আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে বিভিন্ন দাবি নিয়ে বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ ও ধর্মঘটের ডাক দেওয়ার ঘটনা এখন নিত্যদিনের চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব কর্মসূচি ঘিরে তীব্র যানজট, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, এমনকি সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে সরকার এসব আন্দোলন কর্মসূচি সামাল দেওয়ার চেষ্টা চালালেও দেশের সার্বিক পরিস্থিতি প্রায়ই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি তীব্র জনভোগান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে অচলাবস্থা দেখা দিচ্ছে।
পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, যেসব দাবি নিয়ে বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ ও ধর্মঘটসহ বিভিন্ন কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে, এর কিছু সংখ্যক যৌক্তিক হলেও সময়োপযোগী নয়। এসব আন্দোলনের নেপথ্যে দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র রয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংঘবদ্ধ স্বার্থান্বেষী মহলের ইন্ধন রয়েছে। ফ্যাসিস্টগোষ্ঠীকে পূনর্বাসনে এ চক্রান্ত চলছে বলেও সংশ্লিষ্টরা অনুমান করছেন।
পুলিশ ও গোয়েন্দাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে প্রায় ছয় মাসে ঢাকাসহ সারাদেশে ছোট-বড় মিলে চারশতাধিক আন্দোলন হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, শিল্প-কারখানার শ্রমিক, ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ নানা ধরনের দাবি-দাওয়া নিয়ে এসব কর্মসূচি পালন করেছে। এছাড়া গত দেড় দশকে বঞ্চিত দাবি করেও অনেকে বিক্ষোভ-অবরোধে নেমেছে। শুধু জানুয়ারি মাসেই ঢাকাতেই ৪২টি আন্দোলন কর্মসূচি পালিত হয়।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, আন্দোলন কর্মসূচিতে নামার আগে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে দাবিনামা পেশ করা হয়নি। এমনকি কোনো ধরনের আলোচনা-সমঝোতারও সুযোগ দেয়নি আন্দোলনকারীরা। বরং দাবি আদায়ের নামে তারা আকস্মিক সড়কে নেমে বিক্ষোভ, অবরোধ ও সংঘাত-সহিংসতায় জড়িয়ে
পড়েছে। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন যানবাহন, শিল্পকারখানা, অফিস-আদালত ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী আন্দোলনের একটি বড় অংশ সুপরিকল্পিতভাবে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির টার্গেট করে করা হয়েছে। বেশকিছু আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসররা ইন্ধন দিচ্ছে। এমনকি এসব আন্দোলন বেগবানে মোটা অংকের অর্থ যোগান দেওয়ারও তথ্য প্রমাণ মিলেছে। বেশকিছু তুচ্ছ দাবি আদায়েও স্বার্থন্বেষীগোষ্ঠী আন্দোলনকারীদের রাজপথ অবরোধ ও ধর্মঘট ডাকতে উসকে দিয়েছে। এসব আন্দোলন কর্মসূচি সামলাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপরাধ নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট সময় দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টদের ধারণা গুম, খুন, অর্থপাচার, অনিয়ম-দুর্নীতি, দখলবাজি, লুটপাট, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অপকর্ম-দুঃশাসনের কারণে সদ্য ক্ষমতাচু্যত আওয়ামী লীগের ইমেজ তলানিতে এসে ঠেকেছে। স্বল্প হ পৃষ্ঠা ২ কলাম ২
