রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

নানামুখী নির্যাতন সয়ে টিকে আছে নারী

একুশ শতকে এসে যেখানে নারীর স্বাধীনতা ও আত্মপ্রতিষ্ঠার মহাজাগরণ ঘটবে, সেখানে অর্থকে কেন্দ্র করে নারী ভাগ্যবিড়ম্বিত হচ্ছে- তাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হচ্ছে। যৌতুকের কারণে নারী নির্যাতনের ঘটনা বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে প্রায়ই ঘটে। এখন এ ঘটনা সংক্রামক ব্যাধির মতো বিস্তার লাভ করেছে সারাদেশে। এর বিপজ্জনক বিস্তৃতি ঘটেছে বিভিন্ন শহর থেকে শুরু করে খোদ রাজধানী ঢাকায়। যৌতুকের কারণে এবং পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আরও দুই গৃহবধূ গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে তাদের মৃতু্য ঘটেছে। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই দেশের কোথাও না কোথাও নারীর অবমাননা, নির্যাতনের খবর পাওয়া যায়
সুমি রহমান
  ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

সামাজিক জীবন ব্যক্তির কাছে এক আশীর্বাদ। এর পূর্ণতা লাভ করে সামাজিক বন্ধনের মাধ্যমে সমাজে সুশৃঙ্খল পরিস্থিতি বজায় থাকলে। কিন্তু সামাজিক অনাচার ও অবক্ষয় যদি বেড়ে যায় ব্যক্তি বিশেষের কারণে তা হলে ওই সমাজে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়ে। ব্যক্তির আধিপত্য, অর্থ, সম্পদ ও রাজনৈতিক কারণে সামাজিক বিশৃঙ্খলা বা অবক্ষয় দেখা দেয়। এ অবক্ষয়ের জোয়ার বাংলাদেশে একেক সময় একেকভাবে আসে। এ দেশেই পরকীয়ার কারণে সন্তানসহ মায়ের আত্মহননের ঘটনা ঘটেছে। আবার পরকীয়ায় যোগসাজশে নিজের সন্তান হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই সন্তানসহ নিজ শরীরে কেরোসিন বা পেট্রোল ঢেলে মায়ের আত্মহত্যার ঘটনা দেশের বেশ কয়েক জায়গায় সংঘটিত হয়েছে। এর পাশাপাশি রয়েছে চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা। প্রতিটি ঘটনার পেছনের কারণ যাই থাকুক না কেন, প্রবণতাটা হচ্ছে বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতো। যেন একজনের দেখাদেখি অন্যজন আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে অথবা তাকে আত্মহত্যার পথে চলে যেতে বাধ্য করানো হচ্ছে।

একুশ শতকে এসে যেখানে নারীর স্বাধীনতা ও আত্মপ্রতিষ্ঠার মহাজাগরণ ঘটবে, সেখানে অর্থকে কেন্দ্র করে নারী ভাগ্যবিড়ম্বিত হচ্ছে- তাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হচ্ছে। যৌতুকের কারণে নারী নির্যাতনের ঘটনা বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে প্রায়ই ঘটে। এখন এ ঘটনা সংক্রামক ব্যাধির মতো বিস্তার লাভ করেছে সারাদেশে। এর বিপজ্জনক বিস্তৃতি ঘটেছে বিভিন্ন শহর থেকে শুরু করে খোদ রাজধানী ঢাকায়। যৌতুকের কারণে এবং পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আরও দুই গৃহবধূ গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে তাদের মৃতু্য ঘটেছে। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই দেশের কোথাও না কেথাও নারীর অবমাননা, নির্যাতনের খবর পাওয়া যায়। ইদানীং নারীদের মধ্যে একটা ভয়ানক প্রবণতা কাজ করছে, তা হলো, গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে মুক্তি। নিজের জীবন অকালে বিসর্জন দিয়ে পৃথিবী থেকে মুক্তির কোনো মানে হয় না এ সহজ কথাটা আত্মহত্যাপ্রবণ নারীকে কে বোঝাবে।

নারী যে কেবল যৌতুকের কারণে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে তা নয়, ইভ টিজিংয়ের অসহায় শিকার হয়ে গত এক দশকে বহু নারীকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছে। বর্তমান সমাজে নারীরা নানামুখী নির্যাতনের শিকার। নারীদের উচিত এ নির্যাতনের প্রতিবাদ করা কিংবা এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। নির্যাতনের নিষ্ঠুর শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়া নয়। ইভ টিজিংয়ের যারা প্রতিবাদ করছে তারাও অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তারা কি কখনো তার ন্যায় বিচার এ সমাজে পেয়েছে?

আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা যারা বখাটে সন্ত্রাসীদের পিতা, তারা সন্তানকে সুপথ ও ন্যায়ের পথ দেখাতে ব্যর্থ হয়েছি। আর আমাদের ব্যর্থতা অবলীলায় চাপিয়ে দিচ্ছি রাষ্ট্র ও সমাজের ওপর। হয়তো রাষ্ট্র বা সরকার ব্যর্থ কিন্তু নিজেদের ব্যর্থতার কথা আগে স্বীকার করতে হবে। আমার সন্তান কোথায় যায়, কী করে, কাদের সঙ্গে মেলামেশা করে- এ বিষয়টি দেখার ও তদারকির দায়িত্ব অভিভাবক হিসেবে আমারই, অন্যের নয়। টমাস ফুলার বলেছেন, ভালো লোকের সাহচর্যে থাক, তোমার বুদ্ধি না থাকলেও তারা সময়মতো ভালো পরামর্শ দেবে। একটা কথা আমাদের মনে রাখা দরকার, সৎ ও ভালো মানুষ কখনো বিপজ্জনক হয় না।

ইভ টিজিংয়ের কারণে গত এক দশকে শতাধিক নারী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে, যৌতুকের কারণে স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে গায়ে কেরোসিন ঢেলে অথবা বিষপানে আত্মহত্যা করেছে অনেক নারী। এমনকি প্রতিবাদকারী অনেককেই প্রাণ দিতে হয়েছে।

এসব অমানবিক ও নিষ্ঠুর ঘটনায় এটাই প্রমাণিত হয় যে, বখাটেরা, সন্ত্রাসীরা নারীকে কটাক্ষ করলে তাদের ওপর শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করলে এমনকি ধর্ষণ, গণধর্ষণ করলেও কোনো প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করা যাবে না। দেশটা কি ধীরে ধীরে মগের মুলস্নুক হতে চলেছে। নাকি আমরা ফিরে যাচ্ছি আদিম ও বর্বর সমাজে। একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। যেখানে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন রয়েছে- যেখানে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী- সেখানে নারীরা অরক্ষিত বা নিরাপত্তাহীন থাকে কী করে।

নারী ছলনাময়ী, কিংবা বহুচারিণী। নারী কুলটা, কুলাঙ্গার। এসব অপবাদ দিয়ে তাকে ঘর-সংসার থেকে বের করে দেয়া, নারীকে নানাভাবে কলঙ্কিত ও অমর্যাদা করা কোনো সভ্য সমাজের কাজ নয়। চারদিকে যেভাবে নারী জাগরণ ঘটেছে বাংলাদেশসহ পৃথিবীব্যাপী নারীর ক্ষমতা সুসংহত হচ্ছে, সেখানে আমাদের নারীরা কেন এতটা অসহায়ত্ব ও অবমাননার শিকার হয়ে বৃত্তবন্দি হয়ে জীবনযাপন করবে।

স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল। এর প্রধান কারণ ছিল অভাব-দারিদ্র্য। তারা বউ ছেলেমেয়েদের ঠিকমতো ভরণপোষণ করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে আত্মহত্যা করত। স্ত্রী-সন্তানদের বিপদে ফেলে, তাদের ভবিষ্যতের হাতে ছেড়ে এভাবে আত্মহত্যা করা কাপুরুষতা। তা সত্ত্বেও ওই আত্মহত্যার মধ্যে পারিবারিক ব্যর্থতার চিত্র ফুটে উঠলেও নিষ্ঠুরতা, শোষণ, নির্যাতনের চিত্র ফুটে উঠত না। উপরন্তু, স্ত্রী-সন্তানদের প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং তাদের ভরণপোষণে নিজের অসহায়ত্ব ও অক্ষমতার চিত্রই উজ্জ্বল হয়ে উঠত। আর আজ স্বামীর মধ্যে ফুটে উঠছে নিষ্ঠুরতা ও লোভ। সব ধরনের লোভ, নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা পরিহার করে স্বামীকে দায়িত্ব নিতে হবে তার স্ত্রীকে রক্ষার।

অভিমানী, নির্যাতিতা, বঞ্চিত-শোষিত, অবমূল্যায়নের নিষ্ঠুর শিকার নারীরা এই সমাজ সংসারে আর বেঁচে থাকতে চায় না। তারা একাই যে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যাচ্ছে তাই নয়- সঙ্গে পুড়িয়ে মারছে আদরের সন্তানদেরও। যে সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য মা জীবন দিয়ে দেয়, সেই সন্তানের শরীরে কেরোসিন ঢেলে মা নিজেই পুড়িয়ে মারে। এমন নিষ্ঠুর পাশবিক ও মর্মান্তিক ঘটনা সমাজের বিবেকবান মানুষ কী করে সহজভাবে মেনে নেয়?

সংসার শুধু একজনের ত্যাগ, সংযমশীলতা ও ভালোবাসায় টিকে থাকে না। স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই চূড়ান্ত ধৈর্য ত্যাগ ও সংযমের পরিচয় দিতে হয়। দুই মানুষ, দুই সত্তা, দুই রক্তমাংসের শরীর। পছন্দ-অপছন্দ রুচিবোধও ভিন্ন। ধৈর্য ও সহনশীলতার বাঁধ ভেঙে গেলে ওই বাঁধ মেরামতের দায়িত্ব স্বামী-স্ত্রীর, না হয় পরিবারের অভিভাবকদের। পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখতে গেলে এর কোনো বিকল্প নেই।

আমরা কিন্তু বিশৃঙ্খলা কিংবা বর্বর সমাজে বাস করছি না, যে ব্যাপক সামাজিক অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতার কারণে আমাদের পারিবারিক বন্ধন কাঁচের টুকরার মতো ভেঙে খান খান হয়ে যাবে। তাই কোনো পরিবারে সংকট দেখা দিলে ওই পরিবারের অভিভাবক বা আত্মীয়স্বজনকে দ্রম্নত হস্তক্ষেপ করতে হবে। প্রয়োজনে স্বামী-স্ত্রীকে কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে সম্পর্ক স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। ফ্রান্সের পরিবারগুলো এতটাই ভাঙনপ্রবণ যে, ৮০ ভাগ নারী বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে। তারা স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করছে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। দুই জীবন এক ছাদে থাকা অসহনীয় হয়ে উঠলে পৃথক হয়ে যাওয়াই সমীচীন। কাউকে হত্যা করে কিংবা আত্মহত্যায় উৎসাহিত করে প্রিয় সন্তানদের জীবন সংহার করার মধ্য দিয়ে এর পরিসমাপ্তি ঘটানো কোনো সভ্য সমাজের স্বামী-স্ত্রীর কাজ নয়। আসুন, আমরা ত্যাগ, সংযম ও কর্তব্যবোধে বলীয়ান হয়ে অসভ্য, অমানুষ, বর্বর নয়- স্বামী হিসেবে কিংবা পিতা হিসেবে আদর্শ স্ত্রী হিসেবে সভ্য হয়ে উঠি। সন্তানকে মৃতু্যর পথে ঠেলে দিয়ে নয়, সন্তানের ভবিষ্যৎকে গড়ে তুলি আলোকময় করে- যাদের গর্বিত পিতামাতা আমরাই।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে