বিভিন্ন দাবিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ বা আন্দোলন দ্রুত সমাধানের দাবি জানিয়েছেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা। তাঁদের শীর্ষ চার সংগঠন আজ যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ব্যবসা-বাণিজ্যের অচলাবস্থা নিরসনে সরকারকে দ্রুত সমস্যার সমাধান করার আহবান জানিয়েছে। একই সঙ্গে তারা আন্দোলনরত রাজস্বকর্মীদেরও দ্রুত কাজে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করেছে। তারা দাবি করে, এ শাটডাউনে তাদের দিনে অন্তত আড়াই হাজার কোটি টাকার আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে।
গতকাল শনিবার দুপুরে এনবিআরের বর্তমান অচলাবস্থার প্রভাব তুলে ধরতে রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএ, ডিসিসিআই, এমসিসিআই, বিসিআই, আইসিসি বাংলাদেশসহ দেশের শীর্ষ বাণিজ্যিক সংগঠনগুলো।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বর্তমান জুন-জুলাই মাসে তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, পাদুকা, সিরামিক, ফার্মাসিউটিক্যাল, অ্যাগ্রো প্রসেসিং, প্লাস্টিকসহ সব রপ্তানিমুখী শিল্পের বেশির ভাগ কারখানায়ই আগামী শীত মৌসুমের পণ্য তৈরির জন্য চাপ রয়েছে। এই গুরুত্বপূর্ণ মৌসুমে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট ও কাস্টম হাউসের মতো গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলোর অচলাবস্থার কারণে সঠিক সময়ে পণ্য রপ্তানি করতে না পারলে ক্রেতারা ক্রয়াদেশ বাতিল এবং ভবিষ্যতে নতুন ক্রয়াদেশ দেওয়ায় আগ্রহ হারাতে পারেন। কেননা আন্তর্জাতিক রপ্তানি বাজার কখনো বাংলাদেশের জন্য অপেক্ষা করবে না।
এসব অর্ডার পাশের দেশে চলে যাবে, যা হবে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি অপূরণীয় ক্ষতি। এ ছাড়া উৎপাদিত পণ্য সঠিক সময়ে না পাঠাতে পারলে প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায়িক ও আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশের (আইসিসিবি) সভাপতি ও বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যবসায়ী নেতা মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘যেকোনো দেশের সরকারের সঙ্গে বেসরকারি খাতের মিথস্ক্রিয়া (ইন্টারেকশন) অতীব জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে এই বেসরকারি খাতের সংলাপ কিংবা ইন্টারেকশন স্তিমিত।’
আন্দোলনের কারণে চলমান অচলাবস্থায় উদ্বেগ জানিয়ে তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠনের (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ‘চলমান অচলাবস্থার কারণে যে সংকট তৈরি হয়েছে, সরকার তার সঠিক গুরুত্ব বুঝতে পারছে না। আন্দোলনরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে মঙ্গলবার সভা ডাকা হয়েছে কেন? আজই শনিবার (গতকাল) আলোচনা করে এর সমাধান হতে হবে।’ তিনি আরো জানান, এনবিআর কর্মকর্তাদের ‘কমপ্লিট শাটডাউনের’ কারণে প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ আমদানি ও রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে।
এনবিআর শাটডাউনের কারণে আমদানি-রপ্তানির ক্ষতির বিষয়টি উল্লেখ করে লেদার অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার আমাদের জন্য, বাংলাদেশের জন্য অপেক্ষা করবে না। যুদ্ধ ছাড়া কোনো দেশের কাস্টমস বন্ধ থাকে, এটা আমাদের জানা নেই।’
তিনি আরো বলেন, ‘এনবিআরে অনেক সৎ অফিসার আছেন। বর্তমান সংস্কারের ফলে তাঁদের ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটি বলার অধিকার তাঁদের আছে। আমরা এনবিআরের সংস্কার চাই। তবে এনবিআরের অফিসারদের ভবিষ্যৎ কী, সে বিষয়টিও সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে।’
বিসিআই সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, দেশের আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। পোর্টে, বিমানবন্দরে আমদানি ও রপ্তানিযোগ্য পণ্য পড়ে থাকায় বৃষ্টি-রোদে নষ্ট হচ্ছে। কোনো রকম শর্ত ছাড়া আন্দোলনকারীদের কাজে যোগ দিতে হবে। একই সঙ্গে তিনি সংকট কাটাতে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়কে এগিয়ে আসার তাগিদ দেন।
বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, এনবিআরের কর্মকর্তারা এত দিন ব্যবসায়ীদের জ্বালিয়েছেন (হয়রানি করা)। এখন সরকারকে জ্বালাচ্ছেন। দেশের ব্যবসা ও দেশের স্বার্থে সমস্যার সমাধান জরুরি।
চলমান সমস্যার সমাধান চেয়ে সংবাদ সম্মেলনে ব্যাবসায়িক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে সরকারের কাছে সাতটি সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
ব্যবসায়ীদের সাত সুপারিশ
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আন্দোলনকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনা করে ওই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সেবা নিশ্চিত করা হোক; উত্তম কর তথা রাজস্ব নীতি প্রণয়ন ও প্রণীত নীতি যথাযথভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্বনীতি প্রণয়ন ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমকে আলাদাকরণ সংক্রান্ত বিতর্কিত অধ্যাদেশসংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করা হোক। এরপর তা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রভাবমুক্ত রেখে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও দেশের বাস্তবতার আলোকে বাস্তবায়ন; জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের সার্বিক উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট সব জাতীয় প্রতিষ্ঠানে হয়রানিমুক্ত সেবা প্রদানের লক্ষ্যে এর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা; বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়নে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য রেগুলেটরি ও ফ্যাসিলিটেটিং প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক ও সমন্বিত উন্নয়নের লক্ষ্যে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে আধুনিকায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা; অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে নির্দেশ দেওয়া।
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) সভাপতি মঈনুল ইসলাম, বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন, বাংলাদেশ প্লাস্টিক গুডস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিজিএমইএ) সভাপতি শামীম আহমেদ, এমসিসিআইয়ের সহসভাপতি সিমিন রহমান প্রমুখ।