বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বদলে যাচ্ছে ঋতুচক্র

আলতাব হোসেন
  ৩০ মে ২০২৩, ০৯:৩৬

‘ব্যাঙ ডাকে ঘন ঘন, শীঘ্র হবে বৃষ্টি জানো। যদি হয় চৈতে বৃষ্টি, তবে হবে ধানের সৃষ্টি। জৈষ্ঠ্যতে তারা ফোটে, তবে জানবে বর্ষা বটে। গাছে গাছে আগুন জ্বলে, বৃষ্টি হবে খনায় বলে।’ এই গরমে কোক স্টুডিও বাংলা দ্বিতীয় সিজনের এই গানটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। গানটিতে কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে বৃষ্টির প্রয়োজনীয়তার কথা উঠে এসেছে। বহুকাল ধরে বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে খনার এ বচন প্রচলিত আছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে এবার স্বাভাবিক সময়েই আসছে বর্ষা। জুনের শুরুতেই বর্ষার বৃষ্টিতে ভিজবে পুরো দেশ।

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের শস্য উৎপাদন পঞ্জিকা বৃষ্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বর্ষার নতুন পানিতে আমন ও আউশ রোপণ করেন কৃষক। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বজ্রপাত শুরু হলে মাছ, ব্যাঙ ও সরীসৃপ প্রাণীদের প্রজনন শুরু হয়। পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদীগুলোয় মা-মাছ ডিম পাড়তে আসে। এ সময় পাট জাগ দিতেও প্রয়োজন হয় পানির। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বদলে যাচ্ছে ঋতুচক্র। সময়ে দেখা না মিললেও অসময়ে বৃষ্টির বাড়াবাড়ি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ। এর প্রভাব পড়ছে কৃষি ও জনজীবনে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, আষাঢ়-শ্রাবণের সেই মুষলধারার বৃষ্টি এখন আর নেই। বর্ষাকালে বৃষ্টির পরিমাণও কমে গেছে। এতটাই কমেছে যে স্বাভাবিকের চেয়েও গড়ে প্রায় ২৫ ভাগ কম।

খনার বচনে আছে, ‘যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্য রাজার পুণ্য দেশ’এ কথার অর্থ, মাঘের শেষের বৃষ্টিপাতে রাজা ও দেশের কল্যাণ হয়। বাংলাদেশে আমন চাষ সম্পূর্ণ বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল। জলবায়ুর প্রভাবে এখন ভরা বর্ষায়ও বৃষ্টির দেখা মেলে না। ফেটে চৌচির হয় ফসলের মাঠ। আবার কখনো চলে অতিবৃষ্টির বাড়াবাড়ি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আবহাওয়া তার ব্যাকরণ ভুলে শস্য পঞ্জিকায় অসময়ে হানা দিচ্ছে।

প্রকৃতির বৈরী আচরণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি ও কৃষির উপখাত। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বহুলাংশে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধির ওপর নির্ভরশীল।

আবহাওয়ার গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে এবার যথাসময় বৃষ্টি আসার কথা। এবার বর্ষা স্বাভাবিক সময় আসবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ, জাপান ও ভারতের আবহাওয়া দপ্তর। এতে বলা হয়েছে, এ বছর বর্ষার আগমন ঘটবে যথাসময়ই। স্বাভাবিক এবং স্বাভাবিকের চেয়ে এবার ৪৭ শতাংশ বেশি বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। আবহাওয়া দপ্তরের এ ঘোষণায় স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন কৃষকরা। এ বছর ৪ জুনের কাছাকাছি বর্ষা আসার সম্ভাবনা রয়েছে। আবহাওয়া অফিসের মতে, কয়েক বছর ধরে আগ বাড়িয়ে বর্ষা এলেও এই বছর বর্ষা স্বাভাবিক সময়ে আসবে।

আবহাওয়াবিদ ডক্টর আবুল কালাম বলেন, দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে একটি বঙ্গোপসাগর অন্যটি ভারত সাগর অতিক্রম করে বৃষ্টি নামিয়ে বর্ষার শুরু করে। মৌসুমি বায়ুর একটি শাখা আরব সাগর দিয়ে কেরালা হয়ে ভারতে ঢোকে। বঙ্গোপসাগরের শাখাটি আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বৃষ্টি নামিয়ে কক্সবাজার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে বর্ষা।

বর্ষার আগমনে গর্জনে-বর্ষণে আকাশে মেঘদূতের ঘন-কালো রূপ। ষড়ঋতুর এ দেশে বর্ষা অনন্য, তার রূপের সৌন্দর্যে। বর্ষায় প্রকৃতি সাজে নবযৌবনের রূপে। পুষ্পে-বৃক্ষ, পত্রপল্লবে পায় নতুন প্রাণের সুর। চারদিকে যেন নব উছ¡াসের জোয়ার জাগে। নদীনালা, খালবিল ফিরে পায় প্রাণের ছোঁয়া। মৃত খাল-বিলগুলোও যেন বেঁচে থাকার স্পদনে জেগে ওঠে। গ্রামের মাঠ ঘাটগুলো বর্ষার ছোঁয়ায় জল থইথই করে। বৃষ্টির রিমঝিম ধ্বনিতে পেখম মেলে ময়ূর। বর্ষা নিয়ে কাব্যের অভাব নেই বাংলা সাহিত্যে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবহাওয়ার বৈরী আচরণে বর্ষার বৃষ্টিপাতের ধরন পাল্টে গেছে। এতে দেখা যায়, প্রতিবছর বৃষ্টিপাত টেকনাফে ৩৬ শতাংশ, কক্সবাজারে ২২ এবং পটুয়াখালী ও বরগুনায় ১৫ ও ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। অন্যদিকে ভোলা ও খুলনা-বাগেরহাট এবং সাতক্ষীরায় বৃষ্টিপাত ২০ শতাংশ করে কমে যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, গত ৩০ বছরে দেশের চট্টগ্রাম বিভাগে বৃৃষ্টিপাত অব্যাহতভাবে বাড়ছে। বিশেষ করে সেখানে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ শতাংশ বাড়ছে। অতিবৃষ্টির কারণে পার্বত্য এলাকায় পাহাড়ধস হচ্ছে। অন্যদিকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় লবণাক্ততা বাড়ছে। এতে ফসল উৎপাদন বিপর্যস্ত হচ্ছে। জলবায়ুর প্রভাবে বৃৃষ্টিপাতের ধরণ পাল্টে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছেন কৃষক। হেমন্তের বৃষ্টি অস্বাভাবিক এবং কৃষির জন্য ক্ষতিকর।

২০১৭ সালের শুরুতে অতিবৃষ্টিতে উজান থেকে নেমে আসা আগাম ঢলে হাওড়ের ধান তলিয়ে যায়। ওই বছর ব্রহ্মপুত্র নদের উজানে ১০০ বছরের রেকর্ড ভেঙে বেশি বৃষ্টি হয়। ওই পানি উজানের এলাকা বাংলাদেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চল দিয়ে বঙ্গোপসাগরে যাওয়ার সময় দেশের প্রায় ৮০ লাখ মানুষের ক্ষতি করে যায়। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের বৃষ্টি আগের ৫২ বছরের রেকর্ড ভেঙে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। ২০২০ সালের কার্তিকের বৃষ্টি যেন আষাঢ়-শ্রাবণের বৃষ্টিকেও হার মানিয়েছে। ২০২০ সালের অসময়ের বৃষ্টি ১০০ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। রংপুরে মাত্র ১৪ ঘণ্টায় ৪৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। অথচ প্রতিবছর জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গড়ে সারাদেশে ২২৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বদলে যাচ্ছে ঋতুচক্র। সময়ে দেখা না মিললেও অসময়ে বৃষ্টির বাড়াবাড়ি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন মানুষ। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা ও জাতিসংঘের আন্তঃসরকার জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত প্যানেল (আইপিসিসি) বলছে, শিল্পোন্নত দেশগুলোর বিপুল কার্বন নিঃসরণের ফলে বৈরী হয়ে উঠছে আবহাওয়া। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মমতার শিকার বাংলাদেশ। জলবায়ুর প্রভাবে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। সেই সঙ্গে দিনের পর দিন বাড়ছে আবহাওয়ার খামখেয়ালি আচরণ। অসময়ে বৃষ্টির মাত্রা বেড়ে যাওয়ার মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে বলে বলছেন বিজ্ঞানীরা।

আবহাওয়াবিদ ডক্টর সমর সাহা জানান, বৃষ্টি এক ধরনের তরল, যা আকাশ থেকে মাধ্যাকর্ষণের টানে ভূপৃষ্ঠের দিকে পড়ে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়ে মেঘের সৃষ্টি করে। এই মেঘ যথেষ্ট পরিমাণে ভারী হলে তা বৃষ্টি আকারে পৃথিবীর বুকে ঝরে পড়ে- একেই বলে বৃষ্টি। বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলে বৃষ্টি সুপেয় জলের বড় উৎস। বিচিত্র জৈব ব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখতে, জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো সচল রাখতে ও কৃষি সেচ ব্যবস্থা সচল রাখতে বৃষ্টির প্রয়োজন হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির বাড়াবাড়ির ফলে দেশে খাদ্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, নতুন নতুন দুর্যোগ বাড়ছে ও রোগবালাইয়ের প্রকোপ দেখা দিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বৃষ্টিপাত মাপার ক্ষেত্রে বৃষ্টির ধারাকে মিলিলিটারে গণনা করা হয়। তারপর স্কেল অনুযায়ী পরিমাপ করে হালকা, ভারী, অতি ভারী ও চরম বৃষ্টিপাতের হিসাব দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে ঘণ্টায় ০.২৫ মিলিমিটার থেকে ১ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাতকে হালকা, ৪ মিলিমিটার থেকে ১৬ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাতকে ভারী, ১৬ মিলিমিটার থেকে ৫০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাতকে অতিভারী এবং ৫০ মিলিমিটারের অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতকে চরম বৃষ্টি আখ্যা দেওয়া হয়।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে