রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

নারী জাগরণের অগ্রদূত নূরজাহান বেগম

লিনা বেগম
  ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

বাংলাদেশের নারী জাগরণের ও সাহসী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ বেগম পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগম। সওগাত সম্পাদক বাবা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের হাত ধরে সম্পাদনার জগতে প্রবেশ করেন তিনি। যখন লেখালেখি তো দূরের কথা বাঙালি নারীরা ঘরের বাইরে আসার সাহস পেত না। গভীর মনোনিবেশ আর নিষ্ঠার সঙ্গে বেগম পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন তিনি, মৃতু্যর আগ পর্যন্ত। বেগম তার আত্মার আত্মীয় সন্তানতুল্য। ধীরে ধীরে বেগম এবং তিনি সমার্থক হয়ে উঠেছিলেন। এই পত্রিকার মাধ্যমে তিনি কেবল নারীসমাজকে জাগ্রত করেননি, এই পত্রিকা ছিল সমাজপ্রগতির উলেস্নখযোগ্য অংশ। ধর্মান্ধতা, কূপমন্ডূকতা ও সংকীর্ণতার বেড়াজাল থেকে তিনি নারীসমাজকে মুক্ত করেছিলেন। তিনি অসংখ্য নারী লেখক ও সাংবাদিক সৃষ্টি করেছেন। সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন তিনি। সঙ্গত কারণে এ দেশে নারীজাগরণ ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ও অবদান অপরিসীম।

নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও পত্রিকাটি বিশেষ অবদান রেখেছে। ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীলগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু ও আক্রমণ উপেক্ষা করে বেগম পত্রিকা বরাবরই তার নীতিতে অটল ছিল। যে সময়ে নারীদের লেখা ছাপা ছিল প্রায় নিষিদ্ধ ওই সময়ে তিনি বাবার অনুপ্রেরণায় সম্পাদনার কাজ শুরু করেন এবং নারী লেখকদের লেখা ছবিসহ প্রকাশ করে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠিত নারী লেখকের লেখালেখি বেগম থেকে। গভীর একাগ্রতার সঙ্গে তিনি বেগম সম্পাদনা করেছেন। লেখা সংগ্রহ করেছেন নিজেই। তার স্নেহ-ভালোবাসা ও আন্তরিকতায় সিক্ত হয়েছেন প্রত্যন্ত গ্রামের অন্তঃপুরবাসিনীরাও। তিনি তাদের দিয়েছেন মায়ের স্নেহ ও বোনের সহমর্মিতা। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, মমতাময়ী ও দায়িত্ব সচেতন। তিনি বেগম রোকেয়ার মতো সব সময়েই চেয়েছেন নারীসমাজের উন্নয়ন ও অগ্রগতি। তিনি পশ্চাৎপদ নারীসমাজকে সামনের কাতারে নিয়ে এসেছেন অনেক ত্যাগ আর সংগ্রামের মাধ্যমে। সেই লক্ষ্যে তিনি মৃতু্যর আগ পর্যন্ত কাজ করেছেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি বলেছেন, 'মেয়েদের আর পেছনের দিকে তাকানোর সুযোগ নেই। পথ এখন অনেক প্রশস্ত। আপনারা নির্ভয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলুন। পুরুষের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এগিয়ে চলুন।' তার এই বাণী বাঙালি নারীদের ভবিষ্যৎ পথচলার ক্ষেত্রে প্রেরণা জোগাবে।

চলিস্নশের দশকে তিনি যখন মহিলাদের জন্য 'বেগম' পত্রিকা প্রকাশ করেন, তখন বেগম সুফিয়া কামাল, বেগম রোকেয়া ও হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব শক্তিশালী প্রগতিশীল মহিলার লেখায় বেগম পত্রিকা এখন অসাধারণ বৈশিষ্ট্য অর্জন করে।

বাংলাদেশের সাহিত্য সাধনার পথিকৃৎ সাহিত্যজগতের কিংবদন্তি পুরুষ সওগাত সম্পাদক নাসিরউদ্দীন। সওগাত সাহিত্য পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করে তিনি অবিভক্ত বাংলায় বাংলাসাহিত্য সাধনার পথ ও প্রগতিশীল সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্র সব স্তরের লেখকের জন্য মুক্ত করেন। সওগাত ছিল ত্রিশ ও চলিস্নশের দশকের সাহিত্য ও সাহিত্যিকের সাধনার প্রধান মুখপত্র। মোসলেম ভারত ও অন্যান্য পত্রিকা থাকলেও সওগাত শুধু পত্রিকা নয়- তরুণ, নবীন ও প্রবীণ সব সাহিত্য সাধকের চিন্তাচেতনার সুস্থ ও স্বাধীন চিত্তের বাহকস্বরূপ। গড়ে ওঠে সওগাত সাহিত্য বলয়। এই বলয়েরই একটি অন্যতম পত্রিকা বেগম। অনেক কষ্টে নানা ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে নাসিরউদ্দীন সওগাত পত্রিকাটি প্রতিষ্ঠিত করেন। সে সময় সওগাত অফিসের দোতলায় একটি রুমের মেঝেতে ফরাস বা চাদর বিছানো থাকত। সেই ফরাসের ওপর বসে প্রতিদিন বিকালে আসর বসাতেন কাজী নজরুল ইসলাম, আবুল মনসুর আহমদ, আবু লোহানী, আবুল ফজল, ইবরাহীম খাঁর মতো অনেক বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবী ও বিদগ্ধজন। তারা সাহিত্য ও অন্যান্য বিষয়ে যেমন আলাপ-আলোচনা করতেন তেমনি হাসি-গল্পে আসরটি মাতিয়ে রাখতেন। ওই আসরে চা পরিবেশন করার দায়িত্ব ছিল ছোট নূরজাহান বেগমের। তার খুব প্রিয় ছিল এ আসরটি। ছোট থাকায় সাহিত্য আলোচনা বুঝতে না পারলেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতেন। এই দাঁড়িয়ে থাকা ও শোনার অনুভূতিটাই আস্তে আস্তে তাকে বই, পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও সাংস্কৃতিক জগতের প্রতি প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। এ ছাড়া প্রতিদিন সন্ধ্যায় নাসিরউদ্দীন প্রচুর দেশি-বিদেশি বই আনতেন। বইগুলোর রঙিন ছবিগুলো ছিল নূরজাহান বেগমের দারুণ পছন্দ। শিক্ষাজীবন শেষ করে মাত্র ২২ বছর বয়সে বেগম সম্পাদনায় যুক্ত হয়েছিলেন নূরজাহান বেগম, তারপর জীবনের ইতি টানার আগ পর্যন্ত এর বন্ধন ছাড়েননি তিনি। তিনি নাসিরউদ্দীনের একমাত্র সন্তান। নূরজাহান বেগম ব্যক্তিগত জীবনে দুই মেয়ের মা ছিলেন। তিনি বিশিষ্ট সাহিত্যিক, শিশু সংগঠক ও সাংবাদিক রোকনুজ্জামান খানের (দাদাভাই) পত্নী।

সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকার আর একটি উলেস্নখযোগ্য বিষয় হচ্ছে বেগম ক্লাব গঠন। সেই যুগে মেয়েদের কোথাও বসে দু-কথা বলা বা মুক্তমনে কোনো বিষয় আলোচনা করার জায়গা ছিল না। তাদের কথা মনে রেখেই ১৯৫৪ সালে গঠিত হয় বেগম ক্লাব। এ দেশের নারী জাগরণ ও লেখিকা তৈরির ক্ষেত্রে বেগম ক্লাবের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।

নূরজাহান বেগমের জন্ম : ১৩৩১ (১৯২৫) সালে চাঁদপুর শহরের অন্তর্গত চালিতা গ্রামে। তার বাবা মুহাম্মদ নাসিরউদ্দীন পত্রিকা সম্পাদনা ও পরিচালনার জন্য কলকাতায় থাকতেন। মায়ের সঙ্গে দেশের বাড়িতে থাকার সময় ছোট নূরজাহান বেগম পানিতে ডুবে দু'বার মুমূর্ষু অবস্থা থেকে বেঁচে যান। এ দুর্ঘটনার পর নাসিরউদ্দীন স্ত্রী ও মেয়েকে নিজের কাছে। কলকাতায় আসার পর নূরজাহান বেগমকে আধুনিকা করার জন্য প্রথমেই তার নাকফুল এবং মায়ের সযত্নে বড় করা চুল ছেঁটে বব কাট করা হয়। এ জন্য তার ও তার মায়ের মনে খুব দুঃখ হয়েছিল। অবশ্য পরে দুঃখ তারা ভুলে যান।

নূরজাহান বেগমের শিক্ষাজীবনের শুরু সাখাওয়াত মেমোরিয়াল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। ওই স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাস করে লেডি ব্রেবোন কলেজে পড়াশোনা করেন। সম্পাদক হওয়ার পেছনে তার পারিবারিক পরিবেশ, নিজের ধৈর্য, একাগ্রতা ও নিষ্ঠা কাজ করেছে। নূরজাহান বেগম তার বাবার প্রেরণায় ও আদর্শে নিজেকে গড়ে তুলেছেন। একটি কাজে হাত দিয়ে সে কাজটিকে সাফল্যমন্ডিত করে তোলার জন্য যে একাগ্রতা, আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়ের প্রয়োজন এটা তার বাবাই তাকে শিখিয়েছেন নিজের জীবনযাত্রার ভেতর দিয়ে।

নারীশিক্ষা ও সাহিত্য ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ১৯৯৭ সালে রোকেয়া পদকে ভূষিত হন নূরজাহান বেগম। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ মহিলা সমিতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, লেখিকা সংঘ, কাজী জেবুন্নেসা-মাহবুবউলস্নাহ ট্রাস্ট, রোটারী ক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের সম্মাননাও পান তিনি। যখন নারীদের অংশগ্রহণ লেখালেখিতে অনেক পিছিয়ে ছিল, তখন বাংলাদেশের নারী সাহিত্যিকদের অনেকের লেখার হাতেখড়ি হয় বেগম পত্রিকার মাধ্যমে। সঙ্গত কারণেই এর ঐতিহাসিক মূল্য অনেক বেশি। নারীদের লেখালেখিতে উৎসাহিত করতে নূরজাহান বেগম ছিলেন এক নিবেদিত প্রাণ। যিনি নারীর শিক্ষা ও অগ্রযাত্রায় অবদান রেখেছেন আমৃতু্য। এ দেশের নারী আন্দোলন, মুক্ত সাংবাদিকতা ও প্রগতিশীল সমাজ বিনির্মাণের ক্ষেত্রে তিনি যে অবদান রেখেছেন, জাতি তা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ রাখবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে