কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নাটকীয়ভাবে নিজেকে পাল্টে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু ক্ষমতা যাদের হাতে, তারা ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যে বিরাট উন্নতি হতে যাচ্ছে- তার জন্য কতটা প্রস্তুত? ২০১৯ সালে 'ওপেনএআই' নামের একটি গবেষণা দল 'জিপিটি-টু' নামের এমন একটি সফটওয়্যার তৈরি করেছিল, যেটি শুধুমাত্র প্যারাগ্রাফের একটি ইঙ্গিতপূর্ণ টেক্সট লিখতে পারত। তাছাড়া এই সফটওয়্যার সুনির্দিষ্ট নির্দেশ ছাড়া কোনো কিছু পড়েও তা মোটামুটি বুঝতে পারত এবং কিছুটা বিশ্লেষণ করতে পারত। 'ওপেনএআই' শুরুতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তাদের তৈরি এ সফটওয়্যার সবার ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত হবে না। তাদের আশংকা ছিল, লোকে এটি ব্যবহার করে ব্যাপক হারে অপপ্রচার এবং মিথ্যাচার চালাবে। গবেষক দলটি বলেছিল, এটি খুব বেশি বিপদজনক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় যে বিষয়টি প্রকট হয়ে উঠতে পারে, সেটা হচ্ছে বৈষম্য। এর ফলে মানুষে মানুষে, সমাজে সমাজে এবং দেশে দেশে এই বিভাজন বেড়ে যাবে। এক সময় ধারণা করা হতো- একই ধরনের যেসব কাজ বারবার করতে হয়, কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তার পক্ষে শুধু সেসব কাজই করা সম্ভব; এ প্রযুক্তি মানুষের করে দেওয়া প্রোগ্রামের বাইরে যেতে পারবে না।
'ওপেনএআই'-এর জিপিটি-টু সীমিত কিছু ব্যবহারকারীর মধ্যে ছাড়া হয়েছিল। কিন্তু গত নভেম্বর ২০২২ যখন তারা জিপিটি-থ্রী বাজারে ছাড়ল, তা সবার ব্যবহারের জন্যই উন্মুক্ত করে দেওয়া হলো। বিশেষজ্ঞরা যখন এই প্রোগ্রামিং-এর চ্যাটবট-জিপিটির সক্ষমতা পরীক্ষা করে দেখছিলেন, তখন তাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। সম্প্রতি মার্চ ২০২৩ 'ওপেনএআই' তাদের সর্বশেষ সংস্করণ জিপিটি-ফোর চালু করার সময় তারা বলেছিল, অপব্যবহার বন্ধের জন্য এটির ভেতরে নানা ব্যবস্থা করা আছে। প্রথম যারা এর গ্রাহক হয়েছে তাদের মধ্যে আছে মাইক্রোসফট, মার্কিন ব্যাংক মেরিল লিঞ্চ এবং আইসল্যান্ডের সরকার। সর্বসাধারণের কল্যাণে এই কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তার সমস্ত উন্নতি ঘটানো হবে এবং সিস্টেমগুলোর ডিজাইনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হবে। এখানে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে মানুষের জীবন সহজ ও বাধাহীন করার কাজে। ভোক্তাদের ঠিক কী ধরনের পণ্য দরকার, কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা তা বুঝে সাহায্য করতে পারবে। চ্যাটবট-জিপিটি ব্যবহার করে হাজার হাজার সংবাদ প্রতিবেদন এবং সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট লেখা হয়েছে। কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তার অন্যান্য মডেল যেমন ডাল-ই এমন নিখুঁত ছবি তৈরি করেছে যে, এগুলো আর্ট ওয়েবসাইটে দেওয়া উচিত কি-না তা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। মার্চ ২০২৩ সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তার সম্ভাবনা এবং ক্ষমতা। হোয়াইট হাউসের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নীতি বিষয়ক দফতরের পরিচালক আরতি প্রভাকর কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তার সম্ভাবনা নিয়ে একটা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন- 'এটি হলো অসম্ভব শক্তিশালী এক প্রযুক্তির আবির্ভাব। এ ধরনের শক্তিশালী নতুন প্রযুক্তি ভালো-মন্দ উভয় কাজেই ব্যবহৃত হয়।'
কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা চ্যাটবট থেকে এমন কিছু বিপদ হতে পারে, যা রীতিমত ভয়ঙ্কর। তাহলে মানুষের সঙ্গে কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তার এই প্রতিযোগিতা কী কখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে? ভুয়া খবর ছড়ানোর পেছনে সরাসরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নেই। কিছু মানুষ রাজনৈতিক ফায়দা নিতে ভুয়া খবর তৈরি করছে। তারপর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহার করে তারা সেই খবরটা ছড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা মানুষকে সাহায্য করছে- খবরটা ভুয়া কি-না সেটা পরীক্ষা করে দেখতে। অ্যামি ওয়েব হচ্ছেন ফিউচার টুডে ইন্সটিটিউটের প্রধান এবং নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক। তিনি বলেছেন, 'কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তার সমস্ত উন্নতি ঘটানো হবে সর্বসাধারণের কল্যাণে। কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা এই সিস্টেমগুলোর ডিজাইনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে। এখানে প্রযুক্তি ব্যবহৃত হবে মানুষের জীবন সহজ এবং বাধাহীন করার কাজে। ভোক্তাদের ঠিক কী ধরনের পণ্য দরকার- কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা তা আঁচ করতে পারবে এবং যেকোন কাজ সম্পাদনেই সাহায্য করতে পারবে।' অ্যামি ওয়েব কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা নিয়ে যে দৃশ্যকল্প অনুমান করছেন, সেখানে ডেটা নিয়ে ব্যক্তিগত গোপনীয়তায় কম সুরক্ষা থাকবে। অল্প কয়েকটি কোম্পানির হাতে অনেক বেশি ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হবে এবং কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা মানুষের চাহিদা আগে থেকেই অনুমান করবে। তবে তাদের অনেক সময় ভুল হবে অথবা মানুষের পছন্দকে তারা অনেক বেশি সংকুচিত করে ফেলবে।
চ্যাটজিপিটির মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে এখন অনেক কিছুই করা সম্ভব, যা মানুষ ভাবতেও পারেনি। চ্যাটজিপিটির সঙ্গে রসিকতা করলে সে বুঝতে পারে। শুধু তাই নয়, ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নতুন নতুন জিনিস শিখতে পারে এবং এর মধ্য দিয়ে সে নিজেকে আরও বেশি সমৃদ্ধ করতে থাকে। এ প্রযুক্তিটি আসলে কোনদিকে যাবে, তা নির্ভর করবে কোম্পানিগুলো কতটা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয় তার ওপর। অতীতে ফেসবুক, টুইটার, গুগল বা এ ধরনের সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোর বেলায় যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সেটা একটা উদাহরণ হতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে অশনি সংকেতের সেই কাহিনী মানুষের নিশ্চয়ই মনে আছে। সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোর ওপর ফেডারেল নজরদারি মূলত ১৯৯৬ সালে নিয়ন্ত্রিত। আইনের ধারায় ইন্টারনেট কোম্পানিগুলোকে ব্যবহারকারীদের তৈরি করা কনটেন্টের জন্য তাদের ওপর দায় চাপানোর ব্যাপার থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছে। এ আইনের ফলে এমন একটা পরিবেশ তৈরি সম্ভব হয়েছে, যাতে সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলো ভালো ব্যবসা করতে পারে। কিন্তু সম্প্রতি আবার এ আইনকেই দোষারোপ করা হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলো এতে বেশি ক্ষমতাশালী এবং প্রভাবশালী হয়ে ওঠার জন্য। ডানপন্থী রাজনীতিকরা অভিযোগ করেন, এর ফলে গুগল বা ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠান রক্ষণশীল মতাদর্শকে সেভাবে সামনে না আনার ক্ষমতা পেয়েছে। অন্যদিকে বামপন্থীদের অভিযোগ, এসব কোম্পানি ঘৃণা এবং সহিংসতার হুমকি রোধে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করছে না।
সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা সবচেয়ে বড় বড় কোম্পানি যেমন ফেসবুক, গুগল, আমাজন, অ্যাপল এবং মাইক্রোসফট- এরাই এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে। কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা এবং সোশ্যাল মিডিয়ার এ তুলনা কেবল তাত্ত্বিক নয়। নতুন যে কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি তৈরি হচ্ছে, সেগুলো ফেসবুক, ইউটিউব বা টুইটারের মতো সাইটের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এরপর এগুলোকে ভুল তথ্য আর মিথ্যাচারের এক সমুদ্রে পরিণত করতে পারে। কারণ সত্যিকারের মানুষ থেকে ভুয়া মানুষের পোস্ট আলাদা করা তখন আরও বেশি কঠিন হয়ে পড়বে। কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা দিয়ে পরিচালিত ভুয়া একাউন্টগুলো তখন এমনভাবে পরিচালিত হবে যে, তাদের বিশ্বাস না করার কোনো কারণ থাকবে না। সরকার যদি সোশ্যাল মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং নতুন নীতি তৈরিতে সফল হয়, তবে কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা ভুয়া তথ্যের বন্যায় যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে যাবে; এসব নতুন রেগুলেশন তখন অর্থহীন হয়ে পড়বে।