সময়ের মধ্যে দলের শীর্ষ নেতাদের দুর্নীতির বিশাল ফিরিস্তি প্রকাশ পেয়েছে। বড় বিপদে দলের নীতি-নির্ধারকরা যে শুধু নিজেদের রক্ষাতেই মরিয়া ৫ আগস্টের পর সে চিত্রও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা যে আগের মতো দলীয় নির্দেশনা পেলেই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে না তা দলীয় হাইকমান্ড ভালোভাবেই টের পেয়েছে। এছাড়া সাধারণ জনগণেরও এ দলটির ওপর দীর্ঘদিনের আস্থায় বড় ফাটল ধরেছে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের পক্ষে রাজনৈতিক কর্মসূচির ডাক দিয়ে দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা যে কঠিন হবে এ ব্যাপারে ইতোমধ্যেই দলের নীতি-নির্ধারকরা স্পষ্ট বার্তা পেয়ে গেছেন। তাই দলীয়ভাবে আন্দোলনে নামার আগে তারা নানা ইসু্যতে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষকে উসকে দিয়ে মাঠ তৈরির ফন্দি এঁটেছে। আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতারা এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত বলে মনে করেন তারা।
ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এ ব্যাপারে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। ওই নেতাদের ভাষ্য, ৫ আগস্টের পর তাদের কোনো রকম বুঝতে না দিয়েই রাতারাতি শীর্ষ নেতারা পালিয়ে যাওয়ার পর তারা ভয়ঙ্কর বিপদে পড়েন। মাঠপর্যায়ের স্বল্প সংখ্যক নেতাকর্মী বিদেশে কিংবা সুবিধাজনক স্থানে আত্মগোপন করতে পারলেও বাকিরা আশপাশের এলাকায় গা ঢাকা দেন। তবে বিএনপি-জামায়াত ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে তারা কেউ কেউ এলাকায় ফিরে এসেছেন। এ পরিস্থিতিতে নতুন করে আওয়ামী লীগের কোনো আন্দোলন কর্মসূচিতে যোগ দিলে তাদের মামলা-হামলা ও গ্রেপ্তারের শিকার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে নানা শ্রেণিপেশার মানুষের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে তাদের বিক্ষোভ, অবরোধ ও ধর্মঘটের মতো আন্দোলন কর্মসূচিতে নামিয়ে দলীয় হাইকমান্ড আগে মাঠ গরম করার চেষ্টা করছে।
ওই নেতাদের দাবি, যেসব নেতারা এসব ছক এটে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন, তাদের বেশিরভাগই হয় ভারতে, না হয় কারাগারে রয়েছেন। তাই অবস্থানগতভাবে তাদের কোনো ঝুঁকি নেই। কিন্ত যেসব নেতাকর্মীরা কোনো রকমে গা বাঁচিয়ে এলাকায় রয়েছেন, কৌশলগত কারণেই তারা এ মিশনে অংশ নিতে ভয় পাচ্ছেন। তবে প্রত্যক্ষভাবে অংশ না নিলেও কোনো কোনো নেতা এসব আন্দোলন কর্মসূচিতে গোপনে অর্থায়ন করছেন। যদিও তাদের সংখ্যা খুবই সীমিত- যোগ করেন ওই নেতারা।
এদিকে গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতা হারানোর প্রায় ছয় মাসের মাথায় অন্তর্বর্তী সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আগামী ১৬ ও ১৮ই ফেব্রম্নয়ারি আওয়ামী লীগের হরতাল-অবরোধের ডাক এবং নিজেদের দাবির পক্ষে জনসমর্থন আদায়ে আগামী পহেলা ফেব্রম্নয়ারি থেকে পরবর্তী দুই সপ্তাহ সারাদেশে লিফলেট বিতরণ ও বিক্ষোভ-সমাবেশ পালনের যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, তা তাদের আগের মিশনেরই অংশ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের ভাষ্য, গত ছয় মাসে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের আন্দোলনে আওয়ামী লীগের ইমেজ পুনরুদ্ধারে মাঠে নামার পথ কতটা প্রশস্ত হয়েছে, এটা তারই 'টেস্ট কেস'। আগামী ৬ ফেব্রম্নয়ারি থেকে ১৮ ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত প্রায় দু'সপ্তাহ আন্দোলনের মাঠে তারা কতটা টিকতে পারে এর মাধ্যমে তা যাচাই করবে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা, এ যাত্রায় আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হলেও ফের একই কৌশলে এগোনোর চেষ্টা করবে। বিকল্প কোনো পথ খোলা না থাকায় সদ্য ক্ষমতা হারানো এ দলটি নতুন করে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষকে নানা দাবি তুলে আন্দোলনের মাঠে নামানোর চেষ্টা করবে। তাই সরকারের উচিত এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থেকে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ করা। পাশাপাশি এ ব্যাপারে আগেভাগেই তথ্য সংগ্রহে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে অ্যালার্ট করা জরুরি বলে মনে করেন তারা।
প্রসঙ্গত, বরিশালের রূপাতলীতে বাস ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও শ্রমিকদের ওপর হামলার ঘটনায় দোষীদের বিচারের দাবিতে গত বুধবার থেকে বাস শ্রমিক সংগঠন অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট শুরু করে। এতে দক্ষিণাঞ্চলের ১৬টি রুটে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। শুধু বাস চলাচলই নয়, দূরপালস্নার যাত্রী নিতে চাওয়া থ্রি-হুইলারগুলোও শ্রমিকরা আটকে দেয়। ফলে বরিশাল-খুলনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, পটুয়াখালী, কুয়াকাটা, ভোলা ও আরও কয়েকটি রুটের যাত্রীরা চরম দুর্ভোগে পড়েন। অথচ স্থানীয়দের অভিযোগ, শ্রমিকরা সরকারি ব্রজমোহন কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানোর পর উল্টো নিজেরা ধর্মঘটের ডাক দেয়। এ আন্দোলনের নেপথ্যে ভিন্ন কোনো ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে মনে করেন তারা।
এদিকে রাস্তা আটকে ফ্যাক্টরি করার প্রতিবাদে বুধবার দুপুরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে আন্দোলনে নামে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার গোলড়া গ্রামবাসী। এতে ৫ ঘণ্টা ওই মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। ফলে সেখানে মহাসড়কে যানবাহনের দীর্ঘ সারি সৃষ্টি হয়।
হাইওয়ে পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জনসাধারণের চলাচলের রাস্তা আটকে কোম্পানি প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে বেলা সোয়া ১১টার দিকে সাটুরিয়া উপজেলার নয়াডিঙ্গী এলাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে আন্দোলন শুরু করেন গোলড়া গ্রামবাসী। এরপর থেকে মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ সময় যান চলাচল বন্ধ থাকায় মহাসড়কের উভয়দিকে কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যানবাহনের দীর্ঘ সারি সৃষ্টি হয়।
গোলড়া হাইওয়ে থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রুপল চন্দ্র দাস বলেন, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের নয়াডিঙ্গী ও গোলড়া বাসস্ট্যান্ডর মাঝামাঝি এলাকা থেকে গোলড়া গ্রামে যাতায়াতের মেঠোপথের সড়ক ছিল। পরে ওই জমি কিনে নিয়ে ফ্যাক্টরি নির্মাণ করলে পায়ে হাঁটার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। গোলড়া গ্রামের লোকজন পুরনো সেই রাস্তা বহালের দাবিতে মহাসড়কে অবস্থান নেন। কর্মসূচিতে নামার আগে গ্রামবাসী এ ব্যাপারে প্রশাসনের কাছে কোনো ধরনের অভিযোগ করেননি বলে দাবি করেন তিনি।
রাজধানীতে চলাচল করা লাব্বাইক পরিবহণে এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে ২৯ জানুয়ারি দুপুরে রাজধানীর মৌচাক মোড় এলাকায় সড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। প্রায় একই সময় রামপুরা সড়ক অবরোধ করেন স্থানীয়রা। বাস চাপায় এক শিশুর মৃতু্যর ঘটনাকে কেন্দ্র করে সড়ক অবরোধ করা হয় বলে জানায় পুলিশ। চট্টগ্রাম নগরীর শাহ আমানত ব্রীজ এলাকায় প্রায় এক ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করার ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ জানিয়েছে, ঈগল পরিবহণে বাস মালিকদের টাকা লেনদেন সংক্রান্ত বিরোধের জেরে সড়ক অবরোধ করে বাসের চালক ও সহকারীরা।
২৯ জানুয়ারি বিকালে পরিবহণ শ্রমিকদের অবরোধের কারণে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের প্রবেশমুখে প্রায়ই এক ঘণ্টা যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। পুলিশ জানায়, ঈগল পরিবহণের বাস মালিকদের দু'টি গ্রম্নপের মধ্যে বাসের ভাড়ার টাকা নিয়ে ঝামেলা সৃষ্টি হওয়ায় ওই বাসগুলোর চালক ও সহকারীরা রাস্তার একপাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বন্ধ করে দেন। প্রায়ই এক ঘণ্টা রাস্তা বন্ধ থাকায় ওই এলাকায় সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। এতে দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা।
চলমান ভাতা বেতনের সঙ্গে যুক্ত করে পেনশন ও গ্র্যাচুইটির সুবিধার দাবিতে সোমবার মধ্যরাত থেকে রানিং স্টাফদের ধর্মঘটে সারাদেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। টানা দু'দিন এ ধর্মঘট চলাকালে সাধারণ মানুষকে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। সরকারের বিশাল অংকের অর্থ গচ্চা যায়।
খুলনা বিভাগীয় ট্যাংকলরি শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আলী আজিমকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ ও মুক্তির দাবিতে ২৭ জানুয়ারি থেকে তিনটি ডিপো থেকে তেল উত্তোলন বন্ধ রেখে কর্মবিরতি পালন করেন শ্রমিকরা। ফলে খুলনাসহ ১৬ জেলায় জ্বালানি তেল সরবরাহ ও পরিবহণ বন্ধ হয়ে যায়। সরকারের আশ্বাসে ২৯ জানুয়ারি এ আন্দোলন স্থগিত করা হয়। তবে এ কর্মসূচির কারণে আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি জনভোগান্তি চরমে পৌঁছে।
মাসিক ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে বিক্ষোভ করেন বিভিন্ন স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত পোস্টগ্র্যাজুয়েট বেসরকারি প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসকরা। রোববার বেলা ১টায় শাহবাগ মোড় অবরোধ করে এ বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন তারা।
প্রায় একই সময় চার দফা দাবিতে 'সাধারণ ম্যাটস শিক্ষার্থী ঐক্য পরিষদ'-এর ব্যানারে একদল শিক্ষার্থী রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথমে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে সেখান থেকে সরে গিয়ে শাহবাগ মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন।
এর আগে ১৭ আগস্ট পরীক্ষা ছাড়া অটোপাসসহ বিভিন্ন দাবিতে প্রেস ক্লাবের সামনেসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় আন্দোলনে নামে এইচএসসি শিক্ষার্থীরা। ২০ আগস্ট অটোপাসের দাবিতে সচিবালয়ে ঢুকে পড়ে এইচএসসি শিক্ষার্থীরা। ২১ আগস্ট গাজীপুরে বকেয়া বেতন-ভাতার দাবিতে সড়ক অবরোধ করে আন্দোলনে নামে বেক্সিমকোসহ ৬ কারখানার কর্মীরা। ২৫ আগস্ট জাতীয়করণের দাবিতে সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি দেন সাধারণ আনসার সদস্যরা। ওইদিন তাদের সরে যেতে বললে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার সঙ্গে আনসারদের সংঘর্ষ ও মারামারির ঘটনা ঘটে। এর আগে এক সপ্তাহ ধরে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় রাস্তা বন্ধ করে ধারাবাহিক আন্দোলন করেন আনসার সদস্যরা। মূলত আনসারদের আন্দোলন থেকে নেপথ্য ইন্ধনের বিষয়টি সামনে আসে। ২৫ আগস্ট ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের দাবিতে শাহবাগ অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন প্যাডেলচালিত রিকশাচালকরা।
সেপ্টেম্বরে একশ'র কাছাকাছি ছোট-বড় আন্দোলন হয়েছে। ৭ সেপ্টেম্বর চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ করার দাবিতে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন শিক্ষার্থীর। তারা সব ধরনের যানচলাচল বন্ধ করে দিলে আশপাশের সড়কে তীব্র যানজট তৈরি হয়ে ভোগান্তিতে পড়ে মানুষ। ১১ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের টঙ্গীতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন পোশাক শ্রমিকরা। সেপ্টেম্বরে ছয় দফা দাবিতে রাজধানীতে সড়ক অবরোধ করে অচল করে দেন কারিগরি শিক্ষার্থীরা। ঢাকা কলেজের বাস ভাঙচুরে জড়িতদের বিচার দাবিতে সায়েন্সল্যাবে সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অটোপাসের দাবিতে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন।
অক্টোবর ও নভেম্বরে দেড় শতাধিক আন্দোলন হয়েছে। ১৮ অক্টোবর তিতুমীর কলেজকে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীতকরণে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। তাদের অবরোধে পুরো ঢাকা শহর অচল হয়ে পড়ে এবং দেশের বহু অঞ্চলের সঙ্গে রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। তারা রেলের কোচ ভাঙচুর করে। এতে শিশুসহ অনেকে আহত হন। তাদের আন্দোলনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা যোগ দিয়েছিলেন বলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছিলেন। ২০ অক্টোবর সিটি কলেজ ও ঢাকা কলেজের সংঘর্ষে সায়েন্সল্যাব অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ২১ অক্টোবর রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকায় রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা। তারা মহাখালীতে রেললাইন অবরোধ করেন। ওইদিন গাজীপুরে চন্দ্রা-নবীনগর সড়ক টানা ছয়দিন অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের শ্রমিকরা। ২২ অক্টোবর জুরাইনে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। আন্দোলনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯ নভেম্বর রাজধানী থেকে তিনদিনের মধ্যে ব্যাটারিচালিত রিকশা উচ্ছেদের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এর প্রতিবাদে চালক পরিচয়ে আন্দোলনে নেমে রাজধানী অচল করে দেওয়া হয়।
অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কিছু ব্যবসায়ী ও স্থানীয় পর্যায়ের কিছু নেতা পর্দার আড়ালে থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের আন্দোলনে অর্থের জোগান দেন। তারা আন্দোলনে নেতৃত্ব এবং অর্থ দিয়ে ইন্ধন দেওয়ার প্রমাণ পান গোয়েন্দারা। ওই সময় একটি ভিডিওতে এক আন্দোলনকারী নিজেকে ছাত্র পরিচয় দিয়ে রিকশা চালাতে এসেছেন- এমন দাবি করেন। পরে দেখা যায়, ওই ব্যক্তি ছাত্রলীগের কর্মী। তার নাম আশরাফুল খান। তিনি খিলক্ষেত ৪৩নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সহসভাপতি। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে অনেক অনুষ্ঠানে তার থাকার ছবি প্রকাশিত হয়েছে।
গোয়েন্দারা জানান, এ রকম আশরাফুল একজন নন, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এবং ছাত্রলীগদের হাজার হাজার নেতাকর্মী সুপরিকল্পিতভাবে এসব আন্দোলনে ইন্ধন দেওয়ার প্রমাণ পেয়েছেন তারা। দলীয় পরিচয় গোপন করে এসব আওয়ামী লীগের কর্মীরা আন্দোলনের মধ্যে ঢুকে সহিংসতা ছড়ানোর অপচেষ্টা চালিয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, জনগণের ভোগান্তি হয়- এমন যে কোনো কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থান। আন্দোলনের নেপথ্যে কোনো স্বার্থান্বেষীগোষ্ঠী আছে কি না, সেটি খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা।