শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নারীর সংগ্রামের শেষ নেই

কখনো নিজেকে রক্ষা করতে, আবার কখনো বা পরিবারকে আগলে রাখতে সমাজের ভ্রান্ত নিয়মনীতির বিরুদ্ধেও যেতে হয় নারীকে। সম্প্রতি তিন নারীর সঙ্গে কথা হয়। যারা জীবন সায়াহ্নে এসে এক অনিশ্চয়তায় নিজের পরিবারকে আগলে রাখতে কিংবা নিজেই নিজের খরচ জোগাতে নেমেছেন ভিক্ষায়। তারা শুনিয়েছেন ভিক্ষাবৃত্তিতে যুক্ত হওয়ার গল্প
সুমনা রহমান
  ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

সংগ্রাম আর নারী যেন একই সুঁতোয় গাঁথা। পরিবার, কর্মক্ষেত্র কিংবা সমাজ, সবখানেই সংগ্রাম করে চলতে হচ্ছে নারীদের। কখনো নিজেকে রক্ষা করতে, আবার কখনো বা পরিবারকে আগলে রাখতে। সমাজের ভ্রান্ত নিয়মনীতির বিরুদ্ধেও যেতে হয় নারীকে। সম্প্রতি তিন নারীর সঙ্গে কথা হয়। যারা জীবন সায়াহ্নে এসে এক অনিশ্চয়তায় নিজের পরিবারকে আগলে রাখতে কিংবা নিজেই নিজের খরচ জোগাতে নেমেছেন ভিক্ষায়। তারা শুনিয়েছেন ভিক্ষাবৃত্তিতে যুক্ত হওয়ার গল্প। প্রতি বৃহস্পতিবার বায়তুল মোকাররম এলাকায় ভিক্ষা করতে আসেন রহিমা বেগম (৬৫)। শবেবরাতের কারণে আজ এসেছেন। ৩৬ বছর বয়সি প্রতিবন্ধী মেয়েকে ভালো রাখতেই তার ভিক্ষা করা। তিনি বলেন, 'আমি একটি বোতলের কোম্পানিতে কাজ করি। কিন্তু তা দিয়ে সংসার চলে না। তাই ভিক্ষা করতে হয়। স্বামী মারা গেছে পনেরো বছর আগে। আমার দুই ছেলে দুই মেয়ে ছিল। তার মধ্যে এক ছেলে কলেরায়, আরেক ছেলে পানিতে ডুইবা মারা গেছে। মেয়ে দুইটার মধ্যে ছোটটার বিয়া হইছে। আর বড়টা প্রতিবন্ধী, বয়স ৩৬। নিজে কিছুই করতে পারে না, কথাও বলতে পারে না। পাবনায় গ্রামের বাড়িতে থাকে। আমি এখান থেকে টাকা-পয়সা পাঠাই ওরে দেইখা শুইনা রাখতে। 'স্বল্প আয়ে প্রয়োজন মেটে না জানিয়ে তিনি বলেন, 'যে বোতল কোম্পানিতে কাজ করি ওইখানে সাড়ে সাতশো বোতলে লেবেল লাগালে ২৫০ টাকা পাই। মাসে নয় হাজার টাকার মতো আহে। এই টাকা দিয়ে সংসার ঠিকমতো চলে না, তাই মানুষের সাহায্য নেই। 'তিনি আরও বলেন, 'সপ্তাহে যে দুই দিন ভিক্ষা করি ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকা আয় হয়। এই টাকায় আমার অনেক উপকার হয়। আমি যে ভিক্ষা করি পরিবারের কেউ জানে না। আমার ছোট মেয়ের জামাই যদি জানতে পারে তাহলে আমার মেয়েকে তালাক দেবে। এমনিতেই ওরে অনেক মারধর করে।'

দুঃখ প্রকাশ করে রহিমা বেগম বলেন, 'আমার বয়স প্রায় ৬৫ বছর। চুল পেকে গিয়েছে, দাঁত পড়ে গিয়েছে। কিন্তু ভোটার আইডিতে আমার বয়স দেয়া হয়েছে ৪৫। তাই বয়স্ক ভাতার জন্য আবেদন করতে গেলে বলে আমার বয়স হয় নাই। এমনকি আমার মেয়ে যে প্রতিবন্ধী তারও কোনো ভাতার ব্যবস্থা হয় নাই। ওর জন্য ভাতা নিতে গেলে গ্রামের মেম্বার বলে ৫০০০ টাকা দিতে হবে, তাহলে ব্যবস্থা করে দেবে। আমি টাকা কই পাব? তাই টাকাও দেই না ভাতাও নেই না। নিজে যা পারি সেভাবেই চলি। আমি চাই আমার মেয়ে আমার আগে মারা যাক। কারণ আমি মারা গেলে ওরে দেখার আর কেউ থাকবে না। এখন টাকা দেই বলে ভাতিজা বউ দেখে, না দিতে পারলে আর দেখবে না। শরীরে মাংস থাকলে কুকুরেও চাটতে আসে, আর না থাকলে কুকুর আসে না। এটাই হচ্ছে সত্য কথা।'

স্বামী সন্তান হারিয়ে এখন ভিক্ষাকেই সম্বল হিসেবে নিয়েছেন ৮০ বছর বয়স্ক জাহেরা বেগম। তার ভাষ্য, 'আমার স্বামী মারা গেছে সংগ্রামের পরে। একটা ছেলে ছিল কী একটা অসুখে যেন মারা গেল বলতে পারি না। ছেলে মারা যাওয়ার পর থেকে ভিক্ষা করি। আমাকে দেখার আর কেউ নাই। আমার ছেলের দুই ছেলে দুই মেয়ে। বউটাও আমার লগে থাকে, গুলিস্তানে স্টেডিয়াম মার্কেটের ভেতরে। ছেলের বউ কিছু করে না। আমি এখান থেকে ভিক্ষা করে যে টাকা পাই সেই টাকা দিয়ে পরিবার চালাই।'

ভিক্ষার আয়ের বড় অংশ নাতিনাতনির পড়াশোনায় ব্যয় করেন জানিয়ে তিনি বলেন, 'আমার দুইটা নাতি মাদ্রাসায় পড়ে। আর বড় নাতিনটা প্রাইমারি স্কুলে পড়ে। ছোটটা এখনো স্কুলে পড়ে না। আমার মনে হয় ওদের পড়ালেখা করা দরকার। না ইলে ভবিষ্যতে কী করবে। তাই ওরা যাতে পড়ালেখা করে সেটা বলছি বউরে।'

\হআরেক নারী আবেগাপস্নুত হয়ে (জাহেরা) বলেন, 'আমার আগে আমার ছেলে মারা গেছে। এটা চিন্তা করলেই বুকটা ফেটে যায়। সবাই বলে বড়দের আগে নাকি ছোটরা মারা যায় না। আমার বেলায় তো তাই হলো না।'

সদ্য ভিক্ষাবৃত্তিতে এসেছেন রেহানা বেগম (৩৫)। তিনি বলেন, 'একমাস ধরে ভিক্ষা করতাছি। এর আগে আমি একটি রড ফ্যাক্টরিতে কাজ করতাম। আমার স্বামী রিকশা চালায়। আমি মাঝখানে একটি অ্যাক্সিডেন্ট কইরা মাথায় আঘাত পাই। এরপর থেকে আর কাজ করতে পারি না। আমার একটা মেয়ে ছিল। মারা গেছে মাসখানেক হয়। তার একটি ছেলে আছে। মেয়ের জামাই বাসে হকারের কাজ করে। ঠিকমতো ছেলেটার দেখাশোনা করে না। তাই নাতিকে নিজের কাছে রাখছি। ওরে নিয়া প্রতিদিন সকালবেলা বের হই, দুপুর-বিকাল পর্যন্ত ভিক্ষা কইরা চইলা যাই।'

ঋণগ্রস্ত হয়ে ভিক্ষা করতে আসছেন জানিয়ে রেহানা বেগম বলেন, 'ভিক্ষা আমার পেশা না। কিছু টাকা ঋণ আছে, এগুলো শোধ করতে হইবো। নাতিটা আরেকটু বড় হলে আর আমি সুস্থ হইলে কাজে যোগ দিমু। আমি যে ভিক্ষা করি আমার বাসার কেউ জানে না। লুকিয়ে লুকিয়ে করি। এটা জানলে লোকে নানা রকম কথা বলবে। আমি প্রতিদিন দুই-তিনশ টাকা করে পাই। কারো কাছে চাইতে পারি না, লজ্জা লাগে। আমি যে টাকাটা পাই এটা হাত খরচ হিসেবে রাখি। ওষুধ খেতে হয়, ওই খরচগুলো আমি নিজেরটা নিজেই বহন করি।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে