শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫, ১৩ আষাঢ় ১৪৩২

ইরান এখন কী করবে?

যাযাদি ডেস্ক
  ২৭ জুন ২০২৫, ১৬:৩৬
ইরান এখন কী করবে?
ছবি: সংগৃহীত

টানা ১২ দিন সংঘাত শেষে ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। কিন্তু যে কারণে এই লড়াই, অর্থাৎ ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করার বিষয়টি কতটা অর্জিত হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, ইরানের তিনটি স্থাপনায় হামলা চালিয়ে তাদের কর্মসূচি ‘ধ্বংস’ করা হয়েছে।

অন্যদিকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেছেন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে আক্রমণ করে যুক্তরাষ্ট্র ‘উল্লেখযোগ্য কিছু অর্জন করতে পারেনি’।

তবে ১২ দিনের এই সংঘাতে ইরান ও ইসরায়েল উভয় পক্ষই যে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সংঘাতের এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালালে পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর রূপ নেবে এমন আশঙ্কা করা হচ্ছিল। তবে এর জবাবে ইরান কাতারে মার্কিন ঘাঁটি লক্ষ্য করে পাল্টা হামলা চালালেও কোনো হতাহতের ঘটনা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রও নতুন করে আর কোনো আক্রমণ করেনি।

বরং এর পরপরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আচমকা ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা করেন। কিন্তু এই যুদ্ধবিরতি কতদিন থাকবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। আর এই সংঘাতের পর ইরান এখন কী করতে যাচ্ছে তা নিয়েও প্রশ্ন আছে অনেকের মনে।

চীন-রাশিয়া থেকে আধুনিক অস্ত্র কিনবে ইরান?

ইরান এবারের সংঘাতে টিকে গেছে। কিন্তু দেশটির সামরিক শক্তি বিশেষ করে আকাশ প্রতিরক্ষা ও বিমান শক্তি ভেঙে পড়েছে।

ইরান মূলত মিসাইল বা ক্ষেপণাস্ত্র শক্তির দেশ। সে তুলনায় এর বিমান প্রযুক্তিকে সেকেলে মনে করা হয়। তাদের নৌশক্তিও অত্যাধুনিক নয়।

এছাড়া আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তি না থাকায় দেশটি তার আকাশ রক্ষা করতে পারেনি। ফলে লড়াইয়ের শুরুতেই ইরানের আকাশ দখল করে নেয় ইসরায়েল।

একদিকে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা বিমান হামলা শনাক্ত বা কার্যকরভাবে ঠেকাতে পারেনি। অন্যদিকে দুর্বল যুদ্ধবিমানগুলোও আকাশে উড়ে ইসরায়েলের বিমান থামানোর চেষ্টা করেনি। বরং ঘাঁটিতে থাকা অবস্থাতেই বেশ কিছু বিমান ধ্বংস হয়েছে। তবে ইরান তার ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মাধ্যমে ইসরায়েলকে চমকে দিয়েছে। এসব হামলায় ব্যাপক ক্ষতির মুখেও পড়েছে ইসরায়েল।

তুরস্কভিত্তিক প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মুরাত আসলান বলেন, সংঘাত আপাতত থামার পর ইরান এখন চেষ্টা করবে সামরিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর। এক্ষেত্রে তার বড় ভরসা হবে চীন-রাশিয়া।

‘ইরানের সামনে এখন তিনটি বড় কাজ। প্রথমটি হচ্ছে, ইরান রাষ্ট্রটি নানা বিভক্তির কারণে ভেতর থেকেই দুর্বল। এখন তারা বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্য আনার উদ্যোগ নেবে।

‘দ্বিতীয়ত, ইরান এখন রাশিয়ার কাছ থেকে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির এসইউ-থার্টি ফাইভ বিমান কেনা শুরু করবে। তাদের মধ্যে যেহেতু চুক্তি আছে, এটা কয়েকমাসের মধ্যেই ঘটতে পারে।

তৃতীয়ত, ইরান এখন চীনের দিকে ঝুঁকবে আকাশ প্রতিরক্ষার প্রযুক্তি, রাডার ব্যবস্থা এবং অস্ত্র কিনতে,’ বলেন মুরাত আসলান।

তবে চীনের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আছে। তাছাড়া দেশটির অর্থনীতিও আরও দুর্বল হয়েছে। ফলে চীন-রাশিয়া থেকে অত্যাধুনিক অস্ত্র এবং প্রযুক্তি কিনতে হলে প্রচুর অর্থ খরচ করতে হবে ইরানকে। ইরানের পক্ষে কি এখন সেটা সম্ভব?

‘ইরানের ওপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আছে। কিন্তু ইরান টাকা দিয়ে কোনো অস্ত্র কিনবে না। তাদের আছে অফুরন্ত জ্বালানি তেল। তারা অস্ত্র নেবে, কিন্তু বিনিময়ে টাকার বদলে তেল দেবে,’ বলেন মুরাত আসলান।

পরমাণু কর্মসূচির কী হবে? ইরান কি পারমাণবিক বোমা বানাবে? ইরান পারমাণবিক বোমা বানাবে কি না এই প্রশ্নের নির্দিষ্ট কোনো উত্তর নেই। কারণ দেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে এরকম কোনো ঘোষণা দেয়নি। তবে পারমাণবিক কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছে ইরান। প্রশ্ন হচ্ছে, ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প কি আছে নাকি ধ্বংস হয়েছে?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফরদোসহ ইরানের তিনটি প্রকল্পে বোমা হামলা চালানোর পর দাবি করেছেন, ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। যদিও পেন্টাগনের বরাত দিয়ে দেশটির গণমাধ্যমে কতটা ধ্বংস হয়েছে তা নিয়ে সংশয়ের খবর প্রকাশ হয়।

এরমধ্যেই বৃহস্পতিবার ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে আক্রমণ করে যুক্তরাষ্ট্র ‘উল্লেখযোগ্য কিছু অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে’।

তবে বাস্তবে কতটা কী ক্ষতি হয়েছে সেটা পরিদর্শন এবং সঠিক তথ্য ছাড়া বোঝা মুশকিল।

কিন্তু ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংস হয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন না। এর কয়েকটি কারণ আছে।

প্রথমত: ইরানের নাতাঞ্জ, ইসফাহান এবং ফরদো- কেবল এই তিনটিই তাদের পরমাণু প্রকল্প নয়। এর বাইরেও ইরানের কর্মসূচি আছে।

দ্বিতীয়ত: ইরান যে প্রযুক্তিগত জ্ঞান অর্জন হয়েছে সেটা কেউ নষ্ট করতে পারবে না। তাদের প্রকল্প ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তারা সেটা আবার শুরু করতে পারবে।

তৃতীয়ত: ইরানের গোপন কোনো পরমাণু প্রকল্প আছে কিনা সেটা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না।

লন্ডনে দ্য গার্ডিয়ানের জ্যেষ্ঠ আন্তর্জাতিক প্রতিবেদক জুলিয়ান বার্গার বলেন, ইরান এখন পরমাণু বোমা বানানোর দিকেও যেতে পারে।

তিনি বলেন, ইরানের বড় সফলতা হচ্ছে যে তারা টিকে গেছে। এটা ঠিক যে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু তাদের পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর সক্ষমতা কেউ কেড়ে নিতে পারেনি।

জুলিয়ান বলেন, মনে রাখতে হবে, ইরান প্রায় ৪০০ কেজি সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম, যা দিয়ে ১০টা পরমাণু বোমা বানানো যাবে, সেটা লুকিয়ে ফেলেছে। তাদের ওপর যেভাবে হামলা হয়েছে এখন তারা এটা ভাবতেই পারে, শুধু এই পারমাণবিক বোমা থাকলেই সেগুলো তাদের এ ধরনের হামলা থেকে রক্ষার গ্যারান্টি দেবে। যেমনটা উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রে হয়েছে। নাহলে তাদের পরিণত হবে ইরাক, লিবিয়ার মতো।

তবে ইরানের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে, পরমাণু কর্মসূচিতে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ থেকে সরে আসার জন্য পশ্চিমা শক্তিগুলোর নতুন চাপ মোকাবিলা করা।

বিশেষ করে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার মতো নজরদারি প্রতিষ্ঠানগুলো এখন চেষ্টা করবে নজরদারি ও পরিদর্শনের মাধ্যমে ইরানের পরমাণু সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচির সমাপ্তি ঘটাতে।

কিন্তু ইরান এখন এসবে আগ্রহী নয়।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষেও যুদ্ধবিরতির সময় এমন কোনো শর্ত দেওয়া হয়নি। আবার ইরানের গোপন পরমাণু স্থাপনা আছে সে সন্দেহও এখন জোরালো হয়েছে।

এর মধ্যেই দেশটির সংসদ বিল পাস করেছে যে, আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার সঙ্গে তারা সম্পর্ক স্থগিত করবে।

ফলে ইরানের কর্মসূচি নিয়ে কী হতে যাচ্ছে তা সামনের দিনগুলোতেই স্পষ্ট হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে