রোববার, ১১ মে ২০২৫, ২৭ বৈশাখ ১৪৩২

বাংলাদেশ-ভারতের পানিবণ্টন সমস্যা ও সম্ভাব্য সমাধান

উজান দেশ থেকে বাংলাদেশের ন্যায্য পানি প্রাপ্তির সমস্যা একটি মৌলিক, প্রাচীন ও ভূ-রাজনৈতিক সমস্যা। এ সমস্যার ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি, কৃষি, মৎস্য ও জীববৈচিত্র্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সমস্যাটির উত্তরণ একটি মৌলিক দাবি। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পানিবণ্টনের সমস্যাটির জন্য সহযোগিতামূলক এবং বহুমুখী সমাধান প্রয়োজন যা সমস্ত নদীপ্রধান রাষ্ট্রের স্বার্থ ও উদ্বেগের সমাধানের দৃষ্টান্ত হতে পারে।
লে. কর্নেল মোহাম্মদ মাহবুব-উল-হক, পিএসসি
  ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
বাংলাদেশ-ভারতের পানিবণ্টন সমস্যা ও সম্ভাব্য সমাধান
বাংলাদেশ-ভারতের পানিবণ্টন সমস্যা ও সম্ভাব্য সমাধান

ভূ-রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যমন্ডিত নদীমাতৃক বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম বদ্বীপ অঞ্চল। ৫৮টি আন্তর্জাতিক নদীসহ কমপক্ষে ২৩০টি নদনদী বিধৌত বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক নদীগুলোর মধ্যে ৫৫টির উৎপত্তি ভারত থেকে এবং তিনটি মায়ানমার থেকে। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার উপনদী ও শাখানদী বিধৌত মোট এলাকার পরিমাণ প্রায় ১৭,২০,০০০ বর্গকিলোমিটার। এ এলাকার শতকরা ৭ ভাগ বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু বাংলাদেশের ন্যায্য পানি প্রাপ্তিতে নানাবিধ সমস্যা বিদ্যমান। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পানিবণ্টনের বিষয়টি একটি পুরাতন এবং জটিল ভূ-রাজনৈতিক সমস্যা- যা প্রাথমিকভাবে ভাগ করা নদী অববাহিকা থেকে পানিবণ্টনকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে। এ সমস্যার মূল বিষয় ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ-ভারত বিভাজন এবং পরবর্তী দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও সম্পর্ককে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা এবং তিস্তাসহ এই অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত প্রধান নদীগুলো উভয় দেশের জীবিকা, কৃষি, বাস্তুসংস্থান এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভারত কর্তৃক উজানে বাঁধ ও ব্যারেজ নির্মাণ, পানি সংরক্ষণ, নদীর গতিপথ পরিবর্তন একদিকে যেমন ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে প্রভাবিত করেছে; অন্যদিকে, ঠিক তেমনি বাংলাদেশে পানির প্রবাহকে উলেস্নখযোগ্যভাবে নিয়ন্ত্রিত করেছে, ফলশ্রম্নতিতে বাংলাদেশের পানির ঘাটতি, কৃষি উৎপাদনশীলতা হ্রাস এবং নিম্নধারার এলাকায় নাব্য ও পরিবেশগত অবক্ষয় নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। শীত মৌসুমে এই সমস্যা আরও তীব্রতর হয়। এছাড়াও, পূর্বাশার কাজের জন্য বিভিন্ন প্রকল্পের কারণে নদীর পানির প্রবাহ এবং পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হয়। অতএব, এই পানি সমস্যার আশুসমাধান অতীব জরুরি।

পানি বণ্টন সমস্যা

এটি একটি ভূ-রাজনৈতিক সংকট। এই সংকটের ফলে সৃষ্ট বাংলাদেশের প্রধান প্রধান নদীগুলোর পানিবণ্টন সংক্রান্ত সমস্যা ও এর প্রভাব সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো :

গঙ্গা নদী: উত্তর ভারতের সমভূমি থেকে নেমে এসে গঙ্গা নদী ভারত ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সীমান্ত ধরে ১২৯ কিলোমিটার এবং বাংলাদেশের মধ্যে ১১৩ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছে। মুর্শিদাবাদ জেলার ধুলিয়ানের কাছে গঙ্গার প্রথম শাখানদী ভাগীরথী উৎপন্ন হয়েছে। উলেস্নখ্য, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাঞ্চলে এই নদীটি আবার হুগলি নদী নামে পরিচিত। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে ফারাক্কা বাঁধ নির্মিত হয়। এই বাঁধ গঙ্গার জলের প্রবাহকে নিয়ন্ত্রিত করে এবং হুগলি নদীর নাব্য রক্ষার উদ্দেশ্যে কিছু পরিমাণ ফারাক্কা ফিডার খালের সাহায্যে ভাগীরথী নদীর দিকে প্রবাহিত করা হতে থাকে। বাংলাদেশে প্রবেশ করে ব্রহ্মপুত্রের বৃহত্তম শাখানদী যমুনার সঙ্গে মিলিত হওয়ার পূর্বে গঙ্গা নদী পদ্মা নাম ধারণ করেছে। আরও ভাটিতে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম শাখানদী মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়ে মেঘনা নাম ধারণ করেছে এবং মেঘনার মোহনায় প্রবেশ করেছে। ৩৫০ কিলোমিটার প্রস্থবিশিষ্ট এই মোহনার মাধ্যমে গঙ্গা বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গা নদীর পানি ভাগাভাগি একটি জটিল এবং দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা। এই সমস্যা মূলত পানির প্রাপ্যতা এবং ব্যবস্থাপনার ওপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হয়। বর্ষাকালে নদীর পানির পরিমাণ বেশি থাকে, কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ কমে যায়। এই কারণে শুষ্ক মৌসুমে পানি ভাগাভাগি একটি জটিল সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৯৬ সালে ভারত ও বাংলাদেশ ৩০ বছরের জন্য গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল- যার মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে পানিবণ্টনের নিয়মাবলি নির্ধারিত হয়। চুক্তি অনুসারে, ফারাক্কা বাঁধ থেকে নির্গত পানির নির্দিষ্ট একটি অংশ বাংলাদেশ প্রাপ্য। শুষ্ক মৌসুমে যখন গঙ্গার পানির স্তর কমে যায়, তখন ভারত নিজেদের প্রয়োজনের তুলনায় অধিক পরিমাণ পানি ধরে রাখতে সক্ষম- যা বাংলাদেশের পানি প্রাপ্তিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এতে বাংলাদেশের কৃষি, মৎস্য এবং সাধারণ পানি সরবরাহ ব্যবস্থায় সমস্যা সৃষ্টি হয়। নদীর পানির প্রবাহ কমে গেলে জীববৈচিত্র্য এবং বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মিঠা পানির নিয়ন্ত্রণ বিঘ্নিত হয়। এছাড়া, নিচু এলাকা এবং সেচ ব্যবস্থার ওপরও প্রতিকূল প্রভাব পড়ে। গঙ্গার পানির ভাগাভাগি নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক এবং কৌশলগত দ্বন্দ্ব রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে এই সমস্যার সমাধানের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হলেও সমস্যা পুরোপুরি সমাধান হয়নি।

তিস্তা নদী: তিস্তা নদী ভারতের সিকিম এবং পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে প্রবাহিত হয় এবং ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলে মেঘনা নদী গঠন করে। এই নদী উভয় দেশের জন্যই কৃষি ও পানির মূল উৎস। তিস্তা নদীর পানির বণ্টন নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা বিদ্যমান। এই সমস্যা মূলত পানির অপর্যাপ্ততা এবং যথাযথ চুক্তির অভাবের কারণে সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও, ভারত বেশ কয়েকটি বাঁধ এবং সেচ প্রকল্প নির্মাণ করেছে- যা নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহকে প্রভাবিত করে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো 'তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প'- যা বাংলাদেশের পানির প্রবাহ কমিয়ে দেয় এবং কৃষিজমির ক্ষতি করে। শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদীর পানির স্তর কমে যায়- যার ফলে, পানির প্রাপ্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। ভারত অধিকাংশ পানি সেচ এবং অন্যান্য কাজের জন্য ব্যবহার করে, ফলে বাংলাদেশের মধ্যে পানির প্রবাহে ঘাটতি দেখা দেয়। এটি প্রধানত উত্তরাঞ্চলের চাষাবাদ এবং পানীয় জলের প্রাপ্যতায় বিপর্যয় সৃষ্টি করে। তিস্তা নদীর পানিবণ্টনের জন্য এখনো পর্যন্ত কোনো স্থায়ী চুক্তি স্বাক্ষর হয়নি। ১৯৮৩ সালে একটি অস্থায়ী চুক্তি হয়েছিল- যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি ব্যবহারের নিয়মাবলি নির্ধারিত হয়েছিল। কিন্তু সেই চুক্তি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নিয়ে আসতে পারেনি। ২০১০ সালে তিস্তার পানি নিয়ে একটি নতুন চুক্তির আলোচনা হয়- যা ২০১১ সালে স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল। তবে রাজনৈতিক কারণে সেই চুক্তি স্থগিত হয়ে যায় এবং পরবর্তী সময়ে তা আর পুনরায় আলোচনায় আসেনি। পানির প্রবাহ কমে যাওয়ার ফলে নদী ও তার আশপাশের জীববৈচিত্র্য এবং বাস্তুতন্ত্রে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। এছাড়া, চাষাবাদ ও স্থানীয় মানুষের জীবিকায় সমস্যা সৃষ্টি হয়। উভয় দেশের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক এবং কৌশলগত কারণে পানিবণ্টন সংক্রান্ত আলোচনা প্রায়ই সংকটের মধ্যে পড়ে।

ব্রহ্মপুত্র নদী : ব্রহ্মপুত্র নদী তিব্বতের হিমালয় থেকে উৎপন্ন হয়ে ভারত এবং পরে বাংলাদেশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে। এটি এশিয়ার প্রধান নদীগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং এর পানি সেচ, কৃষি, মৎস্য এবং পরিবহণসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। ব্রহ্মপুত্র নদীর পানিবণ্টন নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা বিদ্যমান। এই সমস্যা মূলত পানির বণ্টন, ব্যবস্থাপনা এবং যথাযথ চুক্তির অভাবের কারণে সৃষ্টি হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে ব্রহ্মপুত্র নদীর পানির স্তর উলেস্নখযোগ্যভাবে কমে যায়, যার ফলে, নদীর পানির প্রাপ্যতা নিয়ে সংশয় ও অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। ভারত নিজ দেশের সেচ ও বিদু্যৎ উৎপাদনের জন্য অধিকাংশ পানি ব্যবহার করে থাকে, ফলশ্রম্নতিতে বাংলাদেশের পানির প্রাপ্তি কমে যায়। যার দরুন বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষি এবং জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব পড়ে। যেহেতু, ব্রহ্মপুত্র নদীর পানিবণ্টনের জন্য অদ্যাবধি কোনো স্থায়ী আন্তর্জাতিক চুক্তি হয়নি। সেহেতু, দুই দেশের মধ্যে পানির সুষম বণ্টনের সমস্যার সমাধান করা কঠিন হয়ে পড়েছে। যদিও কয়েকটি অস্থায়ী চুক্তি হয়েছে, কিন্তু তা দীর্ঘমেয়াদি সমাধান বয়ে আনতে পারেনি। ব্রহ্মপুত্র নদীর পানির প্রবাহ কমে যাওয়ার ফলে নদীর জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হয়। নদীর তীরে বসবাসকারী মানুষের জীবনযাত্রার মান ও কৃষিজমির উর্বরতা কমে যায়- যা আঞ্চলিক অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। উভয় দেশের মধ্যে রাজনৈতিক এবং কৌশলগত কারণে পানিবণ্টন সংক্রান্ত আলোচনা প্রায়শই অমিমাংসিত থেকে যায়। এর ফলে, সমস্যা আরও জটিল হয়ে ওঠে এবং তা সমাধানে রাজনৈতিক ইচ্ছারও অভাব দেখা যায়।

সুরমা এবং কুশিয়ারা নদী : সুরমা ও কুশিয়ারা বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ নদী। বরাক নদী মণিপুর রাজ্য থেকে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে প্রবেশ করে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়। এই নদীগুলো একত্র হয়ে মেঘনা নদীর প্রধান উপনদীতে পরিণত হয়। এটি বাংলাদেশের দীর্ঘতম নদীগুলোর একটি, যার দৈর্ঘ্য ৬৬৯ কিলোমিটার। টিপাইমুখ বাঁধ বরাক নদীর ওপর নির্মাণাধীন একটি জলবিদু্যৎ প্রকল্প- যা ভারতের মণিপুর রাজ্যে অবস্থিত। এ বাঁধের মাধ্যমে নদীর পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হবে- যা সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানির স্তর ও প্রবাহের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে। বিশেষত বর্ষা মৌসুমে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ পরিবর্তিত হলে কৃষিকাজ, মৎস্য উৎপাদন এবং জীববৈচিত্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সিলেট অঞ্চলের এই নদীগুলো কৃষি, মৎস্য এবং পরিবহণ ব্যবস্থার এটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এই অঞ্চলের মাটি উর্বর করার পাশাপাশি নদীগুলোর পানি স্থানীয় মানুষের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত হয়। নদীর তীরবর্তী এলাকাগুলো জীববৈচিত্র্যে সম্পৃক্ত এবং প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ। পানির স্তর কমে গেলে কৃষিকাজ বিপর্যস্ত হওয়া, মৎস্য উৎপাদন হ্রাস এবং বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ফলশ্রম্নতিতে এ অঞ্চলের মানুষের জীবিকা ও পরিবেশ সুরক্ষায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অতএব, টিপাইমুখ বাঁধের কারণে নদীর পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও পরিবেশে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে।

সমাধানের উপায় : পানিবণ্টন সংক্রান্ত সমস্যার ভূ-রাজনৈতিক ও জল-কূটনীতি প্রণয়নসহ উলেস্নখযোগ্য সমাধানগুলো সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো :

দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা, সংলাপ ও জল-কূটনীতি প্রণয়ন : পানিবণ্টন সমস্যার পারস্পরিক গ্রহণযোগ্য সমাধানের জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে টেকসই দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা এবং সংলাপ অপরিহার্য। সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য দুই দেশের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা ও সহযোগিতার মাধ্যমে আস্থা ও বিশ্বাস বৃদ্ধি জরুরি। উভয় দেশের যৌথ কমিটি এবং আন্তঃসরকারি সংস্থার মাধ্যমে পানির সুষম বণ্টনের উদ্যোগ গ্রহণ করে একটি যুগোপযোগী জল-কূটনীতি প্রণয়ন করা যেতে পারে। জল-কূটনীতির সঠিক প্রয়োগ পানিবণ্টন সমস্যাকে অনেকাংশে লাঘব করবে বলে আশা করা যায়। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। যৌথভাবে জলবিজ্ঞান গবেষণা এবং তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে নদীগুলোর পানি প্রবাহ এবং জল ব্যবস্থাপনা নিয়ে আরও ধারণা পাওয়া সম্ভব। এতে সমস্যা সমাধানের কার্যকর নীতি প্রণয়ন সহজতর ও সম্ভব হবে। উভয় দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান, পরিবেশবিদ এবং সরকারি সংস্থার মাধ্যমে পানির সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা এবং আন্তঃদেশীয় সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। এছাড়াও, নিকটবর্তী রাষ্ট্র হিসেবে নেপাল জল-কূটনীতি প্রণয়ন এবং পানি ব্যবস্থাপনা ইসু্যতে আলোচনা ও সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় আলোচনার আয়োজনের উদ্যোগ নিতে পারে। এ ধরনের আলোচনায় নেপালকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যুক্ত করে সব পক্ষের জন্য সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে লাভজনক সমাধান খোঁজা যেতে পারে।

সমন্বিত নদী অববাহিকা ব্যবস্থাপনা : সমন্বিত নদী অববাহিকা ব্যবস্থাপনা কৌশল অবলম্বন ও এর সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে উভয় দেশের চাহিদা মোকাবিলার জন্য ন্যায্যতার ভিত্তিতে পানির সঠিক প্রাপ্তি নিশ্চিত করা যেতে পারে। পানি ব্যবস্থাপনার জন্য অববাহিকা-বিস্তৃত পদ্ধতি গ্রহণ করা, স্থায়ী উন্নয়ন অনুশীলনগুলো অন্তর্ভুক্ত করা, এই অঞ্চলে পানি সুরক্ষা এবং স্থিতিস্থাপকতা বাড়ানোর জন্য বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন থাকা ও প্রচার করা, আন্তঃসীমান্ত নদী অববাহিকার যৌথ ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা কর্মসূচিতে দুই দেশের অংশগ্রহণ পরিবেশগত অবক্ষয় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাব প্রশমনে অবদান রাখার মাধ্যমে নিম্নধারার এলাকায় পানির প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পারে। যা নদীতে বাঁধ নির্মাণের বিরূপ প্রভাব প্রশমিত করবে বলে আশা করা যায়। এই উদ্যোগের মাধ্যমে নদী অববাহিকার দীর্ঘমেয়াদি টেকসই ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত হবে- যা নদীতে বাঁধ নির্মাণের বিরূপ প্রভাব প্রশমিত করবে এবং পানির প্রাপ্যতা ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে ন্যায়সঙ্গত সমাধান প্রদান করবে।

আঞ্চলিক ফোরাম গঠন : ভারত, বাংলাদেশ এবং চীনের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে আঞ্চলিক ফোরাম গঠন করে ব্রহ্মপুত্র নদীর পানির সুষমবণ্টন ও ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা সম্ভব। এই ফোরামের মাধ্যমে নিয়মিত বৈঠক ও আলোচনার মাধ্যমে নদীসংক্রান্ত সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করা যাবে- যা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হবে। ফোরামটি ওহঃবমৎধঃবফ ডধঃবৎ জবংড়ঁৎপব গধহধমবসবহঃ (ওডজগ) বা সার্বিক পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে পানির পুনর্ব্যবহার ও সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে পারে- যা পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখা এবং পানি সংকট মোকাবিলায় কার্যকর হবে। একই সঙ্গে, ফোরামের মাধ্যমে নদীর তথ্য বিনিময়, সমস্যা সমাধানের সমন্বিত কৌশল গ্রহণ, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পানি সংরক্ষণ এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হবে। এই প্রক্রিয়া শুধু পানির সুষম ও স্থায়ী ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করবে না, বরং তিন দেশের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা, সহনশীলতা এবং সম্পর্ক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে- যা ভবিষ্যতে সম্ভাব্য পানি সংকট নিরসনে সহায়ক হবে।

আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা : কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, মৎস্য ও জীববৈচিত্র্যের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণে পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পানি-সম্পর্কিত সমস্যা নিষ্পত্তি এবং মনমালিন্য প্রতিরোধের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য। এ লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা এবং আইনি কাঠামো, যেমন জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক জলপথের নন-ন্যাভিগেশনাল ব্যবহারের কনভেনশন, ব্যবহারের মাধ্যমে জল-কূটনীতি বাস্তবায়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এর ফলে ন্যায়সঙ্গত ও যুক্তিসঙ্গত পানিবণ্টন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এছাড়া, আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা ও সমঝোতার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং টেকসই জলবায়ু নীতি বাস্তবায়ন অপরিহার্য। এর মাধ্যমে সামগ্রিক অঞ্চলের শান্তি, উন্নয়ন এবং পরিবেশ সংরক্ষণ নিশ্চিত করা যাবে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহযোগিতা ও আন্তঃসীমান্ত পানি ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন দীর্ঘমেয়াদি শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে। এছাড়া, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তি, স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ, এবং তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে উভয় দেশের মধ্যে আস্থা ও সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে- যা ভবিষ্যৎ সংকট নিরসনে সহায়ক হবে।

পরিশিষ্ট:উজান দেশ থেকে বাংলাদেশের ন্যায্য পানি প্রাপ্তির সমস্যা একটি মৌলিক, প্রাচীন ও ভূ-রাজনৈতিক সমস্যা। এ সমস্যার ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি, কৃষি, মৎস্য ও জীববৈচিত্র্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সমস্যাটির উত্তরণ একটি মৌলিক দাবি। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পানিবণ্টনের সমস্যাটির জন্য সহযোগিতামূলক এবং বহুমুখী সমাধান প্রয়োজন যা সমস্ত নদীপ্রধান রাষ্ট্রের স্বার্থ ও উদ্বেগের সমাধানের দৃষ্টান্ত হতে পারে। দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা এবং সমন্বিত নদী অববাহিকা ব্যবস্থাপনা এই অঞ্চলে স্থায়ী উন্নয়ন এবং পানি সম্পর্কিত উত্তেজনা প্রশমনের জন্য অপরিহার্য। জল-কূটনীতির সঠিক প্রয়োগ, আঞ্চলিক অবকাঠামো উন্নয়ন, তথ্য আদান-প্রদান এবং পরিবেশ সংরক্ষণ প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশের পানির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নেপাল একটি উজানের নদীপ্রধান রাষ্ট্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। চীনকে সঙ্গে নিয়ে, আঞ্চলিক ফোরাম গঠনের মাধ্যমে ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা বৃদ্ধি করে ও প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার মাধ্যমে পানির নিরাপত্তা ও স্থিতিস্থাপকতার জন্য একটি যৌথ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে, বাংলাদেশ ও ভারত পানি ব্যবস্থাপনা ও বণ্টনের জটিলতা কাটিয়ে উঠে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুবিধার জন্য ভাগ করা পানিসম্পদের সুষম, ন্যায্য ও স্থায়ী ব্যবহার নিশ্চিত করতে একসঙ্গে কাজ করতে পারে।

লে. কর্নেল মোহাম্মদ মাহবুব-উল-হক: পিএসসি, ইঞ্জিনিয়ার্স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে