শুক্রবার, ০২ মে ২০২৫, ১৯ বৈশাখ ১৪৩২

আত্মগোপন ছেড়ে প্রকাশ্যে ফিরছে আসামিরা !

সাখাওয়াত হোসেন
  ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
আত্মগোপন ছেড়ে প্রকাশ্যে ফিরছে আসামিরা !
আত্মগোপন ছেড়ে প্রকাশ্যে ফিরছে আসামিরা !

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হামলা, গুলিবর্ষণ ও হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার আসামিরা এতদিন আত্মগোপনে থাকলেও এবার তারা প্রকাশ্যে ফিরতে শুরু করেছে। তবে নিজ বাড়ি-ঘরে না ফিরে তারা আশপাশের এলাকায় অবস্থান নিচ্ছে। সেখান থেকে পরিবারসহ অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। এরইমধ্যে অনেকে সক্রিয়ভাবে নিজের ব্যবসা-বাণিজ্যেও ফিরেছে। আসামিদের সিংহভাগই আওয়ামী দলীয় নেতাকর্মী হওয়ায় তারা রাজনৈতিকভাবেও নিজেদের সংঘটিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে এসে আসামিরা অনেকে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। তাদের কথা না মানলে জীবননাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। মামলা প্রত্যাহারে কেউ কেউ নগদ টাকার প্রলোভন দেখাচ্ছে। পুলিশকে অবহিত করা হলে তারা নানা তালবাহানায় এসব বিষয় এড়িয়ে যাচ্ছে। আসামিরা থানা পুলিশকে ম্যানেজ করে প্রকাশ্যে চলাচল করছে বলেও বাদীদের অনেকেই অভিযোগ তুলেছে।

তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতনরা এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসামিদের ধরপাকড়ে তাদের ধীরগতির ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাদের ভাষ্য, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হামলা, গুলিবর্ষণ ও হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার সিংহভাগ আসামিই আওয়ামী লীগ এবং এর বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী। এছাড়া ওই সময়ে দায়েরকৃত বেশকিছু মামলায় নিরীহ ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। বেশকিছু গায়েবি মামলা রুজু হওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। তাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারে সরকার জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছে। গত ৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার অভু্যত্থানকে কেন্দ্র করে সারাদেশে ভুয়া, মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রতিরোধে প্রতিটি জেলায় তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপার (এসপি) ও জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি সুপারিশ প্রস্তুত করছে। এসব কমিটি সব জেলায় ভুয়া, মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা বাছাই করছে। জেলা কমিটির কাছে যদি মনে হয় মামলাটি রাজনৈতিক বা অন্য কোনো উদ্দেশে হয়রানির জন্য দায়ের করা হয়েছে, তাহলে মামলাটি প্রত্যাহারের জন্য কমিটি সরকারের কাছে সুপারিশ করবে। পরবর্তীকালে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ওই সুপারিশ, মামলার এজাহার, চার্জশিটসহ নির্ধারিত 'ছক' অনুযায়ী তথ্যাদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। জেলা কমিটির কাছ থেকে সুপারিশপ্রাপ্তির পর সেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা এবং প্রত্যাহারযোগ্য মামলা চিহ্নিত করে তালিকা প্রস্তুত করা ও মামলা প্রত্যাহারের কার্যক্রম গ্রহণ করবে মন্ত্রণালয় পর্যালোচনা কমিটি।

তাই গত ৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার অভু্যত্থানকে কেন্দ্র করে যেসব মামলা হয়েছে, ওইসব মামলার আসামিদের ধরপাকড়ের ব্যাপারে এখুনি সাড়াশি অভিযান চালানো হচ্ছে না। তবে ভুয়া, মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা বাছাই শেষে প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেপ্তারে দেশব্যাপী একযোগে কম্বিং অপারেশন চালানো হবে। বিশেষ করে অবৈধ অস্ত্রধারী আসামিদের গ্রেপ্তারে সর্বোচ্চ তৎপরতা চালাবে পুলিশ। তবে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামিদের গ্রেপ্তারে এখনো কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। এরইমধ্যে এসব মামলায় বিপুল সংখ্যক মন্ত্রী, এমপি, প্রভাবশালী রাজনীতিক, পদধারী নেতা ও আমলাদেরও গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে দাবি করেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

তবে তাদের এ দাবি পুরোপুরি ঠিক নয় বলে অভিযোগ তুলেছেন ভুক্তভোগীরা। তাদের ভাষ্য, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন ঘটনায় দায়েরকৃত মামলা, বিশেষ করে ওই সময়কালীন হত্যা মামলার বেশকিছু ভিআইপি আসামি গ্রেপ্তার করা হলেও অন্যদের ধরপাকড়ের ব্যাপারে পুলিশ যথেষ্ট আন্তরিক নয়। বিভিন্ন এলাকায় আসামিদের প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ানোর অভিযোগ দেওয়ার পরও তাদের গ্রেপ্তারে কোনো সাড়াশি অভিযান চালানো হচ্ছে না। বরং বাদীকে আসামির সঠিক অবস্থান সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে বলছে পুলিশ, যা একজন বাদীর পক্ষে অসম্ভব।

এদিকে আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন মামলার আসামিদের আত্মগোপন ছেড়ে প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসার কথা পুলিশ স্বীকার না করলেও দলের নেতারা বলছেন ভিন্ন কথা। আওয়ামী লীগের মধ্যম সারির বেশ কয়েকজন নেতার দাবি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় আসামি হওয়া নেতাকর্মীরা নিজ বাড়িঘরে না ফিরলেও আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে এসেছে। তারা নিজের এলাকার আশপাশে অবস্থান নিয়েছে। পরিচয় গোপন রেখে কেউ কেউ ফ্যামিলিসহ অন্য এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের ওই নেতাকর্মীরা আরও জানান, দলের যাদের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বিভিন্ন ঘটনায় হত্যাসহ একাধিক মামলা হয়েছে- শুধু তারাই নন, অন্য নেতাকর্মীরাও ধীরে ধীরে আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। তারা নিজেদের সংঘটিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগের প্রথম সারির ও প্রভাবশালী নেতারা নিজেরা প্রকাশ্যে না এসে আত্মগোপনে থেকে নানা কর্মসূচি পালনের তাগিদ দেওয়ায় কর্মীরা তাতে উৎসাহ পাচ্ছেন না।

রাজধানীর সবুজবাগ থানা আওয়ামী লীগের একজন মধ্যম সারির এক নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দলের নীতি-নির্ধারকরা তাদের কোনো রকম সতর্ক না করেই নিজেরা নিরাপদ আশ্রয়ে সরে গেছেন। তারা তখন মাঠের নেতাকর্মীদের কথা একবারও চিন্তা করেননি। এখন তাদের কেউ কেউ বিদেশ থেকে আন্দোলনের রাজপথে নামার নির্দেশনা দিচ্ছেন। কিন্তু একাধিক মামলার আসামি হওয়া লাখ দুয়েক নেতাকর্মী কীভাবে মাঠে নামবেন না চিন্তা করছেন না। আত্মগোপন থেকে ফিরলেও মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগ দেবে না বলে মনে করেন ওই নেতা।

একাধিক মামলা মাথায় নিয়েই আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে আসা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের আশঙ্কা, পুলিশ এখন খুব বেশি তৎপর না হলেও তারা রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামলেই গণহারে ধরপাকড় শুরু হবে। তখন আওয়ামী লীগের যেসব নেতাকর্মী এজাহারভুক্ত আসামি নন, তাদের সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার করা হবে। এছাড়া পুলিশ প্রশাসনে এখনো যে নিস্ক্রিয়তা রয়েছে, তা কাটলেও আশপাশের এলাকায় অবস্থান করা কঠিন হবে বলেও মনে করেন তারা।

বাড্ডা থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতা জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন মামলায় গণহারে দলের নেতাকর্মীদের এজাহারভুক্ত আসামি করা হয়েছে। এছাড়া প্রতিটি মামলায় শত শত অজ্ঞাত আসামি রয়েছে। তাই তারা কেউই নিরাপদ নন। মামলার এজাহারে নাম না থাকলেও পুলিশ তাদের আটক করে সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার দেখাতে পারে। তাই দলের নেতাকর্মী কারোরই মামলা থেকে রক্ষা পাওয়ার সুযোগ নেই। এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রেখেই সবাই চলাফেরা করছে।

পুলিশ সদরদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ৬ আগস্ট থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩৯০ জন সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও সিটি করপোরেশনের মেয়রদের বিরুদ্ধে মোট এক হাজার ১৭৪টি মামলা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, হাসিনার উপদেষ্টাসহ প্রায় একশ' জনকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এরমধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বোচ্চ ২২০টি মামলার আসামি। এ ছাড়া, তার বোন শেখ রেহানা ২২টি, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ১৯টি, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল চারটি এবং ভাতিজা রিদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি একটি মামলার আসামি। সাবেক মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৯৯টি মামলার আসামি। এ ছাড়া, সাবেক সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ১৬৯টি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহমুদ ৭২টি এবং আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ৫৯টি মামলায় আসামি হয়েছেন।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানককে ৪১টি মামলায় এবং সাবেক বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে ২৪টি মামলার আসামি করা হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের বিরুদ্ধে ৩৮টি এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ২০টি মামলা রয়েছে।

মামলার মুখোমুখি অন্য উলেস্নখযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত, সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান। তাদের বিরুদ্ধে যথাক্রমে ৫৪, ৪৪ ও ৪১টি মামলা হয়েছে। ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের নামে যথাক্রমে ৩১ ও ৩০টি মামলা রয়েছে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাবেক সভাপতি শাহরিয়ার কবিরকে নয়টি মামলায় আসামি করা হয়েছে।

এ ছাড়া, বর্তমান ও সাবেক ৪৪৯ জন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রায় ৩০০ মামলা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে পুলিশের দুই সাবেক মহাপরিদর্শকসহ ২১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলার মধ্যে চার সাবেক আইজিপির বিরুদ্ধে ১৩৬টি, সাবেক ১৬ অতিরিক্ত আইজিপির বিরুদ্ধে ১৮২টি, চারজন অতিরিক্ত আইজিপির বিরুদ্ধে ২৫টি, সাবেক ছয় ডিআইজির বিরুদ্ধে ২৩টি, সাত ডিআইজির বিরুদ্ধে ১৪০টি, ২৬ অতিরিক্ত ডিআইজির বিরুদ্ধে ১৯৭টি এবং ৪২ জন এসপির বিরুদ্ধে ৯৭টি মামলা হয়েছে।

পুলিশ সদরদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-মিডিয়া) এনামুল হক সাগর বলেন, নতুন পুলিশ সুপার (এসপি) ও কমিশনারদের জেলা ও মেট্রোপলিটন এলাকায় নিয়োগ দিয়ে ইউনিট প্রধান পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে, এসপি ও কমিশনাররা পুলিশ সদস্যদের মনোবল বাড়িয়েছেন। এখন পুলিশ পুনরায় পুরোদমে কার্যক্রম শুরু করেছে। এ কারণে প্রথম দিকে আসামি গ্রেপ্তারের সংখ্যা কম থাকলেও এখন তা বেড়েছে। আসামিদের অবস্থান সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া গেলে তাকে গ্রেপ্তারে কোনো ধরনের অবহেলা করা হবে না বলে দাবি করেন তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে