সম্ভব। মাটির গভীর থেকে খাদ্য গ্রহণ করার দ্বারা তা মাটির উর্বরতাও বজায় রাখে। পাট দড়ি, বস্তা, ব্যাগ, জ্বালানি, প্রসাধনী, চালের ছাউনি, বাঁশ কাঠের বিকল্পসহ নানা কাজে ব্যবহৃত হয়। পাটের জিন্স ফ্যাশন জগতের নতুন সংযোজন। পরিবেশবান্ধব এত উৎকৃষ্ট পাট পৃথিবীর অন্য কোথাও উৎপন্ন হয় না। ভারত, চীন ও বাংলাদেশেই পুরো বিশ্বের পাট উৎপাদিত হয়। ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী, শীর্ষ দশ পাট উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়, কিন্তু শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। পাট অধিদপ্তরের তথ্য মতে, জিডিপিতে এই খাতের অবদান ২.৮%।

বর্তমানে বৈশ্বিক জলবায়ুর জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হলো পস্নাস্টিক, পলিথিনের যথেচ্ছ ব্যবহার। মাটি, পানি, বায়ুদূষণের জন্য দায়ী এই পলিথিনের সবচেয়ে কার্যকরী বিকল্প হতে পারে পাট। এ লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট উচ্চ ফলনশীল জাত, নতুন নতুন পাটপণ্য ও পাটজাত টেক্সটাইল পণ্য উৎপাদন- এই তিনটি ক্ষেত্রে গবেষণা করে আসছে। সম্প্রতি পাটবর্জ্য থেকে জুট পলিমার আবিষ্কার করেছেন ড. মোবারক আহমেদ খান, যা 'সোনালি ব্যাগ' নামেও পরিচিতি লাভ করেছে। এমন গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা ব্যতীত জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এর উপকারিতা পাওয়া সম্ভব নয়। এর পূর্বে ২০১০ সালে ড. মাকসুদুল আলম পাটের জিনোম অনুক্রম আবিষ্কার করেন, যা কাজে লাগিয়ে পাটশিল্পকে আরও সমৃদ্ধ করা যেত। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো- দেশের সব সরকারি পাটমিল বন্ধ করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় পাটমিল আদমজী জুট মিলস বিশ্বব্যাংক কারসাজি করে বন্ধ করে ২০০২ সালে। অন্যদিকে ভারত বিশ্বব্যাংকের লোনে নিজ দেশে পাটমিল স্থাপন করল এবং বাংলাদেশের সব বায়ার ভারতমুখী হয়ে গেল। বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ২২টি পাটকল ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত আট মাসে ৩৯৫ কোটি টাকা লোকসান করেছে। অথচ বেসরকারি খাতের অনেক পাটকল মুনাফা করছে। মূলত ব্যাপক দুর্নীতি, মিলগুলো সংস্কারবিহীন রাখা ও সময়মতো পাট ক্রয় না করায় সরকারি মিলগুলো লোকসানের সম্মুখীন হয়েছে।

পাটের তন্তু এত বেশি ব্যবহার উপযোগী যে, যে কোনো প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম তন্তু দ্বারা তা মিশ্রণ করা সম্ভব। পলিথিনের সঙ্গে পাটের সেলুলোজ মিশিয়ে পলিথিনের পাচ্যতার হার বৃদ্ধি করা সম্ভব। এমনকি কেবল পাট দিয়েই তো পলিথিন বানানোর প্রযুক্তি আমাদের কাছে আছে। এখন শুধু দরকার, এই শিল্প বিকাশে স্বয়ংক্রিয় মেশিনের ব্যবস্থা করা। ড. মোবারক আহমেদের সোনালি ব্যাগ তৈরির কারখানা পর্যবেক্ষণের সময় দেখা যায়, সেখানে পলিথিন নির্দিষ্ট আকার দেওয়ার কাজ করা হচ্ছে হাতে হাতে, যার কারণে পর্যাপ্ত উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। এসব ক্ষেত্রে যদি সরকারের দৃষ্টি না পড়ে, তাহলে পাটশিল্পের সামগ্রিক উন্নতি অসম্ভব।

বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পাট রপ্তানিকারক দেশ হওয়া সত্ত্বেও সর্বাধিক মুনাফা অর্জন করতে পারে না, যার অন্যতম প্রধান কারণ ন্যায্যমূল্য না পাওয়া। আকিজ গ্রম্নপের স্বাধীন সমীক্ষা অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ১২ লাখ টন পাট উৎপাদন হয়, যার সাড়ে আট লাখ রপ্তানি হয়। যার মধ্যে রয়েছে ৪০-৫০ শতাংশ পাটজাত পণ্য। সাধারণত তুরস্ক, চীন ও ভারতে পাট রপ্তানি করা হয়। কিন্তু এর মধ্যে ভারতের পক্ষ থেকে আন্টি ডাম্পিং ডিউটি আরোপিত থাকার কারণে বাংলাদেশের মিলাররা পাট রপ্তানিতে লাভবান হচ্ছেন না। ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে স্বল্পমূল্যে পাটের কাঁচামাল কিনে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন পণ্য বিদেশে বিক্রি এবং বিপুল মুনাফা অর্জন করছে। এ জন্য বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাটপণ্যের ব্যবহার হওয়া সত্ত্ব্বেও এটি যে বাংলাদেশে উৎপাদিত, এ ব্যাপারে অধিকাংশই অনবগত। পাটের মূল্য বৃদ্ধিতে তাই উন্নত মেশিনারি আমদানি করা এখন সময়ের দাবি। আমাদের দেশে আফসানা আসিফ, আসিফুন্নেসা, রাজিয়া সুলতানাসহ কিছু উদ্যোক্তা পাট দ্বারা নানা শৌখন পণ্য তৈরিতে এগিয়ে এসেছেন। তাদের যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা দেশীয় এই শিল্পে নতুন মাত্রা দিতে অনবদ্য ভূমিকা রাখতে পারে। যত বেশি নতুনত্ব আনা যাবে, পাটের ব্যবহারে তত বেশি সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়বে পস্নাস্টিক পণ্যের বদলে পাটজাত পণ্যের ব্যবহারে। এই সবকিছুই সম্ভব পাটের সহজলভ্যতা সৃষ্টি দ্বারা যা নিশ্চিত করতে হবে আরও বেশি পাটমিল ও আধুনিক প্রযুক্তির সরবরাহ করার মাধ্যমে।

'সোনালী আঁশের সোনার দেশ, পাটপণ্যের বাংলাদেশ'এই স্স্নোগানে ২০১৬ সালে ৬ মার্চকে পাট দিবস ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের ৪০-৪৫ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে পাট চাষের সঙ্গে যুক্ত এবং পাটজাত পণ্যের ব্যবসার সঙ্গে চার কোটি মানুষের জীবিকা সম্পর্কিত। পাটের সুদিন ফেরাতে গতবছর সরকার পাট ও বস্ত্রশিল্পে ৬২৮ কোটি টাকা প্রণোদনার ঘোষণা করে।

বাংলাদেশ অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি দেশ। কিন্তু আমাদের ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরতে অনেক প্রচেষ্টার প্রয়োজন। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে পাটের বহুবিধ ব্যবহারের পদ্ধতি উদ্ভাবন ও সীমাবদ্ধতা দূরীকরণের জন্য উপর্যুক্ত গবেষণাই পারে পাটকে অন্যতম প্রধান লাভজনক অর্থকরী ফসল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে