সোমবার, ১২ মে ২০২৫, ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

মুরগি বাদে সবই বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দামে

নাগালের বাইরে আগাম শীতকালীন সবজি, স্থিতিশীল রয়েছে চালের বাজার, সরকার নির্ধারিত দাম এখনো কার্যকর হয়নি
যাযাদি রিপোর্ট
  ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:১৩
মুরগি বাদে সবই বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দামে
মুরগি বাদে সবই বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দামে

প্রথমবারের মতো সরকার ডিম, আলু ও পেঁয়াজের যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল তা এখনো কার্যকর হয়নি। গত দুই সপ্তাহে এই তিনটি পণ্যের মধ্যে শুধু আলুতে ৫ টাকা কমেছে। অন্যদিকে, কেজিপ্রতি ব্রয়লার মুরগির দাম কমেছে ১০ টাকা। আর চালের বাজার স্থিতিশীল থাকলেও মৌসুম অনুযায়ী দাম বাড়তি বলে ক্রেতা-বিক্রেতারা জানিয়েছেন।

এদিকে, বাজারে উঠেছে আগাম শীতকালীন সবজি। তবে এসব সবজির দাম সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে নেই। মাছের দামেও একই চিত্র দেখা গেছে।

গত ১৪ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষিপণ্যের দাম নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী তিন কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণের সিদ্ধান্ত জানান। সে অনুযায়ী প্রতি কেজি পেঁয়াজের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য হবে ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা। আলু কেজিতে ভোক্তা পর্যায়ে ৩৫-৩৬ টাকা এবং কোল্ড স্টোরেজ থেকে ২৬-২৭ টাকা। ডিমের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যপ্রতি পিস ১২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এরপরও দাম নিয়ন্ত্রণে না এলে ডিম আমদানির নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে ১০ কোটি পিস ডিম আমদানির অনুমতিও দেওয়া হয়। দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও নির্ধারিত দাম বাজারে কার্যকর হয়নি।

শুক্রবার বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, নির্দেশনা উপেক্ষা করে আগের বাড়তি দামেই নিত্যপণ্য বিক্রি হচ্ছে বাজারে। এদিন ফার্মের ডিম প্রতি ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকায়। আর প্রতি হালি (৪ পিস) বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকায়। ফলে একটি ডিমের দাম পড়ছে ১৩ টাকা ৭৫ পয়সা।

রাজধানীর মিরপুরের একাধিক বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়েও হালিপ্রতি চার টাকা বেশিতে বিক্রি হচ্ছে ডিম। এদিন মুসলিম বাজারের মায়ের দোয়া স্টোরে প্রতি হালি ডিম ৫২ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। সে হিসাবে প্রতি পিসের দাম ১৩ টাকা। অন্য দোকানগুলোতেও দাম একই। মায়ের দোয়া স্টোরের বিক্রয়কর্মী আজাদ সংবাদিকদের বলেন, ডিম আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে। সরকার যে দাম নির্ধারণ করেছে সেটা কার্যকর করা সম্ভব নয়। কারণ পাইকারিতে ডিমের দাম নির্ধারিত নয়।

আবার কোথাও কোথাও ডিমের আকার ভেদেও বিক্রি করতে দেখা গেছে। সরকার নির্ধারিত দামে ডিম বিক্রি হলেও তা আকারে ছোট। যা ডজনপ্রতি পড়বে ১৪৮ টাকা। মাঝারি আকারের ডিম ডজনপ্রতি ১৫০ টাকা, যা প্রতি পিস ১২ টাকা ৫০ পয়সা পড়ে। অন্যদিকে আকারে বড় ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ টাকা ডজনে। এতে প্রতি পিস ডিমের দাম পড়ছে প্রায় ১৩ টাকা করে।

মিরপুর বাউনিয়াবাঁধ বাজারের ডিম বিক্রেতা সোহেল সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, প্রতি পিস ডিম পাইকারদের থেকে যাতায়াত খরচসহ কিনি ১১ টাকা ৪০ পয়সা করে। দোকান পর্যন্ত দিয়ে যায় তারা। এর মধ্যে কিছু ডিম ভাঙা পড়ে। আবার ক্রেতারাও কিনতে এসে কিছু ডিম ভেঙে রেখে যায়। তখন এসব ডিম ৫ থেকে ১০ টাকা বিক্রি করতে হয়। শুধু ভাঙা ডিম না, অধিকাংশ ডিমই এখন আকারে ছোট। কিন্তু যারা কিনতে আসেন তারা বেছে বড় ডিমগুলো নিয়ে যায়। তখন ছোট ডিমগুলো রয়ে গেলে তা কেউ নিতে চায় না। অন্য দোকানে চলে যায়। তাই ছোট-বড় বেছে রাখছি। মিরপুর ১১-এর আরেক ডিম বিক্রেতা বলেন, পাইকারি পর্যায়ে যদি ১১ টাকা পিস হিসেবে ডিম বিক্রি হয় গাড়ি ভাড়াসহ ন্যায্য দামে ডিম বিক্রি করে লাভ করা যায়। আবার যদি প্যাকেটে করে ডিম দিয়ে যায় তাহলে কাস্টমারদের আর বাছাবাছির সুযোগ নাই। কিছুদিন এক কোম্পানির থেকে প্যাকেটের ডিম রাখতাম কেউ কিনতে চাইত না। কাস্টমারের কথা টাকা দিয়ে কিনুম নিজে বাইচ্ছা নিমু। তখন বাছতে গিয়া ডিম ফাটায়া ফেলে৷সেই ডিম আবার নিতে চায় না। তাই নিজেরাই বেছে রাখি।

এ ছাড়া হাঁসের ডিম ২২০ টাকা, দেশি মুরগির ডিমের হালি ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

এদিকে, সপ্তাহের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ১০ টাকা কমেছে। তবে সোনালি ও দেশি মুরগি আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে। ১২ নম্বর সেকশনের মুসলিম বাজারের ব্যবসায়ী শরিফুজ্জামান বলেন, গত সপ্তাহে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৯০-১৮০ টাকায় বিক্রি করেছি। এ সপ্তাহে দাম ১০-২০ টাকা কমেছে। তবে অন্য কোনো মুরগির দাম কমেনি। প্রতি কেজি সোনালি মুরগি ২৯০-৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর দেশি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকা কেজিতে।

তালতলা বাজারে মুরগি বিক্রেতা রশিদ মিয়া বলেন, গত সপ্তাহের চেয়ে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ১০ টাকা কমেছে। পাইকারি বাজারে দাম কমায় আমরাও দাম কমিয়ে বিক্রি করছি।

তিনি বলেন, গত সপ্তাহের তুলনায় দেশি মুরগি কেজিতে ২০ টাকা কমেছে। এ ছাড়া সোনালি মুরগিরও দাম কমেছে। সোনালি ৩০০ টাকা, সোনালি হাইব্রিড ২৯০ টাকা, দেশি মুরগি ৫০০ টাকা কেজি এবং লেয়ার ৩৪০ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে।

আর গরুর মাংস কেজিপ্রতি ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা এবং খাসির মাংস কেজিপ্রতি ১ হাজার ৫০ থেকে ১ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বাজারে দেশি পেঁয়াজ ৯০ টাকা, ক্রস জাতের পেঁয়াজ ৮৫ টাকা, ভারতীয় পেঁয়াজ ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভারতীয় পেঁয়াজ এক সপ্তাহের ব্যবধানে বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকা বেশিতে। গত সপ্তাহে এই পেঁয়াজের দাম ছিল ৬০ টাকা। এই বাজারে আলু ৪৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

রুবেল নামে এক বিক্রেতা বলেন, আমার আলু কেনা পড়ছে ৪০ টাকা। আর দেশি পেঁয়াজ ৮০ টাকা, ক্রস পেঁয়াজ ৭৮ টাকা, ভারতীয় ৬৫ টাকায় কিনেছি। আমি কমে কীভাবে বিক্রি করব?

মিরপুরের মারাজানা স্টোরের বিক্রেতা সোহাগ বলেন, আলু-পেঁয়াজ আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে। পাইকারি বাজার থেকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এ কারণে খুচরা বাজারে সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, এখন পর্যন্ত একদিনও সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে আলু বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। উল্টো এ সময় দাম আরও বেড়েছে।

মুসলিম বাজারের ভ্যানে আড়াই কেজি আলু ১০০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। অর্থাৎ প্রতি কেজি ৪০ টাকা। যদিও এ দাম সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কেজিপ্রতি ৪-৫ টাকা বেশি।

আকারে ছোট এসব আলুর দাম প্রসঙ্গে বিক্রেতা রাইজুল আলম বলেন, আকারে ছোট হলেও আলুর মান ভালো। প্রতি কেজি আলুতে ২-৩ টাকা লাভ হচ্ছে। দাম কিছুটা কম হওয়ায় বিক্রি হচ্ছে বেশি।

এদিকে, আগাম শীতকালীন সবজি এরই মধ্যে চলে এসেছে বাজারে। তবে এর মধ্যে হাতেগোনা কিছু সবজির দামই নাগালের মধ্যে, বাকি সব সবজির দাম আকাশছোঁয়া। রাজধানীর বাড্ডা, রামপুরা এলাকার বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি শিম ২০০ টাকা, চায়না গাজর ১৪০ টাকা, মূলা ৬০-৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি পিস ফুলকপি ও বাঁধাকপির দাম ৬০ টাকা। এ ছাড়া প্রতি কেজি গোল বেগুন ১০০ টাকা, লম্বা বেগুন ৮০ টাকা, বরবটি ১০০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, পটোল ৬০ টাকা, ঢেঁড়শ ৬০ টাকা, পেঁপে ৪০ টাকা, ঝিঙে ৬০ টাকা, ধুন্দল ৬০ টাকা, কচুরমুখী ৯০ টাকা এবং কচুর লতি ৮০ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। প্রতি পিস জালি কুমড়া (চাল কুমড়া) ৬০ টাকা ও লাউ ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কাঁচা কলা প্রতি হালি ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বাজার করতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী মাহমুদুল হাসান বলেন, আজকের বাজারে সবকিছুরই দাম বেশি মনে হচ্ছে। মূলার কেজি ৬০ টাকা, যা সাধারণত ৩০-৪০ টাকার মধ্যেই থাকে। এ ছাড়া ঢেঁড়শের কেজিও ৬০ টাকা, গত দুইদিন আগেও ছিল ৪০ টাকা।

তিনি বলেন, বাজারে কোনো পণ্যের দামে নিয়ন্ত্রণ নেই। ব্যবসায়ীরা নিজেদের ইচ্ছেমতো যখন ইচ্ছে দাম বাড়িয়ে নিচ্ছে। রামপুরা বাজারের সবজি বিক্রেতা নুরুজ্জামান বাবু বলেন, শীতের সবজি বাজারে এলেও চাহিদা অনুপাতে পরিমাণ খুবই কম। বাধ্য হয়েই একটু বেশি দামে বিক্রি করতে হয়।

রফিকুল ইসলাম নামে আরেক বিক্রেতা বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে বাজারে সবজির দাম বাড়তি। এর কারণ হলো এখনো আসলে শীতকালীন সবজির পুরোপুরি মৌসুম আসেনি। ফলে এগুলোর দাম বেশি।

বাজারে স্থিতিশীল রয়েছে চালের দাম। তবে মৌসুম অনুযায়ী চালের দাম বাড়তি বলে ক্রেতা ও বিক্রেতারা জানিয়েছেন। বাজারে প্রতি কেজি সরু বা চিকন চাল ৭০-৮০ টাকা, আটাশ চাল ৫৫-৬০ টাকা, মোটা চাল ৪৫-৫০ টাকা, নাজির চাল ৭০-৮৫ টাকা, বাসমতী চাল ৮৯-৯০ টাকা, চিনিগুঁড়া চাল ১২০-১৫০ টাকা, কাটারি ৮০-৯০ টাকা, আমন ৬৫ টাকা, আউশ ৭৫ টাকা ও জিরাশাইল ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

এ ছাড়া প্রতি কেজি শিং মাছ (আকার ভেদে) ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা, রুই দাম বেড়ে (আকার ভেদে) ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা, মাগুর ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা, মৃগেল ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা, পাঙাশ ১৯০ থেকে ২৫০ টাকা, ইলিশ (আকার ভেদে) ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা, চিংড়ি ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা, বোয়াল ৬০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা, কাতল ৩৫০ থেকে ৮০০ টাকা, পোয়া ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা, পাবদা ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা, তেলাপিয়া ২২০ টাকা, কই ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা, মলা ৪৫০ টাকা, বাতাসী-টেংরা ১ হাজার ২০০ টাকা, কাঁচকি ৬০০ টাকা এবং পাঁচমিশালি চাষের মাছ ২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

যাযাদি/ এসএম

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে