সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মানবাধিকারের প্রশ্নে অবহেলা কেন?

বর্তমানে নারী ও শিশুরা সবচাইতে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়ে থাকে। শিশুর উপর পৈশাচিক আচরণ ও বর্বর হত্যাকান্ডের মতো ঘটনাও ঘটে। যা খুবই দুঃখজনক। শিশুদের অধিকার রক্ষায় শিশু অধিকার সনদটি ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। শিশু অধিকার সনদে ৪৬টি অনুচ্ছেদ রয়েছে, যা চারটি মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা। বেঁচে থাকা ও উন্নয়নের অধিকার, মতামত প্রদানের অধিকার, বৈষম্যহীন পরিবেশে বেড়ে ওঠার অধিকার এবং শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ দেখা
অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ
  ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

আইন ও বিচার ব্যবস্থা এবং আইনের শাসনের পূর্বশর্তই হচ্ছে মানবাধিকার বাস্তবায়ন। বাংলাদেশের সংবিধানের মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলোর মধ্যে আইনের দৃষ্টিতে সমতা, ধর্ম, বর্ণ, নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে বৈষম্য করা যাবে না, চাকরির সমান সুযোগ, বিদেশি রাষ্ট্রের উপাধি গ্রহণ, আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার, জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার, গ্রেপ্তার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ, জবরদস্তিমূলক শ্রম নিষিদ্ধকরণ, বিচার ও দন্ড সম্পর্কে বিধান, চলাফেরার স্বাধীনতা প্রভৃতি উলেস্নখযোগ্য।

মানবাধিকার বিষয়ে প্রাচীন রোমের বারো বিধি, ত্রয়োদশ শতকে গৃহীত ব্রিটেনের ম্যাগনা কার্টা, ১৭৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণা সনদ প্রভৃতির ধারাবাহিকতায় ১৯৪৮ সালে ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ দ্বারা অনুমোদিত হয় মানবাধিকার সনদ। মানবাধিকার সনদের ৩০টি অনুচ্ছেদে যেসব অধিকারের কথা বলা হয়েছে, সেগুলোই বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার হিসেবে বিবেচিত।

বর্তমানে নারী ও শিশুরা সবচাইতে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়ে থাকে। শিশুর উপর পৈশাচিক আচরণ ও বর্বর হত্যাকান্ডের মতো ঘটনাও ঘটে। যা খুবই দুঃখজনক। শিশুদের অধিকার রক্ষায় শিশু অধিকার সনদটি ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। শিশু অধিকার সনদে ৪৬টি অনুচ্ছেদ রয়েছে, যা চারটি মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা। বেঁচে থাকা ও উন্নয়নের অধিকার, মতামত প্রদানের অধিকার, বৈষম্যহীন পরিবেশে বেড়ে ওঠার অধিকার এবং শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ দেখা।

শিশুদের যে কোনো ধরনের অনাচারের কবল থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তাদের নিরাপত্তা ও বেঁচে থাকার অধিকার জন্মগত। আরবের মরু প্রান্তরে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (স.) মদিনা সনদের মাধ্যমে নারী, শিশু, শ্রমিকসহ মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। মানুষের জন্য স্বীকৃত অধিকার যখন লঙ্ঘিত হয়, তখনই আমরা বলে থাকি মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্বরত ব্যক্তি বিশেষ করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাজ হলো জনগণের নিরাপত্তা দেওয়া এবং আইন প্রয়োগের যতগুলো পদ্ধতি আছে তা সঠিকভাবে প্রয়োগ করা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে বিচার প্রার্থীর বিচার সুনিশ্চিত করা। যে সব শিশু প্রতিকূল পরিবেশে জন্মে ও বড় হয় বিশেষত- যারা পথশিশু, এতিম ও জেল খানায় কয়েদি বা হাজতি মায়ের সঙ্গে আছে সেসব শিশু বা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া কিশোর-কিশোরী তাদের মৌলিক ও মানবাধিকার বলে কিছু আছে?

দারিদ্রের নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত তাদের পরিবার। জীবন সম্পর্কে কিছু বুঝে ওঠার আগেই অর্থ উপার্জনের জন্য পরিবার ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। খোলা আকাশের নিচে গাড়ির ধোঁয়া ও ধুলোবালি উপেক্ষা করে গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রপাতি খোলাসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করছে। কেউবা মাথায় ইট বা ভারি বস্তু এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। কেউ লোহা কাটার কাজে ব্যস্ত। যা শিশুশ্রম হিসেবে বিবেচিত। তারা অসহায় ও দুর্বল বিধায় সব নির্যাতন মুখবুঝে সহ্য করে এবং তাদের শ্রমের সঠিক মূল্য না দিয়ে ঠকানো যায়। এতিম, অসহায়, গৃহহীন, দুঃস্থ, দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তাদের এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় তাদের নিয়োগের অন্যতম কারণ হচ্ছে তাদের দিনরাত খাটানো যায়। এতে শিক্ষা বঞ্চিত হওয়া ছাড়াও পঙ্গুত্ববরণসহ অকালে মৃতু্যর মুখেও পতিত হয় অনেকে তাদের মধ্যে। আইন থাকলেও তার সঠিক প্রয়োগ এবং গণসচেতনতার অভাবে শিশুদের এসব কাজে ব্যবহার রোধ করা যাচ্ছে না। এসব ঝুঁকিপূর্ণ পেশার মধ্যে রয়েছে- পরিবহণ (বাস, ট্রাক ইত্যাদিতে), মোটর ওয়ার্কসপ ও গ্রিল ওয়াকসপ, লেদ মেশিন ইত্যাদিতে, শিপইয়ার্ডে, ইঞ্জিন বোট ও মাছ ধরার ট্রলারে, নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে, ক্যামিকেল কারখানায়. ধূমপান ও মাদক ব্যবসায় নিয়োগ ও ইটভাটায় ইত্যাদিতে।

আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ, আমাদের সংবিধান, শিশু আইন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আইনে শিশুদের প্রতি সব ধরনের নিষ্ঠুুরতা, জোর জবরদস্তি, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থনৈতিক শোষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার এবং যে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, যেখানে দুঘর্টনার সম্ভাবনা রয়েছে এবং যার ফলে তার শিক্ষার ব্যাঘাত ঘটতে পারে, এমন ধরনের কাজ থেকে শিশুর নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার আছে।

যেসব কাজ শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং যে কাজ তার শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, নৈতিক বা সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, সে সব কাজ থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকারও শিশুর রয়েছে।

আমাদের শ্রম আইনেও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশু নিয়োগ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুসারে কর্মরত শিশু বলতে বোঝায়, ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সি বা কিশোর যারা সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টা পর্যন্ত হালকা পরিশ্রম বা ঝুঁকিহীন কাজ করে। তবে কোনো শিশু (চৌদ্দ বছর পূর্ণ হয়নি এমন কোনো ব্যক্তি) যদি কোনো ধরনের ঝুঁকিহীন কাজও করে, তবে সেটা শিশুশ্রম হবে। তারাও কর্মরত শিশুদের মধ্যে পড়ে যায়। আর ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সি কেউ যদি সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টার বেশি কাজ করে, সেটা ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম হিসেবে স্বীকৃত।

বাংলাদেশে বয়স অনুযায়ী ৭ বছরের নিচে শিশুর কোনো আইনগত দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতা নেই, ৬-১০ বছরের নিচে শিশুর বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, ১২ বছরের নিচে শিশু শ্রম নিষিদ্ধ। ১৪ বছরের নিচে কারখানায় কাজ নিষিদ্ধ। ১৫ বছরের নিচে পরিবহণ খাতে কাজ নিষিদ্ধ। ১৬ বছরের নিচে অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে শিশুকে কারাগারে রাখা বে-আইনি। সহিংসতা, অপব্যবহার ও শোষণের মতো প্রধান প্রধান যেসব হুমকি আছে সেগুলো সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে কিশোর বয়সেই। এই বয়সে প্রধানত কিশোররা অনিচ্ছা সত্ত্বেও দ্বন্দ্ব সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে অথবা শিশুশ্রমিক হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় কাজ করতে বাধ্য হয়। এসব কারণে তাদের শিক্ষাজীবন শেষ করা বা দারিদ্র থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ কমে যায়। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার মতো অধিকার থেকে বঞ্চিত পথশিশুতে জড়িয়ে পড়ে নানা ধরনের অপকর্মে। একশ্রেণির মাদক ব্যবসায়ী আছে- যারা পথশিশুদের দিয়েই মাদক সরবরাহ, ব্যবসা কিংবা পাচার করে। অনেক সময় পথশিশুরা নিজেরাও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে।

বিদেশে পাচারেরও শিকার হচ্ছে অনেক শিশু। দারিদ্র্যের কারণে নিজের ভালো-মন্দ না বুঝেই নানামুখী ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে। এছাড়া পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষার অভাবও রয়েছে। শিশুদের দিয়ে কোনো রকমের অসামাজিক কার্য সম্পাদনের বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে। প্রথমে পথশিশুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট পলিসি তৈরি করা উচিত। পথশিশুদের বিদ্যালয়মুখী করা ও তাদের পুনর্বাসন বিষয়ে সরকারের নীতি-নির্ধারকদের ভাবতে হবে। পথশিশুদের যেন কোনোভাবে মাদক ব্যবসায়ীরা টার্গেট করতে না পারে এজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ শিশুবান্ধব সংস্থার উন্নয়নকর্মীদের এগিয়ে আসতে হবে।

আমাদের দেশের অনেক ছিন্নমূল শিশু রয়েছে যারা দুই বেলা পেট ভরে ভাত খেতে পারে না। অনেক মানুষ রয়েছে, যাদের দিন কাটে অনেক কষ্টে। ঠিকমতো খাবার জোগাতে পারে না। তারা কীভাবে শিক্ষা গ্রহণ করবে? এজন্য এসব শিশুকে শিক্ষাদানের জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। এসব শিশুর অভিভাবকদের দারিদ্র্য দূরীকরণে আয় বৃদ্ধিমূলক প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।

তাদের লেখাপড়া, খাদ্য, স্বাস্থ্য ও মেধা বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। উন্নত দেশে দেখা যায়, শিশুর সব দায়িত্ব রাষ্ট্র বহন করে। আমাদের দেশেও অবহেলিত শিশুদের সব দায়িত্ব রাষ্ট্র নিতে পারে। পরিশেষে বলব, অবহেলিত শিশুদের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনসহ সর্বস্তরের নাগরিকদের এগিয়ে আসা দরকার।

লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে