বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

দিনাজপুরে এবারে আগাম আলু চাষে লাভবান কৃষকরা

দিনাজপুর প্রতিনিধ
  ১৬ জানুয়ারি ২০২৪, ১৬:১৮
দিনাজপুরে এবারে আগাম আলু চাষে লাভবান কৃষকরা

ধানের জেলা হিসেবে খ্যাতি পাওয়া দিনাজপুর জেলা আলু উৎপাদনেও ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। বিগত কয়েক বছর থেকে আগাম আলু চাষে ঝুঁকছেন এ জেলার কৃষকরা। এক জমিতে আলুসহ তিন ফসলের চাষ করে আর্থিক ভাবে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা।

দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর, বিরল ও সদর উপজেলার কয়েকটি এলাকা ঘুরে কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায় এবারে গত কয়েক বছরের তুলনায় আগাম আলু চাষ করে লাভবান হচ্ছে কৃষকরা।পরপর গত তিন বছর লাভের মুখ না দেখলেও এবারে লাভের হিসেব কষছেন তারা।

চিরিরবন্দর উপজেলার ভোলানাথপুর এলাকার কৃষক জামালউদ্দিন বলেন, ‘আড়াই বিঘা মাটিত আগাম আলু লাগাইছি। জমি নিজের। গত কাইল পর্যন্ত দুই বিঘা মাটির আলু উঠাইছি। গড়ে দুই বিঘা জমিতে আলু পাইছি ১২০ মণ। গড়ে ৩৮ টাকা কেজি দর পাইছি। এইবার আগাম আলু লাগায়াই তাহো দুইটা টাকার মুখ দেখনো।’

কৃষি অফিস সূত্র জানায়, সাধারণত নভেম্বর মাসের শেষভাগ হতে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত আলু লাগানোর সময়। তবে কৃষকরা জমি ফেলে রাখতে চাননা দেখে আগাম আমন লাগান। ধান কাটা হলে সেই জমিতে আগাম আলু লাগান।

এ অঞ্চলে আগাম জাত হিসেবে সানশাইন, সেভেন, স্টোরেজ এবং লেট ভ্যারাইটি হিসেবে কার্ডিনাল, গ্যানুলা, ডায়মন্ড, বারি-১০ ও দেশী(লাল) জাতের আলুর চাষ করে থাকেন। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী জেলায় এবার ৪৬ হাজার ৫০০হেক্টর জমিতে আলু লাগিয়েছেন কৃষক। হেক্টর প্রতি ফলনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭মেট্টিক টন। গত বছরের তুলনায় দেড় হাজার হেক্টর জমিতে বেশি আলু চাষ হয়েছে। আর রোপনকৃত মোট আলুর ২৫ শতাংশ আগাম চাষ করা হয়েছে।

এদিকে দিনাজপুরের বাহাদুর বাজার ঘুরে দেখা যায়, নতুন জাতের আলু আকারভেদে বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৪০-৪২ টাকা দরে। কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, পাইকারী বাজারে আলুর দাম ৩৯-৪১টাকা। বাজারে কোন দোকানেই পুরাতন আলুর দেখা পাওয়া যায়নি। তবে কয়েকদিনের মধ্যে আলুর বাজার নেমে যাবে এমন কথাই বলছেন সবজী ব্যবসায়ীরা, ‘আগাম জাতের আলুটা পুরোপুরি বাজারে আসলে দাম কিছুটা কমবে। যা উঠছে তার একটা অংশ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাচ্ছে।

এক্ষেত্রে আরও সপ্তাহখানেক পরে আলু ৩০-৩৫টাকা কেজিতে চলে আসতে পারে। কিছুদিন আগে হঠাৎ আলুর দাম বাড়া নিয়ে এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘এখানে খুচরা ব্যবসায়ীদের হাত নেই। পাইকারি যে দামে কিনি তার চেয়ে ৩-৫টাকা লাভে আমরা বিক্রি করি। এক্ষেত্রে হিমাগারে আলু রেখে যারা ব্যবসা করেন মূলত দামটা তারাই নিয়ন্ত্রন করেন।’দিনাজপুরে মোট ১৪টি হিমাগার আছে। এসব হিমাগারের ধারণ ক্ষমতা প্রায় ১ লাখ ৩০হাজার মেট্টিক টন।

পূণর্ভবা কোল্ডস্টোরেজ লিমিটেড এর স্বত্ত্বাধিকারী বলেন, দিনাজপুরের হিমাগারগুলোতে ধারণক্ষমতার চাইতে কমপক্ষে ৬০হাজার মেট্টিক টন আলু বেশি থাকে। চাহিদার তুলনায় উৎপাদনও বেশি হয়। হিমাগার মালিক প্রতি বস্তা (৫৫কেজি) ভাড়া বাবদ পান ২৮০টাকা।

তিনি বলেন, আলুর দাম বাড়ল কিন্তু সেই বাড়তি টাকা কৃষকের ঘরে যায়নি। এখানে একটা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট আছে যারা গুজব ছড়িয়ে দামটা নিয়ন্ত্রন করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।’ দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার কারেন্ট হাট বাজার এলাকায় পাঁচ হাজার টাকা বিঘা হিসেবে দেড় বিঘা (৪৮ শতকে বিঘা) জমি চুক্তি নিয়ে আগাম আলু লাগিয়েছেন কৃষক আলাউদ্দিন হোসেন (৪১)। গত বছর নভেম্বর মাসের ১তারিখে ‘স্টোরেজ’ জাতের আলু রোপন করেছেন তিনি। ৬২ দিন বয়সে গতকাল সোমবার আলু উত্তোলন করেছেন। তাতে আলু পেয়েছেন ৫২মণ(৩২ বস্তা, প্রতি বস্তা ৬৫কেজি)। ক্ষেত থেকেই সেই আলু পাইকারের কাছে বিক্রি করেছেন ৪২টাকা কেজি দরে। কৃষি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী আলু উত্তোলনের সময়কাল ধরা হয় ৮৫-৯০দিন। তাহলে ৬২দিন বয়সে কৃষক আলমগীর আলু উত্তোলন করছেন কেন? আলমগীর জানান, আগাম আলু লাগিয়েছেন। বাজারে নতুন আলুর চাহিদা আছে। ক্ষেত থেকে পাইকারের কাছে বিক্রি করছেন ৪২টাকা কেজি দরে। ৯০দিন সময় নিয়ে আলু উত্তোলন করলে হয়তো ৭০মণ পর্যন্ত আলু পাবো কিন্তু তখন বাজারে দাম যাবে সর্বোচ্চ ১৫-২০টাকা কেজি। জানালেন, আলু তুলে ভুট্টা লাগাবেন তিনি।

এক বিঘা জমিতে আলু চাষের খরচের হিসেবে আলমগীর জানান, জমি ভাড়া ৫ হাজার টাকা, চাষ বাবদ(পাঁচ চাষ) খরচ হয়েছে ৩ হাজার, সার(ড্যাপ, পটাশ, ইউরিয়া, ম্যাগনেশিয়াম) ৫ হাজার টাকা, বীজ ২১ হাজার টাকা, রোপন খচর ৪ হাজার, সেচ ২ হাজার, কীটনাশক ৩ হাজার, দ্বিতীয় ধাপে সার(ইউরিয়া) ২ হাজার ৭০০, মাটি দেওয়া ২ হাজার, উত্তোলন বাবদ ৩ হাজার টাকাসহ মোট খরচ হয়েছে ৫০ হাজার ৭০০টাকা। এক বিঘায় প্রাপ্ত ৫২মণ আলু বিক্রি করেছেন ৮৭ হাজার ৩৬০টাকায়। হিসেব অনুযায়ী এক বিঘায় তার লাভ হয়েছে ৩৬ হাজার ৬৬০ টাকা। জানালেন, যদি ৯০দিন বয়সে আলু তুলতেন তাহলে সর্বোচ্চ ১০-১২হাজার টাকা লাভ থাকতো। ভালো দাম পেয়ে অপরিণত অবস্থায় আলু তোলায় উৎপাদনে ঘাটতি হবে কিনা এমন প্রশ্নে কয়েকজন কৃষক বলেন, এই আলু হিমাগারে রাখার জন্য নয়। কৃষক আগাম চাষ করেছেন মুলত দামের আশায়। কারণ নভেম্বরের শুরু থেকে আগের আলুতে টান পড়তে শুরু করে। এসময় হিমাগারেও তেমন একটা আলু থাকেনা। প্রায় একই কথা বলছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. নুরুজ্জামান।

তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে বাজার বিবেচনায় কৃষক আগাম আলু চাষ করছেন। আমরাও তাদেরকে নিয়মিত আলু লাগানোর পাশাপাশি আগাম চাষে উদ্বুদ্ধ করছি। তবে এক্ষেত্রে জাতীয় উৎপাদন কিংবা সরবরাহে কোন প্রভাব পড়বেনা।

জানালেন, গত অর্থ বছরের তুলনায় দেড় হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ বেশি হয়েছে। আবহাওয়া অনূকুলে থাকায় আলুর ভালো ফলনের আশা করছেন তিনি।।

যাযাদি/ এম

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে