বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

রোগী সংকটে বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র

সাখাওয়াত হোসেন
  ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৯:৪৫
প্রতীকী ছবি

রাজধানীর মাতুয়াইলের স্পেশালাইজড মেডিকেল কেয়ার (এসএমসি) হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা গত এক মাসে প্রায় ৪০ শতাংশ কমেছে। ফলে সেখানে কর্মরত চিকিৎসক, নার্স ও ওয়ার্ডবয়সহ নন-মেডিকেল অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা দিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রীতিমতো হিমসিম খাচ্ছে।

একই অবস্থা নারায়ণগঞ্জের লিংক রোডস্থ প্রাইভেট চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ নিউনেটাল হাসপাতালেরও। মাত্র কয়েক মাস আগেও হাসপাতালটিতে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা রোগীর ভিড় লেগে থাকলেও সেখানেও এখন রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।

প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টারসহ বেশিরভাগ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের দাবি, গত বছরের ডিসেম্বরের শুরু থেকে রোগীর সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। বেশকিছু চিকিৎসাকেন্দ্রে রোগীর সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে। সাধারণ সময় বছরের শেষ এক মাস এবং শুরুর এক মাস- এই দুই মাস রোগী কিছুটা কম থাকলেও এবার তা অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। রোগীর অভাবে ন্যূনতম খরচের সংকুলান না হওয়ায় ব্যক্তি মালিকানাধীন বিপুল সংখ্যক হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে।

চিকিৎসা খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছরের শেষের দিকে বার্ষিক পরীক্ষার পর অনেক পরিবার গ্রামে কিংবা দেশের বাইরে বেড়াতে যাওয়ায় সাধারণ সময় রোগী কিছুটা কম হয়। এ ছাড়া এবার বেশ কয়েকদিন ধরে হাড় কাঁপানো শীতের কারণে খুব বেশি জরুরি না হলে কেউ চিকিৎসকের কাছে না যাওয়ায় রোগীর সংখ্যা সামান্য কমতে পারে। কিন্তু মাস-দেড়েকেরও বেশি সময় ধরে ঢাকাসহ সারাদেশেই বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে যে হারে রোগী কমেছে, এর নেপথ্যে ভিন্ন কোনো কারণ রয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বৈশ্বিক এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে ২৪ শতাংশ মানুষ ‘বিপর্যয়মূলক’ ব্যয়ের মধ্যে পড়ছেন। এ ছাড়া চিকিৎসা করাতে গিয়ে প্রতিবছর ৬২ লাখের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছেন এবং ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে ১৬ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা নেওয়া থেকে বিরত থাকেন। অর্থাৎ প্রায় তিন কোটি মানুষ প্রয়োজন হলেও চিকিৎসকের কাছে বা হাসপাতালে যান না।

এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, চিকিৎসা ব্যয় কমিয়ে আনতে প্রথমত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। উন্নয়নের একটি বড় অংশ স্বাস্থ্য। রাস্তাঘাট, কালভার্ট ও ব্রিজের পাশাপাশি জনগণের স্বাস্থ্য যদি না থাকে, তাহলে উন্নয়ন টেকসই হবে না।

তিনি আরও বলেন, দেশের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাবে বাড়াতে হবে। এখন আছে ৪ শতাংশ, এটা অন্তত ১০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। যাতে একজন মানুষ অসুস্থ হলে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা সরকারি হাসপাতাল থেকে নিতে পারেন। এতে মানুষের পকেট থেকে চিকিৎসা ব্যয় কমে আসবে। এরপর হলো ওষুধ। চিকিৎসকরা যত ওষুধ লিখবেন, সেটা যদি হাসপাতাল থেকে দেওয়া যায়। সে ক্ষেত্রেও চিকিৎসা ব্যয় কমে আসবে। অপারেশন বা ক্যানসারের ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়, এসব রোগ ‘বিপর্যয়কর’ স্বাস্থ্য ব্যয়। এগুলোও যদি হাসপাতাল থেকে ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে স্বাস্থ্য ব্যয় কমে আসবে। উন্নয়ন টেকসই হবে এবং বাংলাদেশ উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারবে স্বাস্থ্য সেবায়।

স্বাস্থ্য খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগীর সংখ্যা কমলেও এই চাপ সরকারি হাসপাতালগুলোতে পড়েছে। তবে সেখানে কম টাকার টিকিট কিনে নিম্ন-মধ্যবিত্তরা ডাক্তার দেখালেও যাদের বেশি দামের ওষুধ প্রেসক্রাইব করা হচ্ছে, তারা তা না কিনেই বাড়ি ফিরছে। আর যাদের কম দামের অল্প ওষুধ সরকারিভাবে দেওয়া হচ্ছে, তারা পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা করাতে পারছে। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, প্রাইভেট চেম্বারে চিকিৎসকের উচ্চ ফি নিম্নবিত্তরা ধারকর্জ করে জোগাড় করতে পারলেও নানা ধরনের টেস্ট ও দামি ওষুধ কিনতে না পারার কারণেই বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে রোগীর সংখ্যা কমছে। এ ছাড়া চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়েই ফার্মেসির সেলসম্যানের সঙ্গে কথা বলে কিংবা গুগলে সার্চ করে এন্ট্রিবায়োটিকসহ নানা উচ্চমাত্রার ওষুধ খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে।

স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট বলছে, রোগীরা তাদের স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত ব্যয়ের ৬৪.৬ শতাংশ ওষুধের জন্য, ১১.৭ শতাংশ ল্যাবরেটরির খরচ মেটাতে, ১০.৪ শতাংশ চিকিৎসকের ভিজিটে, ২.৪ শতাংশ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা প্র্যাকটিশনার, ০.৩ শতাংশ ডেন্টিস্টদের খরচে, ১০.১ শতাংশ হাসপাতালে এবং ০.১ শতাংশ চিকিৎসা পণ্য কিনতে ব্যয় করছেন।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, যখন চিকিৎসা ব্যয় সরকার বহন করে তখন সরকার চাইবে না কেউ অতিরিক্ত ওষুধ সেবন ও অতিরিক্ত টেস্ট করুক। তখন প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিক্রি হবে না। দেশে যে কেউ চাইলে যে কোনো ওষুধ কিনতে পারে। তাই রোগীদের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার হার বেশি, আর এর দামও বেশি। এসব কারণে মেডিসিন খরচ বেশি হয়। প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে আউট অব পকেট এক্সপেনডিচার অনেক কমে যাবে।

অধ্যাপক আব্দুল হামিদ বলেন, মেডিসিনের পর টেস্টে খরচ বেশি হয়। সরকার চাইলে সেটিও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সরকারি বা বেসরকারি যেকোনো হাসপাতালে কত টেস্ট হয়, এর কোনো মনিটরিং নেই। এমনকি একজন ডাক্তার বছরে কোন ডিজিজের জন্য কত টেস্ট দিয়েছে, এরও কোনো পরিসংখ্যান নেই। এটি যদি অনলাইনে মনিটর করা যায়, তাহলে বোঝা যাবে, কোনো প্রাইভেট হাসপাতালে বেশি করে ডায়াগনোস্টিক টেস্ট হচ্ছে কিনা। ওই টেস্ট রোগীর জন্য প্রয়োজন কিনা। এসব রেগুলেশন প্রপারলি না করার কারণে আউট অব পকেট এক্সপেনডিচার কমছে না।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ এবং সমীক্ষার অন্যতম গবেষক ডা. আবদুর রাজ্জাক সরকার বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, ধার করে, সম্পদ বিক্রি করেও চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে হচ্ছে রোগীদের। ওষুধের ব্যয় সবচেয়ে বেশি। ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি চিকিৎসকরা যাতে বেশি দামি ওষুধ না লেখে, তা মনিটর করতে হবে, রোগীদেরও চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অপ্রয়োজনীয় ওষুধ কেনা থেকে বিরত থাকতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যাওয়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে যেটা লক্ষণীয়, সেটা হচ্ছে চিকিৎসার একটা বড় অংশ ওষুধের ব্যয়। আর এর পুরোটাই খরচ হচ্ছে ব্যক্তির পকেট থেকে।

তিনি বলেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে সর্বনিম্ন বরাদ্দ হয়। ফলে চিকিৎসা ব্যয় মানুষের পকেটের ওপর পড়ে। রাষ্ট্র যদি মানুষের অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের দায়িত্ব নেয়, তাহলে চিকিৎসা খরচ অনেকাংশে কমে যাবে। এই অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের সংখ্যাও খুব বেশি নয়, মাত্র ২৫০-৩০০টির মতো। এই ওষুধগুলো যদি রাষ্ট্র নিজে প্রস্তুত করে, তাহলে তিনটি সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, মানুষ যৌক্তিক দামে সেসব ওষুধ কিনতে পারবে; দ্বিতীয়ত, ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং তৃতীয়ত, প্রেসক্রিপশনে লেখা ওষুধ সরবরাহের কারণে অনেক দামি ওষুধ লেখার যে প্রবণতা, সেটা কমে যাবে।

সম্প্রতি এক গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে, সরকারি হাসপাতালে ৩ শতাংশ রোগী ওষুধ পায়। বাকি ৯৭ ভাগ রোগীই ওষুধ পায় না। এসব কারণে রোগীরা বেসরকারি হাসপাতালে ছুটে এবং দরিদ্র হয়ে পড়ে। এই সংখ্যা প্রতিবছর প্রায় ৮৬ লাখ।

স্বাস্থ্য খাতের সার্বিক বিষয়াদি নিয়ে জনস্বাস্থ্যবিদ ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, স্বাস্থ্য খাতের সমস্যাগুলো পুরনো ও বহুল আলোচিত। শুধু মুখের কথায় এসব সমস্যা দূর হবে না। প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে নজরদারি বাড়াতে হবে। এ কাজে আধুনিক প্রযুক্তিরও সহায়তা নিতে হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রে দিশারি প্রকল্প হাতে নেওয়া যেতে পারে এবং সফল উদ্যোগের ব্যাপ্তি বাড়াতে হবে। এসব কাজে প্রয়োজনে আইনের সংস্কার করতে হবে।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে