আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সরব বিএনপি। এর আগে দলটির একাধিক নেতা ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের কথা বললেও, এবার সেই দাবি বেশ জোরালোভাবে জানিয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
নির্বাচন নিয়ে ‘টালবাহানা’ চলছে উল্লেখ করে ‘ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হতে হবে, ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। খবর বিবিসি বাংলার।
এদিকে, নির্বাচন নিয়ে বিএনপির এমন দাবির মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাপানের নিক্কেই ফোরামে দেওয়া বক্তব্যে বলেছেন, ‘একটি দলই ডিসেম্বরে নির্বাচন চায়’।
প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্যের পর স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক মহলে বিষয়টি নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়েছে। বিএনপি নেতারা ইতোমধ্যে বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা কেন নির্বাচন নিয়ে বিএনপিকে দোষারোপ করছেন, তা তাদের বোধগম্য নয়।
এদিকে গত বুধবার রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির তারুণ্যের সমাবেশে তারেক রহমান নির্বাচনের জোর দাবি তোলেন। বিএনপির এই অবস্থান নিয়ে অবশ্য মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো।
কোনো কোনো দল বলছে, ৯ মাস পেরিয়ে গেলেও অন্তর্বর্তী সরকার দৃশ্যমান কোনো সংস্কার দেখাতে পারেনি। বরং দেশের মধ্যে বেড়েছে বিভাজন ও বিশৃঙ্খলা। ফলে বিএনপির দ্রুত নির্বাচনের দাবিকে যৌক্তিক বলছে তারা।
আবার নির্বাচনের আগে বিচার ও সংস্কারের ওপর জোর দিচ্ছে এনসিপিসহ ইসলামপন্থি কিছু দল। যার কারণে নির্বাচন নিয়ে বিএনপির শক্ত অবস্থানকে ‘সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের কৌশল’ হিসেবেও দেখছেন কেউ কেউ।
তবে ডিসেম্বর না হলেও ২০২৬ সালের শুরুর দিকেই নির্বাচন আয়োজনের কথা বলছে বেশিরভাগ দল।
‘সরকারকে চাপে ফেলার কৌশল’
কিছুদিন আগে তার কথিত পদত্যাগ ভাবনার বিষয়ে আলাপ শুরু হলে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে দেখা করেন।
সেসময়ও প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম আবারও জানান যে, জুন মাসই হবে এই সরকারের ‘কাট অফ টাইম’।
তবে নির্বাচনের এই সময়সীমা নিয়ে কখনোই সন্তুষ্ট ছিল না বিএনপি। সবশেষ বুধবার দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আবারও দলটির জোরাল অবস্থান জানান।
এনিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বলছে, যেকোনো গণতান্ত্রিক শক্তি বা দল নির্বাচনের দাবি করতে পারে। তবে নির্বাচনের আগে সংস্কারের রোডম্যাপ এবং বিচারকে দৃশ্যমান করা গুরুত্বপূর্ণ।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, সংস্কার ফেলে রেখে শুধু নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হতে চাওয়াটা বাংলাদেশের রাজনীতি শুধু না, জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়নের যে আকাঙ্ক্ষা মানুষের মধ্যে, সেটার জন্যে একটা ক্রাইসিস তৈরি করতে পারে।
তার মতে, জুলাই সনদের মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মৌলিক সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্য হলে এবং তা বাস্তবায়নের পথ পরিষ্কার করে নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হলে সংকট কাটানো সম্ভব। নির্বাচনের আগে সংস্কারের কথা বলছে অন্য ইসলামপন্থি দলগুলোও।
ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের যে কথা বিএনপি বলেছে, তার সমালোচনা করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র গাজী আতাউর রহমান বলেন, ওনারাই যদি নির্বাচন ঘোষণা করে দেন, তাহলে বাকি কাজটাও ওনারা করুক। তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার তাদের অনেক দায়িত্ব গুছিয়ে করতে না পারলেও অন্তত উদ্যোগ নিয়েছেন।
বড় একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির উচিৎ ছিল সরকারকে সহযোগিতা করা। উল্টো রাস্তায় সমাবেশ করে আলটিমেটাম দেওয়াটা আসলে সরকারকে চাপে ফেলার কৌশল, যা ইসলামী আন্দোলন খুব ভালোভাবে দেখছে না বলে মন্তব্য করেন গাজী আতাউর রহমান।
এছাড়াও বিএনপি যদি নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকে, তবে দলটির সহযোগীরাও তাদের ভাষায় কথা বলবে, যেটা দেশের জন্য ভালো হবে না বলেও মনে করেন ইসলামী আন্দোলনের এই নেতা।
তবে সরকার ঘোষিত সময়ে নির্বাচন না করলে ইসলামী আন্দোলনও শক্ত অবস্থানে যাবে বলে জানান দলটির মুখপাত্র।
অন্যদিকে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে অর্থাৎ অন্তত ফেব্রুয়ারি, মার্চ নাগাদ নির্বাচন হওয়া উচিৎ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মামুনুল হক।
তিনি বলেন, বিএনপি যে সময়ে নির্বাচন চাইছে আর প্রধান উপদেষ্টা যে সময়সীমা দিয়েছেন তার মধ্যে খুব একটা ফারাক নেই। সেক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টা সুনির্দিষ্ট একটি মাসের ঘোষণা দিতে পারেন, বলেন তিনি।
এছাড়া নির্বাচনের সঙ্গে যদি বিএনপি বিচার ও সংস্কারকেও তার দাবির মধ্যে গুরুত্বের সঙ্গে যুক্ত করে তবে তারা অন্য দলগুলোর সমর্থন পাবে বলেও মনে করেন মামুনুল হক।
তবে নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অবস্থানের বিষয়ে কিছু বলতে রাজি নয় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং কেন্দ্রীয় মিডিয়া ও প্রচার বিভাগের প্রধান এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, একেক দল তার তার মতো, স্ব স্ব অবস্থান থেকে তার যেটা ভালো মনে হয় বলবে।
ডিসেম্বর থেকে জুনের যে সময়সীমার কথা সরকার বলছে, তারমধ্যে রোজার আগে ফেব্রুয়ারিতে বা রোজার পরে এপ্রিলে সুবিধামতো সময়ে নির্বাচনের চাইছে দলটি।
‘এটা কেবল বিএনপির দাবি না, জনগণের দাবি’ এনসিপি ও ইসলামপন্থি দল বাদে অন্য রাজনৈতিক দলগুলো অবশ্য বিএনপির এই অবস্থানকে ইতিবাচকভাবেই দেখছে।
বিশেষ করে গত নয়মাসে সরকারের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড এবং বাড়তে থাকা রাজনৈতিক বিভাজন ও মতানৈক্যের প্রেক্ষাপটে দ্রুত নির্বাচন করা জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর।
আমরা রাজনৈতিক দলগুলো আলাপ-আলোচনা করেছি যে, নির্বাচনের একটা সুনির্দিষ্ট দিন তারিখ ঘোষণা করা দরকার, বলেন তিনি।
সেক্ষেত্রে ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ কিংবা এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কিন্তু এরচেয়ে বেশি দেরি করলে বৃষ্টি-বাদলার মতো প্রাকৃতিক কারণেই নির্বাচন পিছিয়ে সরকার ঘোষিত নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ায় শঙ্কা আছে বলে মনে করেন নুর।
এছাড়াও সংস্কার প্রশ্নে দলগুলো একমত হলেও কার্যত কোনো পরিবর্তন দৃশ্যমান না হওয়ায় এক ধরনের হতাশাও আছে, সরকারও দেয়নি কোনো সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ। যার ফলে বিএনপি একটা বড় দায়িত্বশীল দল, তারা মনে করছে এভাবে সবকিছুকে অস্পষ্টতার মধ্যে রেখে, সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে।
সেখান থেকে আমি মনে করি বিএনপি ঠিক বলেছে এবং সরকারের এটা আমলে নেয়া উচিত, বলেন তিনি। অনেকটা একই মত বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হকের। তিনি বলছেন, ডিসেম্বরতো বটেই তার আগেও নির্বাচন করা সম্ভব।
তার মতে, এই সরকার নির্বাচন জুনে করার যৌক্তিক কোনো কারণ দেখাতে পারছে না। ফলে তা অপ্রয়োজনীয় কালক্ষেপণের ধারণা তৈরি করছে। নির্বাচন শুধু বিএনপির দাবি না বরং জনগণের দাবি উল্লেখ করে মামুনুল হক বলেন, ১৬ বছর ধরে মানুষ তার পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচন করার জন্য অপেক্ষা করছে।
একইসঙ্গে দেশের মধ্যে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে, নির্বাচনের সূচি ঘোষণার পর তাতেও লাগাম আসবে বলে মন্তব্য করেন এই রাজনীতিবিদ।
নির্বাচনের শিডিউল ডিক্লেয়ার হলে, নির্বাচনের কাজে গতি আসবে। নির্বাচনমুখী তৎপরতায় সবাই যুক্ত হবে। এবং দেশের বিদ্যমান যে অস্থিরতা, আধা নৈরাজ্যিক যে অবস্থাটা চলছে তারও খানিকটা অবসান হবে, বলেন তিনি।
দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দ্রুততম সময়ে নির্বাচন চায় নাগরিক ঐক্যও। তবে নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে এখনই কোনো জোরাল সিদ্ধান্তে যেতে চাইছে না দলটি।
ডিসেম্বর আর জুনের জেদাজেদির মধ্যে যেতে চাই না। আমরা মনে করি ডিসেম্বরে ভোট করা যায়, সরকার চাইলে (নির্বাচন)করতে পারে আর সেটা যুক্তিসংগতও হবে। কিন্তু এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করার ঝুঁকির কথা ভেবে আমরা হয়তো পড়ে সিদ্ধান্ত নেবো, বলেন দলটির সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না।
আর সংস্কার নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি যে প্রত্যাশা ছিল নয় মাসের পারফর্ম্যান্সে তা আর নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, সময় দীর্ঘায়িত করলেও বেশি কিছু হবে, এমন মনে হচ্ছে না।
রাজনৈতিক সংকট বাড়বে?
নির্বাচন নিয়ে বিএনপি যদি দৃঢ় অবস্থানে চলে যায়, আর সরকারও সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা না করে তবে দেশের রাজনীতিতে নতুন সংকট তৈরি হতে পারে বলেই মনে করছেন রাজনীতিবিদরা।
এনিয়ে মান্না বলেন, সংকট তৈরি হবে কিনা তা নির্ভর করবে সব পক্ষের আচরণের ওপর। কেউই যদি বাড়াবাড়ি করার চেষ্টা করে, বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে- ওই রিস্কটা আছে, কোনো সন্দেহ নেই, বলেন তিনি।
নির্বাচন নিয়ে দীর্ঘ ১৬ বছরের লড়াইয়ের পর সবার সমর্থনে ও ঐকমত্যে নতুন যে সরকারকে বসানো হয়েছে, তাদের সামনেও যদি আবার আন্দোলন করতে হয়, সেটা আমাদের জন্যে বিব্রতকর, সরকারের জন্যেও বিব্রতকর হবে, বলছিলেন সাইফুল হক।
নির্বাচন প্রসঙ্গে এনসিপির বিষয়টিও টেনেছেন একাধিক রাজনীতিবিদ। তারা বলছেন, নতুন দলকে সুবিধা দেওয়ার জন্যেই সরকার নির্বাচনের স্পষ্ট সময়সীমা জানাচ্ছে না।
এনিয়ে সাইফুল হক বলেন, নির্বাচন প্রলম্বিত করতে চায় কারা? আমি যদি সুনির্দিষ্ট করে বলি, যারা এসরকারের সুবিধাভোগী, যারা অন্তর্বর্তী সরকার থেকে রাজনৈতিক সুবিধা নিচ্ছে, অর্থনৈতিক সুবিধা নিচ্ছে - প্রশাসনিক সুবিধা নিচ্ছে তারা ইনডিফিনিট পিরিয়ডে সরকারের মেয়াদকে দীর্ঘায়িত করতে চায়।
বিশেষ করে নতুন দল, যেটা সরকার কোলে পিঠে করে তৈরি করছে, তারা ইনডিফিনিট পিরিয়ডের জন্য সময় চায়, বলছিলেন তিনি। সেক্ষেত্রে সরকার মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে গেলে সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।