সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫, ২ আষাঢ় ১৪৩২

প্রচন্ড খরতাপে পুড়ছে দেশ

সাখাওয়াত হোসেন
  ২৭ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০
প্রচন্ড খরতাপে পুড়ছে দেশ
প্রচন্ড খরতাপে পুড়ছে দেশ

এই মধ্য বৈশাখে আকাশে লম্বালম্বিভাবে অবস্থান করছে তাতানো সূর্য। খরতাপে পুড়ছে রাজধানী-নগর-লোকালয়-প্রান্তর। গত কদিনে তাপমাত্রা কেবল বেড়েই চলেছে। ঘরে-বাইরে অস্বস্তি। তীব্র খরতাপে হাঁসফাঁস করছেন শহরবাসী। নিদাঘের তপ্ত বাতাস আগুনের হলকার মতো শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। তেষ্টায় শুকিয়ে যাচ্ছে বুক। তাতানো রোদ্দুর আর হাওয়ারুদ্ধ প্রকৃতিতে নেতিয়ে পড়ছে গাছ-গুল্ম-লতা। প্রাণীকুল বিপর্যস্ত অবস্থায় সময় কাটাচ্ছে। শিশু ও বৃদ্ধরা কাবু হয়ে পড়ছেন। দেখা দিচ্ছে ডায়রিয়াসহ নানা ধরনের রোগবালাই।

এদিকে রিকশা-ভ্যান-ঠেলাগাড়ি চালক ও দিনমজুরসহ কায়িক শ্রমে জড়িত বিভিন্ন পেশার মানুষের এখন জীবন ওষ্ঠাগত। অতিরিক্ত ঘাম ঝরিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে শরীর। নন-এসি মার্কেট-বিপণিবিতান ও গার্মেন্টসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানায় ফ্যানের বাতাসেও ঘেমে-নেয়ে উঠছে সবাই।

1

ভ্যাপসা গরমের সঙ্গে অনেক জায়গায় লোডশেডিংয়ে জনজীবনে নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম হচ্ছে। কাঠফাটা রোদের তেজ আর গরমের দাপটে কার্যত নাকানি-চুবানি অবস্থা। বৃষ্টিহীন রুদ্র আকাশের দিকে তাকিয়ে মানুষ কায়মনে বর্ষামঙ্গলের প্রার্থনা করছেন। তবে কোথাও কোথাও আকাশে মেঘ রোদের লুকোচুরি খেলা চললেও বৃষ্টির দেখা নেই। মৌসুমি বায়ু এখনো দুর্বল। আবহাওয়া দপ্তর তাদের পূর্বাভাসে বলছে, এই দাবদাহ আরও দুই দিন থাকতে পারে। বাতাসে আর্দ্রতা বা জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি থাকায় তাপমাত্রা অসহনীয় হয়ে উঠেছে।

আবহাওয়াবিদ জানান, এই গ্রীষ্মে গড়পড়তা তাপমাত্রা সীমাহীন নয়। তবে বাতাসে অতি আর্দ্রতার প্রভাবে তাপে অস্বস্তি বাড়ছে। তাপমাত্রার চেয়ে গরম বেশি অনুভূত হচ্ছে। গতকাল সোমবার ঢাকায় তাপমাত্রা ছিল ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু গরমের তীব্রতা অনুভূত হয়েছে অনেক বেশি। তার কারণ গতকাল বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ ছিল ৬৬ শতাংশ। এই আর্দ্রতার পরিমাণ বাড়লে দাবদাহও আরও বাড়বে।

সোমবার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, প্রকৃতি দ্বৈত আচরণ করবে। তাপমাত্রা কমার পর কালবৈশাখী ঝড় শুরু হবে। বৈশাখের পর প্রকৃতির বৈরিতা কিছুটা কমতে পারে। লঘুচাপের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। নিম্নচাপ থাকায় বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত গরম অব্যাহত থাকবে। রাজশাহী, যশোর, কুষ্টিয়া ও খুলনা অঞ্চলের উপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের অবশিষ্টাংশসহ ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রংপুর, সিলেট ও বরিশাল বিভাগের উপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। যা অব্যাহত থাকতে পারে। সারাদেশে দিনের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকবে। পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এই সময়ে শেষের দিকে বৃষ্টি-বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। সারাদেশের দিনের তাপমাত্রা ১ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেতে পারে।

সোমবার যশোরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অফিস। এছাড়া রাজশাহীতে ৪০ দশমিক ৩, খুলনায় ৪০ দশমিক ২, চুয়াডাঙ্গায় ৪০ দশমিক ৫, কুমারখালীতে ৪০, মোংলায় ৩৯ দশমিক ৬, সাতক্ষীরায় ৩৯ দশমিক ২, ঢাকায় ৩৯ দশমিক ৫, গোপালগঞ্জে ৩৯ দশমিক ৫, সীতাকুন্ডে ৩৯ দশমিক ৬, রাঙামাটিতে ৩৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এ দিন সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল শ্রীমঙ্গলে ২১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান বলেন, তাপপ্রবাহ আরও দুই-তিন দিন থাকতে পারে। বৃষ্টিপাত কম হওয়ার কারণে তাপমাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। তবে কী কারণে বৃষ্টিপাত এত কম হচ্ছে তা তাৎক্ষণিকভাবে বলা যাচ্ছে না।

আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬০ সালের ৩০ এপ্রিল ঢাকায় এ যাবৎ সর্বোচ্চ ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। এরপর ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে তাপমাত্রা ছিল ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। স্বাধীন বাংলাদেশে দ্বিতীয় দফায় ২০১৪ সালের ২৮ এপ্রিল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

এদিকে শহর ও গ্রামে যারা টিনের ঘরে বসবাস করেন তাদের রীতিমতো মরণাপন্ন দশা। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর দিনমজুর রাজু মিয়া বলেন, দুপুরে সূর্যতাপে টিনের চাল এত গরম হয়ে যায় যে সন্ধ্যার পরও ঘরে ঢোকা দায়। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রাত ১০-১১টা পর্যন্ত রাস্তায় বসে থেকে পরে তারা ঘরে ঢোকেন।

সবুজবাগের বাসিন্দা ভ্যানচালক বিলস্নাল বলেন, 'সারাদিন রিকশা চালিয়ে শরীর ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। অথচ তারপরও রাতে বাসায় ফিরে ঘুমানো সম্ভব হয় না। টিনের চাল গরমে তেতে থাকে। ফ্যান ছাড়লে মনে হয় যেন গরম আরও টেনে নামাচ্ছে।'

গ্রামাঞ্চলের মানুষ যারা টিনের ঘরে থাকেন তাদেরও প্রায় একই দশা। গাছের ছায়াতেও ঘরের চালের তাপ কমে না বলে জানান তারা।

রিকশাচালক নিমাই জানান, সারাদিন ধরে পানি খাচ্ছেন তবুও শরীরের পানির চাহিদা যেন পূরণই হচ্ছে না। তিনি বলেন, 'সারাদিন ধরে যত পানি খাই, সব ঘাম হয়ে বের হয়ে যায়। স্যালাইন খেলেও লাভ হচ্ছে না। সারাদিন এত পানি খাচ্ছি, তবু শরীরের জ্বালাপোড়া থামছে না।'

ভ্যানচালক কেরামত জানান, প্রচন্ড গরমে নির্মাণকাজ থমকে গেছে। তাই পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য তেমন ডাক মিলছে না। সোমবার বেলা দেড়টা পর্যন্ত মাত্র এক খ্যাপ মাল টেনে ২০০ টাকা আয় করেছেন।

রাজধানীর মধুবাগ ঝিলপাড় এলাকায় রাস্তায় পাশে বিশ্রাম নেওয়া ঠেলাচালক মোবারক হোসেন বলেন, 'প্রচন্ড গরমে শরীর পুড়ে যাচ্ছে, ভীষণ তেষ্টা পাচ্ছে। এ অবস্থায় রোজা রেখে ঠেলা চালানো কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।' একই এলাকায় বিশ্রাম নেওয়া আরেক ঠেলাচালক ইকবাল বলেন, 'ঠেলা চালানো এমনিতেই কষ্টের কাজ। তার উপর গরমে দ্রম্নত ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। ঘরে চাল-ডাল না থাকায় রাস্তায় বেরিয়েছি। কিন্তু লকডাউনে কাজের সংকটে অনেকেই বেকার বসে আছে।'

এদিকে লকডাউনে যাদের সময় কাটছে ঘরের চৌহদ্দিতে, তাদেরও ত্রাহি ত্রাহি দশা। সূর্যের তেজ আর রান্নাঘরের চুলার আগুন দুয়ে মিলে পুরো ঘরের আবহাওয়া হয়েছে চুলিস্নর ভেতরে থাকার মতো।

প্রচন্ড গরমের কারণে ট্রাফিক পুলিশ সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে না পারায় লকডাউনের মধ্যেও রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। তীব্র গরমের অস্বস্তিতে বেপরোয়াভাবে যানবাহন পরিচালনায় সড়ক দুর্ঘটনাও কিছুটা বেড়েছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের একজন চিকিৎসক জানান, এখন শিশুদের মধ্যে হাম, ব্রংকাইটিস, শ্বাসকষ্ট ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। গরমে হাসপাতালগুলোতে শিশু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কথা জানান তিনি। এ চিকিৎসকের পরামর্শ, অতিরিক্ত ঘামের কারণে শরীর থেকে লবণ চলে যাচ্ছে। তাই সব বয়সি মানুষের উচিত ওরস্যালাইন খাওয়া। সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত ঘরের বাইরে গেলে ছাতা ব্যবহার করা।

নিউরো মেডিসিনের চিকিৎসক শহীদুল ইসলাম বলেন, হঠাৎ গরম ও দাবদাহের কারণে মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এসব থেকে মুক্তি পেতে ঘন ঘন তরল ও হালকা খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন এ চিকিৎসক।

এদিকে ভয়াবহ দাবদাহের মাঝে বিদু্যতের ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাস-কোচিং ও বাসার লেখাপড়া রীতিমতো শিকেয় ওঠেছে।

বাসাবোর বাসিন্দা নাজনিন আক্তার জানান, গত কয়েক দিন ধরেই দুপুর ও সন্ধ্যার দিকে বিদু্যৎ চলে যাচ্ছে। আসছে প্রায় এক-দেড় ঘণ্টা পর। এ ঘটনা একবার নয়, কয়েক দফা ঘটছে। দীর্ঘদিন এ ধরনের বিদু্যৎ বিভ্রাট না হওয়ার কারণে এ ভোগান্তি এখন অসহনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই অভিযোগ রাজধানীর মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী ও পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদেরও।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে