কাতারের শান্ত-নিবিড় রাজধানী দোহা। কিন্তু ইরান দোহার কাছাকাছি এলাকায় অবস্থিত একটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে এক ডজনেরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করার পর গত সোমবার শহরটিতে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র।
শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে ধোঁয়া উড়ছে এবং ক্ষেপণাস্ত্রের ধাতব টুকরো আকাশ থেকে মাটিতে পড়ছে। ক্ষেপণাস্ত্রকে বাধাদানকারী ইন্টারসেপ্টর মাঝ-আকাশেই বিস্ফোরিত হয় এবং দোহায় মানুষের তৈরি কৃত্রিম দ্বীপ ‘দ্য পার্ল’ থেকেও এই দৃশ্য দেখা যায়।
বিলাসবহুল ওই এলাকায় আকাশচুম্বী সব ভবন রয়েছে। সেখানকার মানুষ বিস্ফোরণের শব্দে চমকে উঠেন এবং নিরাপত্তার খোঁজে দৌড়াতে থাকেন। ‘ভিলাজিও মলে’ আসা ক্রেতারা চিৎকার করে আশ্রয়ের খোঁজে ছোটেন। সেখানকার একটি খালে ছোট ছোট নৌকা তখনও চলছিল।
হংকং থেকে দোহায় ঘুরতে এসেছেন ২২ বছর বয়সী পর্যটক লিনাস ইয়িম। ভিলাজিও মলে কেনাকাটা করার জন্য গিয়েছিলেন তিনি। লিনাস বলেন, আমি ভেবেছিলাম কোনও সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে।
কিন্তু তিনি বাইরে এসে আকাশে ক্ষেপণাস্ত্র দেখতে পান। হামলার বিষয়ে টেলিফোনে মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে তিনি বলেন, ‘আমি জীবনে কখনও এমন পরিস্থিতিতে পড়িনি। ভেবেছিলাম হয়তো আর বাঁচব না।’’
ইরান এই হামলা চালানোর আগে মধ্যস্থতকারীদের মাধ্যমে কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়ে দিয়েছিল। যে কারণে সেখানে কেউ হতাহত হননি। তারপরও ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলার জবাবে ইরানের এই হামলা সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, কুয়েত ও ওমানসহ উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য এক দুঃস্বপ্ন হিসেবে হাজির হয়।
ব্লুমবার্গ ইকোনমিক্সের মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ দীনা এসফানদিয়ারি বলেন, ‘উপসাগরীয় দেশগুলো আসলেই চরম অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়েছে। তাদের সবচেয়ে বড় আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে। এই দেশগুলো ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনার মাঝে পড়ে গেছে।’
এই হামলার পরদিন অর্থাৎ মঙ্গলবার উপসাগরীয় দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা দোহায় জরুরি বৈঠকে বসেন। আমেরিকার নিরাপত্তার উপর নির্ভরশীল এই ছয় দেশে হাজার হাজার মার্কিন সৈন্য ও একাধিক বড় ঘাঁটি রয়েছে।
ইরাকের তৎকালীন নেতা সাদ্দাম হোসেন ১৯৯০ সালে কুয়েতে হামলা চালানোর পর ওই অঞ্চল আর কোনও যুদ্ধে জড়ায়নি। এসব দেশ নিজেদেরকে নিরাপদ ও বিনিয়োগবান্ধব হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছে।
এই সময়ে আন্তর্জাতিক পর্যটকদের নিরাপদ গন্তব্য ও বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে তারা। উপসাগরীয় দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে ইরানি নিরাপত্তা হুমকির বিরুদ্ধে পাল্টা পদেক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করেছে। এমনকি তারা তাদের প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলছে।
তেহরানের সঙ্গে তুলনামূলক ভালো সম্পর্ক রয়েছে কাতার ও ওমানের। হামলার পর ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান কাতারের আমিরের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। এ সময় তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন বলে জানিয়েছেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুলরহমান আল-থানি।
ইরানের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক রয়েছে সৌদি আরব ও বাহরাইনের। এমনকি ২০১৬ সালে তেহরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার কাছাকাছি পৌঁছেছিল দেশ দুটি। সংযুক্ত আরব আমিরাতের অবস্থাও বিশেষভাবে জটিল। ইরানকে নিরাপত্তার হুমকি মনে করলেও তেহরানের অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার আমিরাত।
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের এই টানাপড়েন কখনও কখনও সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে। ২০১০-এর দশকে সৌদি ও আমিরাত যৌথভাবে ইয়েমেনে ইরান-সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক বোমা হামলা শুরু করে।
ইরান পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে পারে বলেও উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর শঙ্কা রয়েছে। তবে এই সঙ্কটের সমাধানে সামরিক পদক্ষেপের চেয়ে কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব দেয় তারা।
এছাড়া ওই অঞ্চলে ধর্মীয় বিভাজনও এই সঙ্কটের পেছনে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। সুন্নি রাজতান্ত্রিক দেশগুলো শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ ইরানকে সন্দেহের চোখে দেখে। তারা মনে করে তাদের দেশে থাকা শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনের মাঝে অস্থিরতা ছড়িয়ে দিতে পারে ইরান।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজনৈতিক বিশ্লেষক আবদুলখালেক আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আমরা বছরের পর বছর ধরেই ইরানের পাশেই বসবাস করছি। আমরা জানি ইরানের পাশে থাকাটা কত কঠিন।’
গত সপ্তাহে সৌদি আরব, বাহরাইন ও আমিরাতের কর্মকর্তারা মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে একটি বৈঠক করেন। বৈঠকে তারা জানান, তাদের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা হলো—ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়ারা এই অঞ্চলে থাকা মার্কিন বাহিনীর ওপর হামলা চালাতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রতিনিধি জিমি প্যানেট্টা বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন; এই তথ্য তিনি জানিয়েছেন।
মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ দীনা এসফানদিয়ারি বলেন, এই আশঙ্কা একদিকে যেমন মার্কিন সৈন্যদের ব্যাপক উপস্থিতির বিষয়টিকে তাদের জনগণের কাছে স্পর্শকাতর করে তুলছে, অন্যদিকে পুরো অঞ্চলকে উত্তেজনার মঞ্চে পরিণত করছে।
কাতারে মার্কিন ঘাঁটি লক্ষ্য করে ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর প্রায় সবই প্রতিহত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সহায়তায় এসব ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করা হলেও একটি ক্ষেপণাস্ত্র উন্মুক্ত স্থানে আঘাত হানে।
এর কয়েক ঘণ্টা পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সহায়তায় ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিতে কাতার মধ্যস্থতা করেছে বলে ঘোষণা দেয় দোহা।
দোহায় এক সংবাদ সম্মেলনে কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বলেন, ‘আমরা শিগগিরই এই সঙ্কটের অবসান চাই এবং এই অধ্যায় যেন অতীত হয়ে যায়।’ তবে ইরানের এই হামলা উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
যদিও তারা ধনাঢ্যশালী এবং মার্কিন নিরাপত্তা জোটের অন্তর্ভুক্ত। বাহরাইনে সাইরেন বেজে ওঠে। বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত বিমান হাব হিসেবে পরিচিত দুবাইয়ের আকাশসীমা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়।
কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সহকারী অধ্যাপক বাদার আল-সাইফ বলেন, ‘দশকের পর দশক ধরে আমরা সতর্ক করে আসছিলাম, এই ধরনের কিছু হতে পারে। সেটাই আজ হয়েছে। আমরা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছি।’
কাতারে আল-উদেইদ বিমান ঘাঁটিতে ইরানের এই হামলা ২০১৯ সালে সৌদি আরবের একাধিক তেল স্থাপনায় ইরান-সমর্থিত ড্রোন হামলার স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেয়।
সেই সময় ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের হামলায় সৌদি আরবের তেলের উৎপাদন ব্যবস্থার প্রায় অর্ধেকই অচল হয়ে পড়েছিল। এই ঘটনার পরই সৌদি আরব বুঝে যায়, মার্কিন নিরাপত্তা সহযোগিতা অত্যন্ত সীমিত। যে কারণে ২০২৩ সালে পুনরায় পুনরায় সম্পর্ক স্থাপন করে তারা।
আমিরাত ও বাহরাইনও ইরানের দিকে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে এবং কাতারের হামলা এই প্রক্রিয়াকে থামাতে পারবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্লেষক আবদুলখালেক আব্দুল্লাহ বলেন, ইরানমুখী হওয়াই এখন কৌশল, নীতি এবং ভবিষ্যতের পথ।
একই সঙ্গে, এই হামলা উপসাগরীয় দেশগুলোর যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতাকেও ধাক্কা দিয়েছে এবং তাদের শাসকদের অনেকটাই অস্বস্তিতে ফেলেছে।
কয়েক বছর আগেও সৌদি ও আমিরাতের কর্মকর্তারা বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বের কথা বলছিলেন; যেখানে তাদের আরও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি গড়ে তোলার কথা ছিল। কিন্তু বর্তমানে এটা পরিষ্কার যে, যুক্তরাষ্ট্র আবারও পুরো অঞ্চলে শক্ত অবস্থানে ফিরে এসেছে।
আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আমরা এক মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বে আটকে আছি। প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলো উঠে আসছে। কিন্তু এখনও মূল নিয়ন্ত্রণ ওয়াশিংটনের হাতেই আছে।’
খবর: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস ও ব্লুমবার্গ ইকোনমিক্সের প্রতিবেদন