বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

‘সবাই শুধু টাকা চায়, কষ্ট কেউ বুঝে না'

যাযাদি ডেস্ক
  ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ২৩:১৩
ছবি : যায়যায়দিন

এমনও ঘটনা ঘটে কোনো প্রবাসী বিদেশে মারা গেলে বাংলাদেশে থাকা তার স্বজনরা লাশ আনতে চান না। কারণ এতে আর্থিক ক্ষতি হবে পরিবারের। তখন তারা বলেন, এত টাকা খরচ করে লাশ আনার দরকার নাই। অথচ এই মানুষটা যাদের জন্য এত কষ্ট করলো তারাই আজ তার লাশও দেখতে চায় না। শুধু টাকার জন্য।

জানা গেছে, বাংলাদেশের মত নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়ার একটি অন্যতম উপায় প্রবাসী আয়। অথচ বিদেশের মাটিতে রক্ত জল করে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখা এই সব প্রবাসীরা দেশ, সমাজ এমনকি পরিবারের কাছেও অবহেলিত থেকে যান।

এশিযার দেশ শ্রীলঙ্কার কথা মনে আছে, ২০২২ সালে দেশটি নিজেদের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ যে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছিল তার মূল কারণ ছিল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে চলে যাওয়া। তখন শ্রীলঙ্কা সরকার অর্থনীতি বাঁচাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা শ্রীলঙ্কানদের দেশে বেশি বেশি বৈদেশিক মুদ্রা পাঠানোর অনুরোধ করেছিলেন।

শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থার সময় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়েও জোর আলোচনা শুরু হয়। যা এখনও দেশে দারুণ ‘সংবেদনশীল' একটি বিষয়।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নানা সূচকে এগিয়ে থাকা শ্রীলঙ্কার ওই পরিণতি সকলকে বিস্মিত করেছিল। যে অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা দেশের ঝুঁকির দিকগুলো এবং সে ঝুঁকি মোকাবেলায় কোন কোন খাতে কাজ করতে হবে তা তুলে ধরেছিলেন। তাদের সেই আলোচনায় গুরুত্বের সঙ্গে উঠে আসে প্রবাসী আয় বাড়ানোর বিষয়টি।

দীর্ঘ আট বছর সৌদি আরবে প্রবাস জীবন শেষে ঈদুল ফিতরের দুই দিন আগে দেশে এসেছেন সাতক্ষীরার হাফেজ মোহাম্মদ মোমিনুল ইসলাম। যিনি ২০১৭ সালে দালালের মাধ্যমে প্রায় সাত লাখ টাকা খরচ করে সৌদি আরবে যান। ডয়চে ভেলে বাংলাকে তিনি শুনিয়েছেন তার দীর্ঘ প্রবাস জীবনে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যাওয়ার গল্প।

মালির কাজ নিয়ে সৌদি আরব গেলেও সেখানে গিয়ে মোমিনুল সেই কাজ পাননি। বরং তার কফিল (যে মালিক তাকে ভিসা দিয়েছিলেন) তাকে ছেড়ে দিয়ে নিজের মত কাজ খুঁজে নিতে বলেন। উপরন্তু কফিল প্রতিমাসে তার কাছ থেকে ৩০০ রিয়াল চেয়ে বসে। অবশ্যই দিতে হবে, নতুবা কাজ ছেড়ে পালিয়ে গেছে অভিযোগে মিথ্যা মামলার হুমকি দেন।

মোমিনুল বলেন, "প্রথম তিন মাস তেমন কোনো কাজ পাইনি। খেয়ে-না খেয়ে ছিলাম, কখনো রাস্তায় রাস্তায় থাকতে হয়েছে, কেউ খোঁজ নেয়নি। দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের মাধ্যমে অল্প কিছু কাজ করতাম। সাগরে মাছ ধরার জাল বোনার কাজ পেয়েছিলাম। কিন্তু দীর্ঘ সময় বসে থেকে কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ি বিধায় কাজ ছেড়ে দেই। কিন্তু কফিলকে প্রতিমাসে তিনশ রিয়াল দিতেই হতো। তিনমাস অনেক কষ্ট করার পর পরিচিত এক চাচার মাধ্যমে একটি বেকারিতে কাজ পাই। তখন মাসে ১৫০০ রিয়াল বেতন পেতাম।”

এদিকে ছয় মাস পর কফিল মোমিনুলের কাছে চারশ রিয়াল দাবি করেন। বাধ্য হয়ে তা দিতে রাজি হন এই যুবক। কিন্তু দুই মাস যেতে না যেতেই কফিল মোমিনুলের কাছে পাঁচশ রিয়াল দাবি করে বসেন।

"আমি তখন তাকে অনুরোধ করি, মাত্র ১৫০০ রিয়াল বেতন পাই। ৫০০ তাকে দিলে আমার তো কিছু থাকে না। বাড়িতে ঋণ শোধের চাপও বাড়ছিল। কিন্তু কফিল টাকা কম নিতে রাজি না। পরে আমি রেখে গিয়ে তাকে বলি আমি আর কোনো টাকাই দিব না। তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেই। ফোনে তার নম্বর ব্লক করি। তখন কফিল আমার নামে মামলা করে দেয়।”

মামলার কারণে পুলিশের ভয়ে থাকতেন মোমিনুল। লুকিয়ে কাজ করতেন। নিজের কাগজপত্র বৈধ করতে বহুবার চেষ্টা করেছেন তিনি। কিন্তু কেউ তাকে সাহায্য করেনি। জানান, আট বছরের প্রবাস জীবনে তিনবার গ্রেপ্তারও হয়েছেন। দুই-একদিন কারাগারে থাকার পর মোটা অংকের অর্থ দিয়ে মুক্তি মিলেছে।

"অর্থ উপার্জনের জন্য অমানুষিক পরিশ্রম করেছি। ৪০ ডিগ্রির উপরের তাপমাত্রায় রাতে ১২ ঘণ্টা বেকারিতে কাজ করার পর দিনে আবার পার্টটাইম কাজ করতাম। আল্লাহর রহমতে এক সময় আয় বাড়ে। ঋণ শোধ করে ভবিষ্যতের জন্য বাড়িতে টাকা পাঠাতে শুরু করি।”

এই আট বছরে একবারও দেশে আসেননি মোমিনুল। কারণ, তার বৈধ কাগজপত্র ছিল না। মোমিনুল যখন প্রবাস জীবনে খানিকটা গুছিয়ে নিয়েছেন তখন হানা দেয় করোনা মহামারি। যদিও করোনা মহামারি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি বলে জানান তিনি। বলেন, ওই সময়ে সম্পূর্ণ লকডাউন ছিল ১৫ দিন। তাছাড়া, কাজ চলেছে। আর বেকারির কাজ তো বন্ধ করার উপায়ও নেই। তাই তার উপার্জনে তেমন প্রভাব পড়েনি।

কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে নিত্যপণ্যের দাম দুই-তিনগুণ বেড়ে যায়। আয় না বাড়ায় তাকে তাই খানিকটা চাপে পড়তে হয়। কেউ কেউ তখন কুলিয়ে উঠতে না পেরে দেশে চলে আসে বলে জানান তিনি।

"ইউক্রেন যুদ্ধের আগে সৌদি আরবে আটার দাম ছিল হাফ রিয়াল। যুদ্ধ শুরুর পর তা দুই রিয়াল পর্যন্ত উঠে যায়। এরকম সব পণ্যের দামই কম-বেশি বেড়ে যায়। যে দাম আর খুব একটা কমেনি।”

আট বছরের প্রবাস জীবন শেষে মোমিনুল একেবারেই দেশে চলে এসেছেন। যেহেতু তার কাগজপত্র বৈধ নয়, তাই ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। তাকে প্রশ্ন করেছিলাম দেশে এখন কী করবেন? তিনি জানান, আরেকটু সময় নিয়ে, একটু ভেবেচিন্তে কোনো একটা ব্যবসা শুরু করবেন। এজন্য পুঁজি দরকার। কতটা পুঁজি নিয়ে এসেছেন জানতে চাইলে তিনি খানিকটা আক্ষেপের সুরে বলেন, "কিছু পুঁজি নিয়ে এসেছি। তবে পরিবার যদি সহযোগিতা করতো তবে আরো বেশি সঞ্চয় হতো। মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আমার পরিবার। সবাই শুধু টাকা চায়। আমাদের কথা কেউ ভাবে না। সবাই মনে করে প্রবাসীরা টাকার গাছ। আমরা যে কত কষ্ট করে টাকা কামাই পরিবার সেটা দেখে না।

"চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিতে পারলে আমরা হিরো, না পারলে আমরা ভিলেন। আমাদের ভালো-মন্দের খোঁজ কেউ রাখে না।”

একই রকম কথা শোনান জনি মন্ডল। ঢাকায় মোটর মেকানিকের কাজ করা এই তরুণ গাড়ির গ্যারেজের কাজ নিয়ে ২০২১ সালের শেষ দিকে করোনা মহামারি যখন বিদায় নিতে শুরু করেছে তখন সৌদি আরব যান।

জনি বলেন, শুরুতে ভালোই ছিলাম। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর চাল, তেল, আটাসহ সব নিত্যপণ্যের দাম অনেক বেড়ে গেছে। তাদের আয় বাড়েনি। এই টাকায় তারা চলতে পারছেন না। বাড়িতে ঠিকমত টাকা পাঠাতে পারেন না। পরিবার থেকেও তখন চাপ আসে। বেশিরভাগ মানুষ তো ঋণ করে বিদেশে আসে।

"প্রত্যেক বছর আকামা করতেই ১০ হাজার রিয়াল লেগে যায়। অনেকে পোষাতে না পেরে তাই দেশে চলে গেছেন।”

কাতার প্রবাসী সুমন আহমেদ অবশ্য খানিকটা ভিন্ন চিত্র তুলে ধরেছেন। প্রায় নয় বছর ধরে তিনি কাতারে আছেন, সেখানে সেলসে কাজ করেন।

নিজের আয়, কাজের পরিবেশ নিয়ে তিনি বেশ সন্তুষ্ট। দুই সন্তানের জনক সুমন আহমেদ দুইবার দেশে থেকে ঘুরে এসেছেন। তার আয়ে পরিবার বেশ স্বচ্ছন্দে চলছে। ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয়ও করতে পারছেন।

তিনি বলেন, "করোনা মহামারী, ইউক্রেন যুদ্ধ বা গাজা যুদ্ধের কারণে আমাদের কাজের পরিবেশে পরিবর্তন হয়নি। আয়ও একই আছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছিল। তবে এখন তা অনেকটাই কমে এসেছে। আগের মত না হলেও নাগালের বাইরে নয়।”

নিজের প্রবাস জীবন নিয়ে এক ধরনের সন্তুষ্টি দেখা গেছে সুমন আহমেদের কথায়। তবে সবাই তার মতো ভাগ্যবান নন।

বরং বেশিরভাগ প্রবাসীকেই প্রবাসে কষ্টকর এক জীবন পাড়ি দিতে হয়। দেশের জন্য, পরিবারের জন্য শত কষ্ট সহ্য করেও তারা কাজ করে যান। দেশের জন্য শুধু রেমিটেন্স যোদ্ধা আর পরিবারের জন্য ‘টাকা ছাপানোর মেশিন হয়ে নয়' বরং সবার কাছে সম্মান আশা করেন তারা।

যাযাদি/এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে