বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২

বিজ্ঞানীদের হত্যা করে কি থামানো যাবে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি?

যাযাদি ডেস্ক
  ২৫ জুন ২০২৫, ০৯:২৮
বিজ্ঞানীদের হত্যা করে কি থামানো যাবে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি?
ছবি: সংগৃহীত

ইরানের পরমাণু কর্মসূচির পেছনে থাকা শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য করে নজিরবিহীন হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে ইসরায়েল। তাদের দাবি অনুযায়ী— গত ১৩ জুনের পর থেকে অন্তত ১৪ জন পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা করা হয়েছে।

তেল আবিবের ধারণা, এসব হত্যাকাণ্ডের ফলে, থেমে যেতে পারে, তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচি। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব হত্যাকাণ্ড হয়তো ইরানের কর্মসূচিকে কিছুটা পিছিয়ে দিতে পারে, কিন্তু সম্পূর্ণভাবে থামাতে পারবে না।

ফ্রান্সে নিযুক্ত ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত জোশুয়া জারকা বার্তা সংস্থা এপি-কে বলেন, বিজ্ঞানীদের হত্যাকাণ্ড ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথকে ‘প্রায় অসম্ভব’ করে তুলবে। এমনকি দুই সপ্তাহের বিমান হামলার পরও যদি ইরানের কিছু অবকাঠামো টিকে থাকে, এই বিজ্ঞানীদের হত্যা তাদের জন্য বড় ধাক্কা।

তার ভাষায়, বিজ্ঞানীদের পুরো দল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার অর্থ হলো— প্রকল্পটি কয়েক বছরের জন্য উল্লেখযোগ্যভাবে পিছিয়ে গেছে।

পরমাণু বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরানে এখনো এমন বিজ্ঞানীরা রয়েছেন, যারা নিহতদের স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন। ইউরোপীয় দেশগুলো মনে করে, শুধু সামরিক উপায়ে ইরানের পরমাণু জ্ঞান ধ্বংস করা সম্ভব নয়। তারা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান চায়, যাতে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ দূর হয়।

ব্রিটেনের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি হাউস অব কমন্সে বলেন, ইরান কয়েক দশকে যে জ্ঞান ও সক্ষমতা অর্জন করেছে, হামলা তা ধ্বংস করতে পারে না। তিনি বলেন, কোনো সরকারই সেই জ্ঞানকে অস্ত্র তৈরির আকাঙ্ক্ষা থেকে বিরত রাখতে পারবে না।

ইসরায়েলের দাবি, নিহত বিজ্ঞানীরা শুধু পদার্থবিদ বা প্রকৌশলী ছিলেন না, তারা পরমাণু বোমা তৈরির প্রকল্পেও সরাসরি যুক্ত ছিলেন। রাষ্ট্রদূত জারকা বলেন, তারা ‘সব জানতেন’ এবং প্রকল্পের শীর্ষে ছিলেন। তাই তাদের নির্মূল করা হয়েছে।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, ১৩ জুনের প্রথম হামলাতেই ৯ জন শীর্ষ বিজ্ঞানী নিহত হন। তারা ছিলেন রসায়ন, ধাতুবিদ্যা, বিস্ফোরক এবং পদার্থবিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ। সোমবার এপি-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব তথ্য জানান জারকা।

পরদিন, মঙ্গলবার ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে জানানো হয়— ইসরায়েলি হামলায় পরমাণু বিজ্ঞানী মোহাম্মদ রেজা সিদিঘি সাবের নিহত হয়েছেন। তিনি ১৩ জুনের হামলায় বেঁচে গিয়েছিলেন। তবে তখন তার ১৭ বছর বয়সী ছেলে মারা যান।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই হত্যাকাণ্ড শুধু প্রকল্পের অগ্রগতি থামাতে নয়, বরং ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীদের ভয় দেখানোর জন্যও করা হচ্ছে। অনেকেই মনে করেন, এই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য হলো— যারা কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারে, তারা যেন আগেভাগেই পিছিয়ে যায়।

পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ বিশেষজ্ঞ মার্ক ফিটজপ্যাট্রিক বলেন, ইরানের প্রকল্পের ব্লুপ্রিন্ট বা নকশা রয়ে যাবে। নতুন পিএইচডি গবেষকরা সেটি বুঝে নিতে পারবে। তার মতে, মানুষকে হত্যা করে বা স্থাপনায় বোমা ফেলেও কর্মসূচি থামানো যাবে না, কেবল দেরি করানো যাবে।

ফিটজপ্যাট্রিক আরও বলেন, ইরানের হাতে বিকল্প বিজ্ঞানী রয়েছে। হয়তো তারা প্রথম সারির নয়, কিন্তু কাজ চালিয়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কর্মসূচি কত দ্রুত পুনরায় চালু হবে, তা নির্ভর করছে— হামলায় ইউরেনিয়ামের মজুত এবং উৎপাদন যন্ত্রপাতির কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তার ওপর।

রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র বিশ্লেষক পাভেল পডভিগ বলেন, মূল বিষয় হলো— উপাদান। ইউরেনিয়াম হাতে থাকলে বাকি কাজ করা তুলনামূলক সহজ। তার মতে, বিজ্ঞানীদের হত্যা করা হয়েছে— মানুষকে ভয় দেখিয়ে কর্মসূচি থেকে দূরে রাখতে। তিনি বলেন, কিন্তু প্রশ্ন হলো, আপনি কোথায় থামবেন? আপনি কি পদার্থবিদ্যা পড়া ছাত্রদেরও হত্যা করবেন? এটি খুবই বিপজ্জনক পথ।

রাষ্ট্রদূত জারকার বক্তব্য, ভবিষ্যতে যারা এই প্রকল্পে কাজ করতে বলা হবে, তারা দুইবার ভাববে। তার মতে, বিজ্ঞানীদের হত্যা কার্যকর পদক্ষেপ। কারণ তাদের হাতে এমন দক্ষতা ছিল, যা দিয়ে তারা ইউরেনিয়ামকে অস্ত্রে রূপান্তর করতে পারতেন।

ইসরায়েল অতীতেও ইরানি বিজ্ঞানীদের হত্যার সঙ্গে যুক্ত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে এবার তারা সরাসরি দায় স্বীকার করেছে। ২০২০ সালে ইরান তার শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহকে হত্যার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছিল। ফ্রান্সের বিশ্লেষক লোভা রিনেল বলেন, এই হত্যাকাণ্ড ইরানের কর্মসূচিকে বিলম্বিত করেছে, কিন্তু থামাতে পারেনি।

ইসরায়েল এই হত্যাকাণ্ডের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে বেসামরিক ব্যক্তিদের ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা নিষিদ্ধ। তবে কেউ যদি সরাসরি সামরিক কাজে যুক্ত থাকেন, তাহলে নিয়মের ব্যতিক্রম হতে পারে।

জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্টিভেন আর. ডেভিড বলেন, এই বিজ্ঞানীরা এমন একটি শাসনের হয়ে কাজ করছিলেন, যারা ইসরায়েলকে ধ্বংসের হুমকি দিয়েছে। তারা এমন অস্ত্র তৈরিতে সহায়তা করছিলেন, যা এই হুমকি বাস্তবায়ন করতে পারত। তাই তাদের হত্যা বৈধ টার্গেট।

তিনি আরও বলেন, নাৎসি জার্মানি বা জাপানের নেতারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন ‘ম্যানহাটন প্রকল্পে’ যুক্ত বিজ্ঞানীদের হত্যা করতে দ্বিধা করতেন না।

তবে আইন বিশেষজ্ঞ লরি ব্ল্যাংক বলেন, এই হত্যাকাণ্ড আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধ কি না, তা এখন বলা কঠিন। কারণ, ইসরায়েলের হাতে কী ধরনের গোয়েন্দা তথ্য ছিল, তা বাইরে থেকে জানা সম্ভব নয়।

রাষ্ট্রদূত জারকা বলেন, পদার্থবিদ্যা শেখা এবং ইউরেনিয়াম সম্পর্কে জানা এক জিনিস, কিন্তু সেটিকে অস্ত্রে রূপান্তর করার সক্ষমতা সম্পূর্ণ আলাদা। যারা লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন, তাদের সেই সক্ষমতা ছিল। তাই তারা নির্মূল হয়েছেন। সূত্র: এপি

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে