আজ পহেলা ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের যে মাসে ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিল রফিক-জব্বার-সালাম-বরকতসহ নাম না জানা অনেকে। তাদের সেই অমøান স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আজ দ্বার খুলছে বাঙালির প্রাণের মেলা অমর একুশে বইমেলা-২০২৪।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বিকাল ৩টায় বইমেলার উদ্বোধন করবেন। তিনি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘কালেক্টেড ওয়ার্কস অব শেখ মুজিবুর রহমান : ভলিউম-২’সহ কয়েকটি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের পাশাপাশি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ বছর বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত ১৬ গুণীর হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে পদক তুলে দেবেন।
বইমেলার ৪০তম বছরে প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘পড়ো বই গড়ো দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’। এবারও বইমেলা অনুষ্ঠিত হবে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রায় সাড়ে ১১ লাখ বর্গফুট জায়গায়। এ বছর ৬৩৫টি প্রতিষ্ঠান ৯৩৭টি ইউনিটে তাদের বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসবে। এর মধ্যে একাডেমি প্রাঙ্গণে ১২০টি প্রতিষ্ঠানকে ১৭৩টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৫১৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৭৬৪টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে দেড় শতাধিক স্টলে বসবেন লিটলম্যাগ সম্পাদকরা। ২০২৩ সালের বইমেলায় অংশ নিয়েছিল ৬০১টি প্রতিষ্ঠান। সেই হিসাবে এবার প্রকাশনা সংস্থা বেড়েছে ৩৪টি।
২০২৪ সাল লিপইয়ার বা অধিবর্ষ। ফলে মেলার মাস ফেব্রুয়ারি পাবে ২৯ দিন। ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মেলা খোলা থাকবে। রাত সাড়ে ৮টার পর নতুন করে কেউ মেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে পারবেন না। ছুটির দিন বইমেলা চলবে বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। প্রতি শুক্র ও শনিবার বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত মেলায় ‘শিশুপ্রহর’ থাকবে। প্রতিদিন বিকাল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে সেমিনার এবং সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থাকবে।
২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে মেলা শুরু হবে সকাল ৮টায়, চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। অমর একুশে উদযাপনের অংশ হিসেবে শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি এবং সংগীত প্রতিযোগিতার আয়োজন থাকবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকবে। বইমেলায় বাংলা একাডেমি এবং মেলায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ২৫% কমিশনে বই বিক্রি করবে।
ছুটির দিন ব্যতীত বইমেলা ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৯ ফেব্রুয়ারি প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। ছুটির দিন বইমেলা চলবে বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত।
এদিকে উদ্বোধনীকে কেন্দ্র করে নেওয়া হয়েছে সব ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা। বুধবার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় বেশিরভাগ প্রকাশনীর স্টল নির্মাণের কাজ প্রায় সম্পন্ন। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের সাজসজ্জার কাজ। এছাড়া মেলার প্রস্তুতি ও সাজসজ্জা দেখতে অনেককে ভিড় করতে দেখা যায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।
বই বাছাইয়ে সাত সদস্যের টাক্সফোর্স
বুধবার ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে অমর একুশে বইমেলার সার্বিক নিরাপত্তাব্যবস্থা পরিদর্শন শেষে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার (অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক) হাবিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘অতীতে বইমেলায় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার নজির আছে। বিশেষ করে জঙ্গিদের হাতে লেখক হত্যার রেকর্ড আছে। বিষয়টিকে মাথায় রেখে নিরাপত্তা সাজানো হয়েছে। বইমেলায় কোনো ধরনের উসকানিমূলক বই বিক্রি করা যাবে না। বিষয়টি বাংলা একাডেমির পাশাপাশি পুলিশ ও গোয়েন্দা মনিটরিং করছে। বইমেলাকে ঘিরে জঙ্গি হামলা বা কোনো ধরনের নাশকতার আশঙ্কা নেই।’
তিনি বলেন, ‘পুরো এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে। পুলিশের তরফ থেকে স্থাপন করা হয়েছে মনিটরিং সেন্টার। সেখানে থেকে মেলার ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা হবে। গুজব ঠেকাতে কাজ করছে পুলিশের সাইবার বিভাগ। বইমেলায় প্রবেশের আগেই বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ বইয়ের বিষয়বস্তু সম্পর্কে জেনে নিবে। সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একই বিষয়ে কাজ করছে। মেলায় উসকানিমূলক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মিথ্যা সংবলিত ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আসতে পারে এমন বই বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা ও বাংলা একাডেমি সম্মিলিতভাবে এসব বইয়ের বিষয়ে মনিটরিং করছে। আপত্তিকর বই শনাক্তে সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে বাংলা একাডেমি। একত্রিশ সদস্যের একটি কমিটি টাস্কফোর্সকে সহযোগিতা করছে।’
তিনি আরও জানান, ‘প্রতিটি প্রবেশ পথে আর্চওয়ে ও হ্যান্ড মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে সন্দেহভাজন ব্যক্তি ও বস্তুতে তল্লাশি চালানো হবে। সার্বিক নিরাপত্তায় প্রস্তুত রয়েছে সিটিটিসি ইউনিট, বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, ক্রাইম সিন ভ্যান, ডগ স্কোয়াড, মেডিকেল টিম, ফায়ার সার্ভিসসহ প্রয়োজনীয় সব কিছুই। এবার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের গেট খুলে দেওয়া হচ্ছে। যাতে দর্শনার্থীরা মেলা প্রাঙ্গণে অনায়াসে প্রবেশ করতে পারেন। মেলায় প্রবেশের জন্য মোট ৫টি গেট খোলা থাকছে।’
যেভাবে গোড়াপত্তন বইমেলার
১৯৭২ সালে মুক্তধারা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এক টুকরো চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি একা বইমেলা চালিয়ে যান। ১৯৭৬ সালে অন্যান্যরা অনুপ্রাণিত হন। কিন্তু তখনও আনুষ্ঠানিকভাবে এর কোনো নাম ছিল না। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে মেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। ১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে প্রথম ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র আয়োজন সম্পন্ন করেন। কিন্তু সে বছর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের কারণে বইমেলা করা সম্ভব হয়নি। ১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে বর্তমানের অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়। আর সে অনুসারে এ বছর ৪০ বছরে পা দিচ্ছে বাঙালির প্রাণের মেলা অমর একুশে বইমেলা।
যাযাদি/ এস