বাতাসে দোল খাচ্ছে সুগন্ধি ধানের শীষ। এ ধানের চালের কদর সর্বত্রই। সুগন্ধিযুক্ত চাল দেশে-বিদেশেও সমাদৃত। জনপ্রিয় হওয়ায় উপজেলায় এ ধানের চাষ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বছর এ ধানের ফলনও ভালো হয়েছে। আগামী দুই-এক সপ্তাহের মধ্যেই কাটা- মাড়াই শুরু হবে। প্রাকৃতিক কোন দুর্যোগ না হলে বাম্পার ফলনের আশা করছেন কৃষকরা। তবে ধানের দাম নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে তারা।
সরেজমিনে উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, ধানের সবুজগাছ হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে। চারিদিকে বাতাসে ঢেউয়ের মতো দোল খাচ্ছে সোনালী ধানের শীষ। সুগন্ধি ধানের গন্ধে ম' ম' করছে ফসলের মাঠ। মাঠে ধান দেখে কৃষকদের চোখ-মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। তবে কৃষকরা ধানের ন্যায্য দাম পাওয়া নিয়ে আছেন দুশ্চিন্তায়।
জানা গেছে, কয়েক বছরে সুগন্ধি ধানের চাষাবাদে আমূল পরিবর্তন এসেছে।দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে সবচেয়ে বেশি সুগন্ধি ধানের আবাদ হয়। এখনও ঐতিহ্য ধরে রাখতে দিনাজপুরে কিছু সুগন্ধি বাদশাভোগ ধান উৎপাদিত হয়। শুধু বাদশাভোগ ধানই নয়- রয়েছে চিনি কাটারি, জিরা-৩৪, জিরা কাটারি, জটা কাটারি, কাটারিভোগ, ফিলিপাইন কাটারি, কালোজিরা, চল্লিশ জিরাসহ বেশ কয়েক প্রজাতির সুগন্ধি ধান। এসব ধানের চাল দেখতে সরু ও লম্বা। এর অগ্রভাগ ছুরির মত একটু চোখা ও বাঁকা। উঁচু বেলে-দো-আঁশ মাটি কাটারিভোগ ধান চাষের জন্য উপযোগী। কাটারিভোগ ধানের চিড়া প্রসিদ্ধ। এ ধানের চাল দিয়ে পোলাও, বিরিয়ানি, জর্দা, পায়েস, ফিরনি প্রভৃতি তৈরি করা যায়। এ চাল সুগন্ধযুক্ত ও সুস্বাদু। বিত্তবান ও মধ্যবিত্তরা এসব চালের ভাত খেয়ে থাকেন। এছাড়াও বিভিন্ন উৎসব, অনুষ্ঠান, হোটেল-রেস্তোরাঁয় অনেকাংশে সুগন্ধি চালের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। সব মিলিয়ে সুগন্ধি চালের চাহিদা দিনদিন ঊর্ধ্বমূখী।
উপজেলার মথুরাপুর গ্রামের কৃষক সাইফুদ্দিন বলেন, এবছর আমি ২২ বিঘা জমিতে সুগন্ধি ধান চাষ করেছি। ফলনও ভালো হইছে। শেষ সময় এসে ভুইত (ক্ষেতে) পোকার আক্রমণ দেখা দিছে। তাই উৎপাদন খরচও বেশি বারি গেইছে। ধান কাটা- মাড়াইয়ের পর ধানের দাম ভালো থাকলে লাভবান হব। ভালো দাম না পাইলে ক্ষতি হবে।
একই গ্রামের কৃষক আরিফুল ইসলাম বলেন, ৪ একর জমিত আমি সুগন্ধি ধান নাগাইছি। ধানের ফলন বেশ ভালো হইছে। তবে বিগত বছরের তুলনায় ব্যয় অনেক বেশি। ধান রোপনের সময় দেওয়ার (আকাশের) পানি আছিল না। জমিত সেচ দিয়ে পানি দিতে হইছে। সার ও কীটনাশকের দামও বেশি। ধান কাটা পাইটের (শ্রমিকদের মজুরি)
দামও বেশি। ধানের দামটা ভালো পেলেই হয়। না হলে ক্ষতি হইবে।
ভিয়াইল গ্রামের কৃষক আব্দুল খালেক হোসেন বলেন, সুগন্ধি ধানের ফলন ভালো হয়েছে। তবে শেষ সময়ে এসে ধানে কিছু পোকার আক্রম দেখা দিয়েছে। এতে ধান উৎপাদনে খরচ বাড়ছে। তবে জিরাধানে গত বছরের তুলনায় এবার খরচ বাড়ছে দ্বিগুণ। ধানের বাজার নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তা আছে। কারণ হিসেবে তিনি জানান, কাটা-মাড়াইয়ের সময় এ ধানের দাম কমে যায়। তখন ন্যায্য দামে আমরা কৃষকরা ধান বিক্রি করতে পারি না।
একই গ্রামের কৃষক উদয় রায় বলেন, জিরা-৩৪ সুগন্ধি ধানের বাম্পার ফলন হইছে। কৃষি বিভাগের পারার্মশে এবার আমি ২ বিঘা জমিত সুগন্ধি ধান লাগাইছি। কয়েক বছরের তুলনায় খরচ দুইগডণ বারি গেইছে। গত বছরের ৮০০ টাকার সার এইবার ১ হাজার ৪০০ টাকা দিয়া কিনতে নাগোচে (লাগছে)। কীটনাশকের দামও বারি গেইছে। তেলের দামও বেশি। কাটা-মাড়াই শুরু হইলে ধানের বাজার কমি (কমে) যায়। ধানের বাজার যদি প্রতিবস্তা সাড়ে ৪ হাজার টাকার উপর না থাকে তাহলে কৃষকরা লাভবান হতে পারবে না। গত বছর কাটা-মাড়াইয়ের সময় প্রতিবস্তা ধান ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা ছিল।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ জোহরা সুলতানা শারমিন বলেন, দিনাজপুরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুগন্ধি ধানের আবাদ হয় চিরিরবন্দরে। সুগন্ধি ধান দিনাজপুরের একটি ঐতিহ্য। ইতিমধ্যে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ফলে কাটারিভোগ ধান এখন বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিনিধি। সুগন্ধি ধানের আবাদ বৃদ্ধিতে কৃষি বিভাগ সর্বদাই কৃষকদের বিভিন্ন পরামর্শ ও সহযোগিতা দিয়ে আসছে। গত বছরের তুলনায় এবছর সুগন্ধি ধানের ফলনও ভালো হয়েছে। সুগন্ধি ধানের মধ্যে জিরা-৩৪'র আবাদ বেশি হয়েছে। কৃষকরা জমিতে সঠিক সময় কীটনাশক স্প্রে না করায় শেষ সময়ে কিছু জমিতে পোকার আক্রমণ দেখা দিয়েছে।
যাযাদি/সাইফুল