শনিবার, ৩১ মে ২০২৫, ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

দেশে প্রথমবার মুরগির আইবিএইচ ভাইরাসের দুই সেরোটাইপ শনাক্ত

বাকৃবি প্রতিনিধি
  ২৯ মে ২০২৫, ১৭:০১
আপডেট  : ২৯ মে ২০২৫, ১৭:২৫
দেশে প্রথমবার মুরগির আইবিএইচ ভাইরাসের দুই সেরোটাইপ শনাক্ত
ছবি: যায়যায়দিন

দেশে প্রথমবারের মতো ব্রয়লারের দেহে ইনক্লুশন বডি হেপাটাইটিস (আইবিএইচ) রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী ফাউল অ্যাডেনোভাইরাসের দুটি সেরোটাইপ (৮বি এবং ১১) শনাক্ত করা হয়েছে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ও সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো. আলিমুল ইসলাম এবং তার গবেষক দল এই দুই সেরোটাইপ (৮বি এবং ১১) শনাক্ত করেন।

1

বাস-ইউএসডিএ'র অর্থায়নে পরিচালিত ওই গবেষণাটিতে নেতৃত্ব দেন অধ্যাপক ড. মো. আলিমুল ইসলাম। গবেষণায় কো-পিআই হিসেবে আছেন বাকৃবির একই বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আরিফুল ইসলাম এবং বাকৃবির স্নাতকোত্তরের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী।

গবেষণাটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে অধ্যাপক ড. মো. আলিমুল ইসলাম বলেন, ২০১৮ সালের দিকে বাংলাদেশে হঠাৎ করে কমবয়সী (৩-৬ সপ্তাহ বয়সী) ব্রয়লার মুরগির ব্যাপক মৃত্যু হয়। এর ফলে খামারিরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।

পরবর্তীতে বড় বড় বাণিজ্যিক ব্রয়লারের খামারিরা মুরগি নিয়ে বিভিন্ন ল্যাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা (হিস্টোপ্যাথোলজি ও মলিকুলার ডিটেকশন) করে দেখেন এটি বার্ড ফ্লু নয়,

আবার রানীক্ষেতও নয়- এটি নতুন একটি ভাইরাস। তারা এটির শুধু আইডেন্টিফিকেশন করতে পেরেছেন কিন্তু আইসোলেশন করতে পারেননি।

ব্রয়লারের মাংস সাধারণ মানুষের আমিষের উৎস, এটি বিবেচনা করেই রোগটির সমস্যার সমাধানে এই গবেষণা। গবেষণাটি সম্প্রতি প্রবন্ধ আকারে Frontiers in Microbiology জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

ভাইরাসটি সম্পর্কে ড. আলিমুল ইসলাম বলেন, ইনক্লুশন বডি হেপাটাইটিস (আইবিএইচ) নতুন একটি উদীয়মান রোগ, যা ফাউল অ্যাডেনোভাইরাসের আক্রমণের কারণে হয়।

ভাইরাসটির ১১টি সেরোটাইপ এবং পাঁচটি জেনোটাইপ রয়েছে। সেরোটাইপ ৮বি এবং ১১ সবচেয়ে মারাত্মক।

রোগটি সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত করে বাণিজ্যিক ব্রয়লারকে এবং লেয়ারেও আক্রমণ করতে পারে।

ওই ভাইরাসে আক্রান্ত মুরগির লক্ষণ সম্পর্কে অধ্যাপক জানান, অল্প বয়সী মুরগির ক্ষেত্রে বিশেষ করে ১৪ দিন বয়সী ব্রয়লার মুরগিতে রোগটি বেশি হয়ে থাকে।

১৫ দিন বয়স থেকে এদের খাবার খাওয়া, চলাচল ও বৃদ্ধি কমে যায় এবং ২১ দিনের মধ্যেই পুরোপুরি লক্ষণ দেখা যায়।

অবসন্নতা, দুর্বলতা, ডায়রিয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিয়ে ৩-৪ সপ্তাহ বয়সের মধ্যেই মুরগিগুলো মারা যেতে থাকে।

আক্রান্ত মুরগিগুলোর পোস্টমর্টেম করলে লক্ষ্য করা যায়, গিজার্ডের ভেতরের স্তরটা নরম হয়ে গেছে এবং টান দিলে সহজেই খসে পড়ছে, লিভার ও কিডনিতে ফোকাল নডুলার গ্রোথ এবং হার্টে হাইড্রোপেরিকার্ডিয়াম দেখা যায়।

এ ভাইরাসের আক্রমণের ফলে মুরগি বড় হওয়ার আগে মারা যায় ফলে বাজারে বিক্রি করতে না পারায় খামারিরা ব্যাপক হারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে।

ভাইরাসটির সংক্রমণের ধরন নিয়ে অধ্যাপক বলেন, ভাইরাসটি ভার্টিক্যাল (ডিমের মাধ্যমে) ও হরিজন্টাল (খামারের এক মুরগি থেকে অন্য মুরগিতে) দু’ভাবেই ছড়াতে পারে।

গবেষণার পদ্ধতি সম্পর্কে ওই গবেষক জানান, ‘কনভেনশনাল পিসিআর, আরটি-পিসিআরের মাধ্যমে আমরা ভাইরাসটি নির্ণয় ও এভিয়ান এমব্রায়োতে ভাইরাসটির আইসোলেশন করেছি এবং আংশিক জিনোম সিকোয়েন্স অ্যানালাইসিস করেছি।

তবে হোল জিনোম সিকোয়েন্স অ্যানালাইসিসের কাজ চলমান আছে। পরবর্তীতে আমরা আইবিএইচ-এর বিরুদ্ধে একটি পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিন তৈরি করি এবং মুরগিতে এর ফিল্ড ট্রায়াল করি।

মুরগিতে ভ্যাকসিনের দুটি শট দিয়ে, এরপর ফিল্ড ভাইরাসের চ্যালেঞ্জ দিয়ে দেখি রোগটির বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনটি সর্বোচ্চ কার্যকর।

যে মুরগিগুলোকে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করেছি, সেগুলো আমরা এক বছর যাবৎ আমাদের কাছে রেখেছি এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেছি। দেখা গেছে, নতুন করে মুরগিগুলো আইবিএইচে আক্রান্ত হয়নি।’

তবে ভ্যাকসিনটির জন্য আরও গবেষণার প্রয়োজন দাবি করে ওই অধ্যাপক জানান, ‘পরীক্ষামূলকভাবে আমরা ভ্যাকসিনটির দুটি ট্রায়াল করেছি এবং তিন নম্বর ট্রায়াল করার পর ভ্যাকসিনের পেপারটি আন্তর্জাতিক জার্নালে উপস্থাপন করবো। তবে ভ্যাকসিনটি নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন। জার্নালে প্রকাশিত হওয়ার পর আমরা ভ্যাকসিনটির বাণিজ্যিকীকরণের দিকে যাব এবং বাণিজ্যিকভাবে ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারলে খামারিরা লাভবান হবে।’

অধ্যাপক জানান, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ডিম ব্যবহার করে তৈরি ভ্যাকসিনের উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় এর দাম আমদানিকৃত ভ্যাকসিনের তুলনায় অর্ধেকেরও কম।

একটি ডিম থেকে গড়ে ২১ ডোজ ভ্যাকসিন তৈরি সম্ভব, ফলে ডোজপ্রতি খরচ অনেক কমে আসে। তাছাড়া, দুই ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়া মিনিমাম সেফটির জন্য জরুরি,

যা অনেক সময় খামারিদের অর্থের অভাবে এবং আমদানীকৃত ভ্যাকসিনের উচ্চমূল্যের কারণে দেওয়া সম্ভব হয় না।

স্থানীয়ভাবে আইসোলেটেড অ্যান্টিজেন ব্যবহারে তৈরি আমাদের পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিনটি ফিল্ড ভাইরাসের সঙ্গে অ্যান্টিজেনিক মিল থাকায় বেশি কার্যকর এবং দ্বিগুণ অ্যান্টিবডি উৎপাদনে সক্ষম। ফলে এটি আমদানিকৃত ভ্যাকসিনের চেয়ে অধিক কার্যকর ও সাশ্রয়ী হবে।

রোগটি মানবদেহে ছড়িয়ে পড়তে পারে কিনা এ বিষয়ে ওই অধ্যাপক জানান, রোগটি জুনোটিক নয়।

অর্থাৎ মানুষে ছড়াবে না। তবে সতর্কতার জন্য মুরগির কলিজা এবং হৃদপিন্ড ফেলে দিতে হবে এবং মাংস খাওয়া যাবে।

এ রোগে আক্রান্ত মুরগির ডিম ভেজে কিংবা সেদ্ধ করে খেলে কোনো সমস্যা হবে না।

কারণ রান্নার তাপে ওই ভাইরাসটি বেঁচে থাকে না। অর্থাৎ ডিমও খাওয়া যাবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে