কয়েক মাস ধরেই ধারণা করা হচ্ছিল, ভারতই হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি ‘অন্তর্বর্তী’ চুক্তি করতে যাচ্ছে। এই চুক্তি কিছু সমস্যা দূর করবে। বিশেষ করে, ভারতের ওপর ট্রাম্পের আসন্ন শুল্ক বৃদ্ধির চাপ কমাবে এবং বছরের শেষে বড় চুক্তির পথ তৈরি করবে। কিন্তু ৯ জুলাই যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই শুরুতে যে আশাবাদ ছিল তা ফিকে হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চলতি বছরের শুরুর দিকে জানান, তিনি বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের ওপর শুল্ক আরোপ করবেন। এরপর, প্রথম যে দেশগুলো জানায় যে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বড় ধরনের বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা করবে তাদের মধ্যে ভারত প্রথম দিকেই ছিল। গত এপ্রিল থেকে আলোচনার গতি আরও বেড়ে যায়। কারণ, সে সময়ই ট্রাম্প বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের ওপর তথাকথিত ‘পাল্টাপাল্টি’ শুল্ক আরোপ করেন। আপাতত এই শুল্ক ৯ জুলাই পর্যন্ত স্থগিত রয়েছে।
ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) ভারত-অর্থনীতি বিশ্লেষক রিচার্ড রোসো বলছেন, সম্প্রতি পরিস্থিতি ‘উল্টো পথে ঘুরে গেছে।’ এ মাসে দিল্লিতে হওয়া আলোচনায় দুই পক্ষের অবস্থান আরও কঠোর হয়ে গেছে বলে জানা গেছে।
আলোচনার বিষয়গুলো বেশ জটিল। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে ভারত যেন তাদের কৃষিপণ্য, বিশেষ করে জেনেটিক্যালি মোডিফাইড বা জিএম ফসল—যেমন ভুট্টা ও সয়াবিন আমদানি করে। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের জন্য এটি সহজ নয়। কারণ, ভারতের মোট শ্রমশক্তির প্রায় অর্ধেক কৃষিতে যুক্ত। দীর্ঘদিন ধরেই ভারত সরকার দেশের কৃষকদের বড় আমেরিকান কৃষি কোম্পানির সঙ্গে সরাসরি প্রতিযোগিতা থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে।
এখানে শুধু ক্ষুব্ধ কৃষকেরা নয়, ভারতের প্রভাবশালী ধনী ব্যবসায়ীদের নিয়েও সরকারের চিন্তা রয়েছে। দেশের বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী বছরের পর বছর ধরে বিদেশি প্রতিযোগিতা থেকে নিজেদের দূরে রেখেছে। তারা যে কোনো এমন চুক্তির বিরোধিতা করতে পারে, যা তাদের ব্যবসার জন্য ঝুঁকি তৈরি করে।
এ ছাড়া, মোদি সরকারের অন্যতম ভরসার জায়গা হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলোরও বিদেশিদের বড় ছাড় দেওয়ার বিষয়ে আপত্তি রয়েছে। এদের সবচেয়ে বড় সংগঠনটি যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক হুমকি ঠেকানোর উপায় হিসেবে ভারতকে এমন একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকে বের হয়ে আসার দাবি জানিয়েছে, যা মূল্যবান জিনিস—যেমন ওষুধের পেটেন্ট সুরক্ষা দেয়।
ভারতে অনেকের আশঙ্কা, ট্রাম্প প্রশাসনের ‘ন্যায্য বাণিজ্যের’ বুলি আসলে আমেরিকার একতরফা সুবিধা আদায়ের কৌশল। ভারত সরকারের সাবেক বাণিজ্য আলোচক ও থিংক ট্যাংক গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের প্রতিষ্ঠাতা অজয় শ্রীবাস্তব বলছেন, ‘কঠিন সময়সীমা ব্যবহার করে ট্রাম্প ভারতকে চাপে ফেলতে চাইছেন।’
যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের সম্পর্কে সাম্প্রতিক শীতলতা পরিস্থিতি আরও জটিল করছে। এপ্রিলে আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ভারতের দিল্লি ও আশপাশের দুই শহরে সৌহার্দ্যপূর্ণ সফর করেছিলেন। কিন্তু এরপর ট্রাম্প পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের উত্তেজনা কমাতে মধ্যস্থতার দাবি করে ভারতকে চটিয়েছেন।
বাণিজ্যকে তিনি দর–কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন—এমন ইঙ্গিত দিয়ে ভারতের ক্ষোভ আরও বাড়িয়েছেন তিনি। ১৮ জুন ট্রাম্প যখন হোয়াইট হাউসে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরকে হাসিমুখে মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়ন করেন। এতেও অনেক ভারতীয় হতবাক হয়ে যান।
ভারতের বড় প্রশ্ন হলো—ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে কোনো চুক্তি করলে সেটি তিনি কতটা মানবেন। ভারত মূলত আশ্বস্ত হতে চাইছে, চুক্তি স্বাক্ষরের পর ট্রাম্প নতুন করে শুল্ক আরোপ করতে পারবেন না। এমনকি চুক্তিতে যেন বলা থাকে, নতুন শুল্ক দিলে তাৎক্ষণিকভাবে চুক্তি পুনরায় আলোচনার সুযোগ থাকবে। কেউ কেউ মনে করছেন, ভারতের এখন অপেক্ষা করা উচিত, ট্রাম্প ৯ জুলাই সত্যিই শুল্ক বাড়ান কি না, তা দেখার জন্য। কারণ, শেষ পর্যন্ত আমেরিকার আদালত হয়তো রায় দিতে পারে যে, প্রেসিডেন্ট যেভাবে শুল্ক বাড়ানোর হুমকি দিচ্ছেন, সেটি তার এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না।
ভারতের বিশ্লেষকেরা ব্রিটেনের সঙ্গে আমেরিকার গত মে মাসে স্বাক্ষরিত অন্তর্বর্তী চুক্তিকে ভালো চোখে দেখছেন না। তারা মনে করেন, ওই চুক্তিতে ছোট দেশ ব্রিটেনকে অনেক বেশি ছাড় দিতে হয়েছে। তাই অনেকের মতে, দ্রুত এগিয়ে গিয়ে চুক্তি করলে যদি সেই ‘পুরস্কার’ হয়, তাহলে ধীরে চলাই ভালো। অজয় শ্রীবাস্তব বলছেন, ‘বাণিজ্য যুদ্ধ মানে তো গোলাবর্ষণ নয়—কেউ আপনাকে বোমা মারছে না। কাজেই আত্মসমর্পণের দরকার নেই।’