পর্যটন শিল্প একক বৃহত্তম শিল্প হিসেবে স্বীকৃত। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে পর্যটন খাত এখন অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার। বর্তমানে পর্যটন খাত পৃথিবীর জিডিপিতে প্রায় ১১ শতাংশ অবদান রাখে। দেশে পর্যটন খাতের অবদান ৩ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। যুগ যুগ ধরে পর্যটকদের কাছে বাংলাদেশ চিরসবুজ ঘেরা এক স্বপ্নের দেশ হিসেবে পরিচিত। হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিচিত্র সমাবেশ ঘটেছে বাংলাদেশে। এখানে ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মের মানুষ প্রাচীনকাল থেকে বসবাস করে আসছে। এ কারণে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধর্মের উপাসনালয় ও বিদ্যাপীঠ। দেশে অনেক প্রাচীন মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ও বৌদ্ধ বিহার রয়েছে। প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শন হিসেবে যেগুলোর গুরুত্ব অসীম। এগুলো বাড়িয়ে দিয়েছে দেশের পর্যটন আকর্ষণ।
পর্যটনের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হয়ে বর্তমানে পৃথিবীর চারটি কর্মসংস্থানের মধ্যে একটি কর্মসংস্থান তৈরি হয় পর্যটন খাতে। এমন রমরমা বাণিজ্যের হাতছানিতে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব পর্যটন দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘পর্যটনে পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগ’। জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থার (ইউএনডবিøউটিও) উদ্যোগে ১৯৮০ সাল থেকে প্রতি বছর ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস পালন করা হয়। পর্যটন মৌসুমকে বরণে ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত কক্সবাজারের সব হোটেল-মোটেল ও গেস্ট হাউসগুলোয় ৬০ শতাংশ ছাড় ঘোষণা করেছে।
অজানা সৌন্দর্য, রহস্য ও বৈচিত্র্য মানুষকে মায়াবী হাতছানি দেয়। তাই সুপ্রাচীনকাল থেকে মানুষ বিনোদন ও প্রকৃতির সৌন্দর্যপিয়াস মেটানোর জন্য রূপ-রস-গন্ধে ভরা নৈসর্গিক প্রকৃতিতে অবগাহন করে। প্রাকৃতিক নৈস্বর্গের লীলাভ‚মি খ্যাত বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। বর্তমান বিশ্বে পর্যটন একটি অন্যতম আয়ের উৎস। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের মুগ্ধ করে। বাংলাদেশের প্রতিটি এলাকা বিভিন্ন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে বিশেষায়িত। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত হচ্ছে বাংলাদেশের কক্সবাজার। পৃথিবীর একক বৃহত্তম জীববৈচিত্র্যে ভরপুর ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন, একই সৈকত থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত অবলোকনের স্থান সমুদ্রকন্যা কুয়াকাটা, দুটি পাতা একটি কুঁড়ির সবুজ রঙের নয়নাভিরাম চারণভ‚মি সিলেট, আদিবাসীদের বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি ও কৃষ্টি-আচার সমৃদ্ধ উচ্চ সবুজ বনভ‚মি ঘেরা চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চল, সমৃদ্ধ অতীতের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শনগুলো। বিদেশি পর্যটকরা এ দেশের ধর্মীয় নিদর্শন ও তীর্থস্থানগুলোয় ভ্রমণ করে থাকেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন চীনের ফা হিয়েন, হিউয়েন সাং, মরক্কোর ইবনে বতুতা, ইতালির সিজার ফ্রেডরিক, ফ্রান্সের টাভার্নিয়া প্রমুখ। তারা এদেশের পুরাকীর্তি, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী আবু তাহির মুহাম্মদ জাবের বলেন, আধুনিক বিশ্বে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের অন্যতম হাতিয়ার পর্যটন। পর্যটন শিল্পে বিশ্বের বুকে এক অপার সম্ভাবনার নাম বিউটিফুল বাংলাদেশ। দেশের প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্য পৃথিবীর অন্য দেশ থেকে অনন্য ও একক বৈশিষ্ট্যমÐিত হওয়ায় পর্যটন বিকাশে বাংলাদেশের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। বাংলাদেশে পর্যটন শিল্প বিকাশের সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে দেশের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের পাশাপাশি বিশ্বদরবারে দেশের পর্যটন শিল্পকে কার্যকরভাবে তুলে ধরতে হবে। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর এক-তৃতীয়াংশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস পর্যটন শিল্প। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে পর্যটন শিল্প বড় নিয়ামক হতে পারে।
দেশে ইসলাম ধর্মের প্রাচীন নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম ষাট গম্বুজ মসজিদ, সাত গম্বুজ মসজিদ, ছোট সোনা মসজিদ, বাবা আদম মসজিদ, হোসেনি দালান, হযরত শাহজালালের (র.) মাজার, হযরত শাহ পরাণের (র.) মাজার, বিশ্ব ইজতেমা ইত্যাদি।
বৌদ্ধ ধর্মের প্রাচীন দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে আছে বৌদ্ধ বিহার, মহাস্থানগড়, পাহাড়পুরের সোমপুর বিহার, জগদ্দল বিহার, হলুদ বিহার, ভাসু বিহার, ময়নামতি, শালবন বিহার, আনন্দ বিহার, ভোজ বিহার ইত্যাদি।
হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রাচীন নিদর্শনগুলো হলো ঢাকেশ্বরী মন্দির, আদিনাথ মন্দির, ভবানীপুর মন্দির, চন্দ্রনাথ মন্দির, রামকৃষ্ণ মঠ, রামকৃষ্ণ মিশন, পুটিয়া মন্দির, কান্তজির মন্দির ইত্যাদি। খ্রিষ্টান ধর্মের প্রাচীন নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে সেন্ট মেরি ক্যাথেড্রাল, আর্মেনীয় গির্জা ইত্যাদি। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে বেশি প্রিয় হচ্ছে- বাংলাদেশের একমাত্র সামুদ্রিক প্রবাল দ্বীপ কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন। এটি বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত। প্রকৃতির এ বিস্ময়কর প্রবাল দ্বীপটি বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে অবস্থিত। জিঞ্জিরা, দক্ষিণ পাড়া, গলাছিরা ও চেরাদিয়া এই চারটি দ্বীপ নিয়ে ‘সেন্টমার্টিন দ্বীপ’। মহেশখালীর দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত সোনাদিয়া দ্বীপ। পাহাড়, সবুজ ঘন প্যারাবন পেছনে ফেলে বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে যেতে হয় এই সোনাদিয়ায়। কক্সবাজার শহর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে এই দ্বীপের অবস্থান। ঐতিহাসিকরা এটিকে সোনালী দ্বীপ বলেছেন। প্রতি বছর শীতের মৌসুমে এখানে হাজার হাজার অতিথি পাখির ভিড় জমে তাই এটিকে অতিথি পাখির স্বর্গরাজ্য বলা হয়। মানচিত্রের শেষ বিন্দু ছেঁড়াদ্বীপ সামুদ্রিক প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের ৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত ছেঁড়াদ্বীপ। এখানে বসতি নেই। চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রবাল-শৈবাল, শামুক-ঝিনুক। এসব মনভরে উপভোগ করা যায়, কক্সবাজার শহর থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক ধরে ১০ কিলোমিটার গেলে পাহাড়ঘেরা অপরূপ ‘হিমছড়ি’। গহিন অরণ্যে ভালুক, সিংহ, অজগরসহ নানা জীবজন্তু স্বচক্ষে দেখতে হলে যেতে হয় ডুলাহাজারায় অবস্থিত বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে।
পর্যটনের অপার সম্ভাবনার আরেক নাম চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চল মূলত বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের তিনটি জেলা, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান নিয়ে গঠিত। পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটনের মূল উপকরণ হলো পাহাড় ঘেরা সবুজ প্রকৃতি যা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপে পর্যটকদের কাছে ধরা দেয়।
নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল। এ শহরে রয়েছে উপমহাদেশের সর্বপ্রথম ও সর্ববৃহৎ চা বাগান মালনীছড়া চা বাগান। এ অঞ্চলে আসা পর্যটকদের মন জুড়ায় সৌন্দর্যের রানীখ্যাত জাফলং, নীলনদ খ্যাত স্বচ্ছ জলরাশির লালাখাল, পাথর জলের মিতালিতে বয়ে যাওয়া বিছনাকান্দির নয়নাভিরাম সৌন্দর্য, পাহাড় ভেদ করে নেমে আসা পাংথুমাই ঝরনা, সোয়াম্প ফরেস্ট রাতারগুল, হাকালুকি এবং কানাইঘাটের লোভাছড়ার সৌন্দর্য বাংলাদেশের হাওড় অঞ্চল পর্যটনের আরেক সম্ভাবনার নাম। বাংলাদেশের জেলাগুলোর মধ্যে সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া- এ সাতটি জেলার ৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভ‚মিতে ৪২৩টি হাওড় নিয়ে হাওড়াঞ্চল গঠিত। হাওড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পর্যটকরা নৌকায় বসে বিস্তীর্ণ নীল জলরাশির মায়ায় ভেসে বেড়াতে পারেন। আরো উপভোগ করতে পারেন হাওড়ের কোলঘেঁষে থাকা সীমান্ত নদী, পাহাড়, পাহাড়ি ঝর্ণা, হাওড়-বাঁওড়ের হিজল, করচ, নল-খাগড়া বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোকাম্মেল হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, পর্যটন শিল্প বিকাশে অবারিত সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশে। সরকার পর্যটন শিল্পের বিকাশ ও উন্নয়নকে গতিশীল করতে বহু প্রকল্প হাতে নিয়েছে। করোনা-পরবর্তী দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। সম্প্রতি সরকার পর্যটন শিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন ও বিকাশের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণের লক্ষ্যে একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। বিদেশি পর্যটকদের জন্য সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক করা হচ্ছে, কক্সবাজারে বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক করা হয়েছে। পর্যটনের জন্য সারা দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করা হয়েছে। এসব ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ পর্যটন খাত থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারবে এবং দেশের অর্থনীতি হবে মজবুত ও টেকসই।
পর্যটন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা থাকা সত্তে¡ও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে আমরা পর্যটন শিল্পে পিছিয়ে আছি। অথচ পর্যটন শিল্পকে লুফে নিয়েছে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, নেপাল, মরিশাস, মালদ্বীপ। যেসব দেশ কঠোর রক্ষণশীল বলে পরিচিত যেমন চীন, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমার এ শিল্পের ভবিষ্যৎ বুঝতে পেরে পর্যটকদের জন্য তাদের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। বাংলাদেশে পর্যটন খাতে সরাসরি কর্মরত আছেন প্রায় ১৫ লাখ মানুষ। বছরে প্রায় ৬ কোটি দেশীয় পর্যটক সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়ান। সে হিসেবে বাংলাদেশেও ভবিষ্যতে পর্যটকের সংখ্যা ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন বৃদ্ধির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, দেশে বিদেশি পর্যটকদের আসার হার কমছে। ২০২০ সালের মার্চ থেকেই যখন কভিড-১৯ এর প্রভাব শুরু হয়েছিল তার সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি লেগেছিল এ পর্যটন শিল্পে। তবে কভিডের প্রভাব কাটিয়ে পর্যটন এখন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে শুরু করেছে। ২০১৯ সালে ৬ লাখ ২১ হাজার ১৩১ জন বিদেশি পর্যটক দেশে আসেন। এরপর কভিডের প্রভাবে ২০২০ সালে তা নেমে দাঁড়ায় ১ লাখ ৮১ হাজার ৫১৮ জনে। ২০২১ এবং ২০২২ সালে তা দেড় লাখে নেমে এসেছে।
যাযাদি/ এস