রমজানে রাজধানী ঢাকার যানজট নিরসনে গত সপ্তাহে ১৫টি নির্দেশনা দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ। রোজার শুরু থেকেই এ নির্দেশনা কার্যকরে তোড়জোড়ে মাঠে নেমেছে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ট্রাফিক পুলিশের মাঠ পর্যায়ের সদস্যরা। অথচ যানজট নিরসনের এসব কৌশলের কোনোটিই তেমন কাজে লাগছে না। বরং রোজার সঙ্গে পালস্না দিয়ে ঢাকা মহানগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থার ক্রমেই অবনতি ঘটছে। ঈদ যতই ঘনিয়ে আসবে নগরীর যানজট পরিস্থিতি ততই ভয়াবহ রূপ নেবে বলে খোদ ট্রাফিক বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাই আশঙ্কা করছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকার যানজট নিরসনে তারা নানা কৌশলী উদ্যোগ নিলেও সর্বোচ্চ তৎপরতা চালিয়েও তারা তা বাস্তবায়ন করতে পারছেন না। ফলে তাদের সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হচ্ছে। নগরীর ব্যস্ততম প্রধান সড়ক ও গুরুত্বপূর্ণ মোড়সহ বিভিন্ন স্থানে খোঁড়াখুঁড়ি, দ্রম্নতগতির যানবাহনের সঙ্গে একই সড়কে ধীরগতির যানবাহন চলাচল, রমজানকে সামনে রেখে ঢাকার বাইরে থেকে হাজার হাজার রিকশার অবৈধ অনুপ্রবেশ, ফুটপাতের পাশাপাশি রাস্তার দু'পাশ দখল করে ভ্যানে পসরা সাজিয়ে দাঁড়ানো হকারদের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং মার্কেট শপিংমল ও বিপণি-বিতানের সামনের রাস্তায় অবৈধ গাড়ি পার্কিং বেড়ে যাওয়ার ঘটনা যানজট নিরসনের পথে বড় বাধা বলে মনে করেন ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
তারা জানান, এসব সংকটের সমাধান না হলে মাঠ পর্যায়ের ট্রাফিক পুলিশ যতই তৎপর হোক না, তাতে যানজট পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, থানা পুলিশের দুর্নীতিবাজ কিছু সদস্য ফুটপাত ও রাস্তা দখলকারী হকারদের কাছ থেকে চাঁদা নিলেও এর নেপথ্যে মূলত কলকাঠি নাড়েন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। তাই যানজট সৃষ্টিকারী এসব হকারদের বিরুদ্ধে ট্রাফিক পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। ফুটপাত ও রাস্তা দখলকারী হকারদের ব্যস্ত সড়ক থেকে সরিয়ে দেওয়া হলে রমজানে যানজট অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসবে। এছাড়া উপকণ্ঠ এলাকা থেকে ঢাকা মহানগরীতে প্রবেশ করে হাজার হাজার রিকশার অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকানো জরুরি বলে মনে করেন তারা।
তবে পরিবহণ মালিক-চালকরা অনেকেই বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের ভাষ্য, রমজান মাসকে সামনে রেখে গাড়ির কাগজপত্র যাচাইয়ের নামে ট্রাফিক পুলিশের চাঁদাবাজির হিড়িকই ট্রাফিক ব্যবস্থার অবনতির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। প্রতিদিন পিক ও অফ-পিক
আওয়ারে ব্যস্ততম সড়ক এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে যেভাবে শত শত গাড়ি দাঁড় করিয়ে কাগজপত্র যাচাই করা হচ্ছে তাতে স্বাভাবিকভাবেই ট্রাফিক পুলিশ যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারছে না। যে কারণে রমজানের প্রথম কর্মদিবস থেকেই নগরীতে ভয়াবহ যানজট সৃষ্টি হচ্ছে।
যদিও এ অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করেছেন ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তাদের বক্তব্য, যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখার স্বার্থেই ট্রাফিক পুলিশ অবৈধ যানবাহনের কাগজপত্র যাচাই করছে। এছাড়া ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় নেমে হঠাৎ বিকল হয়ে কিংবা বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটিয়ে সড়কে যাতে যানজট সৃষ্টি না করে এজন্য এসব যানবাহন জব্দ ও জরিমানা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স যাচাই করা হচ্ছে যাতে অদক্ষ কোনো চালক সড়কে দুর্ঘটনা ঘটাতে না পারে।
এদিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান জানান, রোজার মাসে অফিসের সময় কমে যাওয়ায় পুরো ১২ ঘণ্টার চাপ এখন ৮ ঘণ্টায় ঠেকেছে। সঙ্গত কারণেই যানজট বেড়েছে। অন্যদিকে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে। এতে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। গুলশান বা উত্তরার মতো যেসব সড়কে দ্রম্নতগতির যান বেশি চলাচল করে, সেখানে হঠাৎ যানজটের সৃষ্টি হলে এর প্রভাব অন্য এলাকাগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ছে।
ডিএমপি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) ফারুক হোসেন বলেন, রোজা এলেই সড়কের উভয় পাশে ও ফুটপাতে হকারদের দখল বেড়ে যায়। এছাড়া মার্কেট, শপিংমল ও বিপণি-বিতানের সামনে এবং যত্রতত্র অবৈধ গাড়ি পার্কিং কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এতে যানজটের সৃষ্টি হয়। যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি থানা পুলিশও প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ঢাকা শহরের যানজট নিরসন পুলিশের একার পক্ষে সম্ভব নয়। সড়কে চলাচলকারী সবার এ বিষয়ে সহযোগিতা জরুরি।
সরেজমিনে মঙ্গলবার ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সকাল ও বিকেলের পিকআওয়ারে বিভিন্ন সড়কে গণপরিবহণসহ বিভিন্ন যানবাহনের দীর্ঘ সারি জমে উঠেছে। দ্রম্নত গন্তব্যে পৌঁছাতে কিছু যানবাহন বেপথে চলার চেষ্টা করছে। এতে দ্রম্নত যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। সকালের পিকআওয়ারে উত্তরা, বনানী, মহাখালী, জাহাঙ্গীর গেট, বিজয় সরণি মোড়, ফার্মগেট, শাহবাগ, মৎস্যভবন ও পল্টন সড়কে ছিল যানবাহনের দীর্ঘ সারি। বেশিরভাগ রুটে নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা বিলম্ব হয়েছে। পথে দীর্ঘ যানজটে আটকা পড়ে অনেকে গণপরিবহণ থেকে নেমে হেঁটে গন্তব্যে রওনা দেন। অনেকে আবার যানজটের ভয়ে ঘর থেকে বের হয়ে কোনো যানবাহনে চড়েননি।
এদিকে হাতিরঝিলের মহানগর প্রকল্পের সামনের সড়কে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলায় সেখান থেকে এফডিসি মোড় পর্যন্ত সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এ সময় এফডিসি মোড় থেকে সোনারগাঁও মোড়ের রাস্তাটিতে যানবাহনের দীর্ঘ সারি জমে ওঠে। এ সড়কে যানবাহনের চাপ বেশি দেখে সাতরাস্তা দিয়ে মেয়র আনিসুল হক সড়ক ঘুরে কারওয়ানবাজার আসতে গিয়েও অনেকে তীব্র যানজটের মুখে পড়েছেন।
সকালে রাজধানীর নর্দ্দা ফুটওভার ব্রিজের নিচ এবং এর আশপাশের সড়কে যানবাহনের দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। মূল সড়কে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন রুটের বাস যাত্রী তোলায় এ যানজট সৃষ্টি হয়েছে বলে সেখানে দায়িত্বরত ট্রাফিক কনস্টেবল দাবি করেন। তার ভাষ্য, তিনি প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়েও মাঝ রাস্তায় যাত্রীর জন্য অপেক্ষমাণ বাসগুলোকে সরাতে পারেননি। তার সামনেই চালকরা অগোছালোভাবে গাড়ি দাঁড় করাচ্ছেন।
উত্তর বাড্ডার বাসিন্দা এনামুল হোসেন জানান, রমজানের প্রথম কর্মদিবস সোমবারে রাস্তায় তীব্র যানজটে পড়ে নির্ধারিত সময়ে অফিসে পৌঁছাতে পারেননি। তাই মঙ্গলবার সকালে বাসা থেকে বের হয়ে পায়ে হেঁটে কাকরাইলের কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে রওনা করেন। তবে রাস্তায় যানবাহনের দীর্ঘ সারি এবং ফুটপাতের বড় অংশ হকারদের দখলে থাকায় সামান্য পথ যেতেই তার দীর্ঘ সময় লেগেছে।
রাজধানীর নতুন বাজার এলাকার বাসিন্দা, ব্যাংক কর্মকর্তা শহীদ উদ্দিন রনি জানান, সকাল সাড়ে ৭টায় বাসা থেকে বের হয়ে মতিঝিলের কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। স্বাভাবিক সময় এ পথ যেতে তার সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৫০ মিনিট সময় লাগে। অথচ মঙ্গলবার এ পথে তার প্রায় দু'ঘণ্টা সময় নষ্ট হয়েছে।
এদিকে পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা জানান, রোজার মাসে ট্রাফিক ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ যে ১৫টি নির্দেশনা দিয়েছে, এর বেশিরভাগই যানজট নিরসন সংশ্লিষ্ট নয়। এছাড়া যেসব নির্দেশনা যানজট নিরসনের ক্ষেত্রে সহায়ক হবে, সেগুলোর সংকট মোকাবিলার উপায় দেখানো হয়নি। তাই স্বাভাবিকভাবেই এসব কৌশল যানজট নিরসনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, যানজট নিরসনে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের নির্দেশনাগুলো হলো- ঢাকা মহানগরীতে দূরপালস্না ও আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালের অভ্যন্তরে কোনো বাসই সড়কে রেখে বা থামিয়ে যাত্রী উঠানো যাবে না। টার্মিনালের ভেতরে থাকা অবস্থায় যাত্রীদের বাসের আসন গ্রহণ করতে হবে। ঢাকা মহানগরীতে আন্তঃজেলা ও দূরপালস্নার বাসগুলো টার্মিনালসংলগ্ন প্রধান সড়কের অংশ দখল করে দাঁড়াতে পারবে না। ভ্রমণকালে ঢাকা মহানগরের প্রবেশ ও বাহির পথের গণপরিবহণগুলো শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে যেন কোনো অযাচিত যানজটের সৃষ্টি না হয়। ঢাকা মহানগরী থেকে ছেড়ে যাওয়া দূরপালস্নার যানবাহনগুলোকে অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বহন থেকে নিবৃত্ত থাকতে হবে। ঢাকা মহানগর থেকে দূরপালস্নার রুট পারমিটবিহীন বা অননুমোদিত রুটে কোনো বাস চলাচল করবে না। বাসের ভেতরে যাত্রীরা অপরিচিত কারও কাছ থেকে কিছু খাবেন না। সংশ্লিষ্ট যাত্রীরা অবশ্যই যানবাহনে টিকিট সঙ্গে রাখবেন। যাত্রীদের মালামাল নিজ হেফাজতে সাবধানে রাখা হবে। কোনো যানবাহনেই ছাদের ওপর অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা যাবে না। যাত্রী তোলার ক্ষেত্রে বাস চালকরা এমন কোনো অসম প্রতিযোগিতায় অংশ নেবেন না, যাতে সড়কের শৃঙ্খলায় বিঘ্ন ঘটে ও জীবনহানির শঙ্কা থাকে।
নির্দেশনায় আছে, সকালে অফিসে গমনকারীদের পর্যাপ্ত সময় হাতে নিয়ে বাসা থেকে বের হওয়া। ইফতার সন্নিকটে বাসায় রওয়ানা না দিয়ে পর্যাপ্ত সময় হাতে নিয়ে বাসার উদ্দেশে রওয়ানা দেওয়া। স্বল্প দূরত্বে যাতায়াতের ক্ষেত্রে রিকশা, সিএনজি, বাস ইত্যাদি বাহন ব্যবহার না করে হেঁটে যাওয়া। টার্মিনালভিত্তিক কাউন্টারগুলোতে ভাড়ার চার্ট প্রদর্শন করা।
সড়ক ও পরিবহণ বিশেষজ্ঞরা বলেন, ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের উলেস্নখিত ১৫টি নির্দেশনার এক তৃতীয়াংশই যানজট নিরসন সংশ্লিষ্ট নয়। এছাড়া যেসব নির্দেশনা সরাসরি যানজট নিরসনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে তার বেশিরভাগই গত কয়েকদিনে ট্রাফিক পুলিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি। যথারীতি ঢাকা মহানগরীতে দূরপালস্না ও আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালের অভ্যন্তরে সব বাসই সড়কে রেখে বা থামিয়ে যাত্রী উঠাচ্ছে। আন্তঃজেলা ও দূরপালস্নার বাসগুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা টার্মিনাল সংলগ্ন প্রধান সড়কের অংশ দখল করে পাকির্ং করে রাখা হচ্ছে। মালিবাগ মোড়, রাজারবাগ, ফকিরাপুল, নটর ডেম কলেজের বিপরীতের রাস্তা ও সায়েদাবাদ মোড়সহ বিভিন্ন সড়কে দূরপালস্নার বাসের অলিখিত স্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে। যা ট্রাফিক পুলিশ দেখেও না দেখার ভান করছে।