ঢাকাই সিনেমায় কার গাওয়া প্লে-ব্যাক সবচেয়ে বেশি মুগ্ধতা ছড়িয়েছে- এমন প্রশ্নে যার নাম কোনো প্রকার দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই সবচেয়ে বেশি শোনা যাবে, তিনি এ দেশের সঙ্গীতের জীবন্ত কিংবদন্তি চিরসবুজ গানের পাখি ফেরদৌসী রহমান। ৬০ ও ৭০-এর দশকের ঢাকাই বাংলা চলচ্চিত্রের বহু প্লে-ব্যাকে নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে যুক্ত ছিলেন তিনি। তার এমন অনেক গান আছে যেগুলোর সুর ও কণ্ঠ চিরকালের শ্রোতাদের কানকে আচ্ছন্ন করে রাখবে।তিনি সবার কাছে খালামনী হিসেবে পরিচিত। কারণ বাংলাদেশ টেলিভিশনে তিনি দীর্ঘদিন ধরে ছোটদের গান শিখার আসর নামে একটি অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। যেখানে শিক্ষার্থীরা তাকে খালামন্ত্রী হিসেবে সংবোধন করতো। সে কারণে ঘরে ঘরে তিনি খালামনি হিসেবে খ্যাতি পান।
‘যে জন প্রেমের ভাব জানে না’, ‘যার ছায়া পড়েছে মনের আয়নাতে’, ‘এই যে নিঝুম রাত ঐ যে মায়াবী চাঁদ’, ‘এই রাত বলে ওগো তুমি আমার, ‘প্রাণ সখিরে ঐ শোন কদম্বতলে বংশী বাজায় কে’, ‘মনে যে লাগে এতো রঙ ও রঙিলা’, ‘ঝরা বকুলের সাথী আমি সাথী হারা’, ‘নিশি জাগা চাঁদ হাসে কাঁদে আমার মন’, ‘আমার প্রাণের ব্যথা কে বুঝবে সই’, ‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের যাদু এনেছি’, ‘পদ্মার ঢেউরে’, ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই’সহ আরও অনেক জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন ফেরদৌসী রহমান। এমনি শত শত গান সিনেমায় আর রেকর্ডে গাওয়ার কারণে এক সময়ে তার জনপ্রিয়তা হয়ে উঠেছিল গগনচুম্বী। ঢাকার সিনেমা হিট হওয়ার অনিবার্য হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল ফেরদৌসীর গান।
১৯৫৯ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ফেরদৌসী ছাড়া সিনেমার গান ছিল একেবারেই অচল। ফেরদৌসী রহমান ফিল্মে গান করা ছেড়ে দিয়েছেন বহু বছর হয়। অথচ তার গাওয়া অতীতের সেই সব গান আজও অবধি জনপ্রিয় হয়ে আছে। আর এজন্যই সঙ্গীত ভুবনে ফেরদৌসী রহমান কিংবদন্তি। প্রজন্মের পর প্রজন্মের সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবেও সবার কাছে এক মুগ্ধতার নাম ফেরদৌসী রহমান। কণ্ঠে, চেহারায়, গালভরা হাসিতে আগে যেমনটি ছিলেন এখনো ঠিক তেমনটিই অমলিন রয়েছেন।
কিংবদন্তি ও প্রখ্যাত পল্লীগীতি সম্রাট আব্বাসউদ্দীনের সুযোগ্য কন্যা। ফেরদৌসী রহমান ও তার বাবা দুজনই বাংলা গানকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। ফেরদৌসী রহমানের হাত ধরেই বাংলাদেশ টেলিভিশনে যাত্রা শুরু হয় গান শেখানোর অনুষ্ঠান ‘এসো গান শিখি’। এখনো মাসে চারবার অনুষ্ঠানটি বিটিভিতে প্রচার হয়। সময়ের ছাপটুকু ছাড়া দেখতে প্রায় সেই অবিকল ফেরদৌসী রহমান জীবন চলার পথ পরিক্রমায় গত সপ্তাহে ৮৩-তে পা রেখেছেন। ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারে ১৯৪১ সালের ২৮ জুন জন্মগ্রহণকারী বাংলা সঙ্গীতের অনন্য প্রতিভা ফেরদৌসী রহমান বলেন- ‘দেখতে দেখতে জীবনের এতটা বছর পেরিয়ে এলাম। এখন এই বয়সে খুউব বেশি প্রয়োজন না হলে, জরুরি কাজ না থাকলে ঘরের বাইরে বের হই না। ঘরে বসে যাদের গান ভালো লাগে মাঝে মাঝে তাদের গান শুনি। যেমন শাহনাজ রহমতুল্লাহ, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, কনকচাঁপা, শাকিলা জাফর, আলম আরা মিনু- এদের সবার কণ্ঠে আমার গান শুনতে ভালো লাগে। শাহনাজ, রুনা, সাবিনার তো এমন কিছু গান আছে- যেগুলোর জন্য শ্রোতা মনে রাখবে তাদের আজীবন। পরবর্তীতে বাপ্পা মজুমদার, ন্যান্সি, লিজাও ভালো করছে।
তারপরও সবশেষে একটা কিন্তু থেকে যায়। এখন যারা গান করছে তারা গানের গ্রামারটা ভালো করে জেনেবুঝে গানের চর্চাটা করছে না। গান আসলে সাধনার বিষয়। এর বিকল্প বা শর্টকাট কোনো রাস্তা নেই। যে কারণে আমি এখনো বিটিভির ‘এসো গান শিখি’ অনুষ্ঠানটা করি। যাতে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত আমি গানে আমার জ্ঞানটুকু দিয়ে যেতে পারি। যাই হোক আমি সবার দোয়া প্রার্থী।’
ফেরদৌসী রহমান বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনের এক উজ্জ্বল তারা। বাংলা গানের সব ঘরনাতেই তার সাবলীল বিচরণ দর্শক-শ্রোতাকে মুগ্ধ করে। একাধারে পল্লীগীতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলসঙ্গীত, ইসলামিক গান, গজল, আধুনিক ও প্লেব্যাকের শিল্পী। চলচ্চিত্রসহ সব ঘরানার গানই প্রস্ফুটিত হয়েছে এই গুণী শিল্পীর কণ্ঠে। সঙ্গীত জীবনের সাফল্যের ধারাবাহিকতা সেই যে ছোট্টবেলায় শুরু হয়েছিল তা এখনো বহমান, অম্লান ও অটুট হয়ে আছে। এই শিল্পীর গানের হাতেখড়ি হয়েছে প্রথমে তার পিতা পল্লীগীতি সম্রাট আব্বাস উদ্দিনের কাছে। এছাড়া ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, ইউসুফ খান কোরেইশী, কাদের জামেরী, গুল মোহাম্মদ খানসহ বেশ কয়েকজন নামজাদা সংগীতজ্ঞের কাছে তালিম নিয়েছেন। গানে গানে সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের আজীবন সম্মাননা, সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ দেশ-বিদেশের নানান পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন তিনি।
দেশের গর্বিত এই সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব তার জীবন চলার পথে যেসব কৃতিত্বের ছাপ রেখে এসেছেন তা দেশের সঙ্গীতের ইতিহাসে চির অম্লান হয়ে থাকবে। ১৯৪৮ সালে মাত্র ৮ বছর বয়সে জীবনের প্রথম রেডিও’র ‘খেলাঘর’ অনুষ্ঠানে গান করেন। ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ টেলিভিশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গান করেন তিনি। ১৯৫৭ সালে প্রথম গান রেকর্ড করেন এইচ এম ভি থেকে। ১৯৬০ সালে ‘আসিয়া’ সিনেমাতে তারই বাবা পল্লীগীতি সম্রাট আব্বাসউদ্দিনের সুরে আব্দুল করিমের লেখা ‘ও মোর কালারে’ গানটি গান। তবে তার আগেই ‘এদেশ তোমার আমার’ সিনেমা মুক্তির মধ্য দিয়ে প্লে-ব্যাক শিল্পী হিসেবে তার অভিষেক হয়।
নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডেরও সদস্য ছিলেন তিনি। দেশের সঙ্গীত ভুবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য তিনি জাতীয় পর্যায়ে নানাভাবে সম্মানিত হয়েছেন। তার অর্জিত উল্লেখযোগ্য পুরস্কারের মধ্যে আছে লাহোর চলচ্চিত্র সাংবাদিক পুরস্কার (১৯৬৩ সাল), প্রেসিডেন্ট প্রাইড অব পারফরম্যান্স পুরস্কার (১৯৬৫ সাল), টেলিভিশন পুরস্কার (১৯৭৫), জাতীয় পুরস্কার শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক (১৯৭৭), বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার (১৯৭৬), একুশে পদক (১৯৭৭ সাল)। এছাড়াও তিনি নাসিরউদ্দিন গোল্ড মেডেল পুরস্কার, মাহবুবুল্লাহ গোল্ড মেডেল, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান পুরস্কার পান।
১৯৬৬ সালের ২৬ অক্টোবর মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার রেজাউর রহমানের সঙ্গে ফেরদৌসী রহমানের বিয়ে হয়। তাদের রুবাইয়াত ও রাজিন নামের দুই ছেলে আছে।
যাযাদি/ এস