বিজেএস (প্রিলি) এবং এলএলবি (ফাইনাল) পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। ফেসবুক খুলতেই দেখি, অনেকেই একে অপরকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছেন। বন্ধু তালিকায় বিচারক ও আইনজীবীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় মোবাইল স্ক্রোলিং করতে বারবার একই রকম খবর নিউজ ফিডে আসছে। আমার মনে পড়ে গেল তিন বছর আগের কথা।
কুড়িগ্রামে যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে কাজ করার সময় একটি মাদকের মামলা পেয়েছিলাম। আসামিদের বিরুদ্ধে বিক্রয়ের উদ্দেশে ০২ বোতল ভারতীয় ফেনসিডিল রাখার অভিযোগ ছিল। বিচারে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়।
আসামিরা শেষ দিন পর্যন্ত দাবি করেছিলেন, তারা নির্দোষ। আমি রায়ের পূর্বে তাদের অপরাধ সংক্রান্ত পূর্ব ইতিহাস, পেশা, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও আর্থসামাজিক অবস্থার তথ্যাদি নিলাম। দেখলাম, দুজনেই উচ্চ শিক্ষিত এবং তাদের বিরুদ্ধে পূর্বের কোনো মামলা নেই। তাদের মধ্যে কামাল (ছদ্মনাম) এলএলবি পড়ছিলেন। যেদিন তিনি ওই মামলায় হাজতে গেছেন, সেদিনই শপথ নিয়েছেন তিনি আইনজীবী হবেন, নিরপরাধ মানুষের পাশে দাঁড়াবেন।
আসামিদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ হলেও তাদের জেলে না পাঠিয়ে শর্তসাপেক্ষে এক বছরের জন্য বাড়িতেই সংশোধনের সুযোগ দিয়েছিলাম। এই এক বছরে তারা আদালতের দেওয়া শর্ত মোতাবেক নতুন কোনো অপরাধ করেননি। বিভিন্ন প্রকারের বই পড়েছেন, গাছ লাগিয়েছেন এবং ডোপ টেস্ট করেছেন। এভাবে সফলভাবে প্রবেশনকাল সমাপ্ত হওয়ায় মামলা থেকে চূড়ান্তভাবে অব্যাহতি পেয়েছেন।
খবর পেলাম কামাল এলএলবি (ফাইনাল) পরীক্ষায় পাস করেছেন। হাজারো পাসের ভিড়ে এই পাশের খবরটা আমার কাছে অন্যরকম আনন্দের, অন্যরকম ভালো লাগার। সত্যিই মানুষ তাই পায়, যা সে চেষ্টা করে। প্রতিটি মানুষের মাঝে অমিত সম্ভাবনা আছে। শুধু চাই একটু সুযোগ আর যত্ন।
২.
একজন প্রবেশন অফিসার একটি বিয়ের অনুষ্ঠানের কয়েকটি ছবি দিয়েছেন। ছবিগুলো সদ্য যাবজ্জীবন কারাদন্ড ভোগ করা সামাদের (ছদ্মনাম) মেয়ের বিয়ের ছবি।
তার বিরুদ্ধে স্ত্রী হত্যার অভিযোগ। তবে সাজা ভোগ শেষে কী অভিযোগ ছিল তা এখন বিবেচ্য নয়। বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, এভাবে কারামুক্তির পর মানুষটা কী করবে? সমাজ তো তাকে স্বাভাবিকভাবে নেয় না। কোনো কাজে নেয় না, আত্মীয়স্বজনরা কোনো অনুষ্ঠানেও ডাকে না। তাহলে কী একজন অপরাধী আজীবন অভিশপ্ত হয়ে থাকবে?
নাহ! একজন অপরাধী যত বড় অপরাধীই হোক না কেন তার শাস্তিভোগ শেষে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার অধিকার আছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ন্যায় আমাদের দেশেও প্রবেশন ও আফটার কেয়ার সার্ভিস এসব অপরাধীদের সমাজের উপযোগী করে তোলার জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে তা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করে।
সামাদ যখন কারাগারে সাজা ভোগ করছিলেন সেখানে তিনি নিজেকে ঢেলে ঢেলে সাজিয়েছেন। কারাগারে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। সেখানে দীর্ঘ সময় ইমামতি করেছেন। কিন্তু কারাগার থেকে বের হয়ে কী করবেন সে বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা ছিল না। কোনো ভবিষ্যৎ ছিল না, ছিল না কোনো সহায়। এমন সময় প্রবেশন অফিসার আইনের মধ্যে থেকেই বন্ধুর মতো তার পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাকে ব্যবসার জন্য সরকারিভাবে সহযোগিতা করেছেন, ব্যবসা পরিবর্তনে মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছেন এবং মেয়ের বিয়ের জন্য সদুপদেশ দিয়েছেন।
প্রবেশন অফিসার জানালেন, সামাদের ব্যবসা জমে গেছে। এলাকায় সারের দোকান না থাকায় ক্রেতারা তার কাছে যাচ্ছে। মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পর তিনি ভীষণ খুশি। এখন মেয়ে, জামাই আর ব্যবসা নিয়েই তার জীবন।
সামাদ স্ত্রী হত্যা করে গর্হিত অপরাধ করেছিলেন। এই গুরুতর অপরাধের শাস্তি স্বরূপ ২২ বছর কারাগারে কাটিয়েছেন। তবে শাস্তির উদ্দেশ্য শুধু প্রতিশোধ নয়, বরং অপরাধীকে সংশোধন করার পথ করে দিয়ে সমাজে ও রাষ্ট্রে একজন সুনাগরিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ দেওয়া। আমরা শুধু বিচার নিয়ে ভাবি। সময় এসেছে বিচার পরবর্তী সমাজকে নিয়ে ভাববারও।
সাইফুল ইসলাম পলাশ,
অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, রাজশাহী