টেস্টোস্টেরন হলো মানব শরীরের অপরিহার্য এক হরমোন। এটি পুরুষের শরীর ও আচরণের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ন্ত্রন করে।
পেশীর ঘনত্ব ও শক্তিতে যেমন এর ভূমিকা রয়েছে। পাশাপাশি যৌন আকাঙ্ক্ষা ও সক্ষমতা, অস্থির ঘনত্ব, মানসিক অবস্থা ও শরীরের সার্বিক সুস্থতায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে এই হরমোনের।
পুরুষ ও নারী দুজনের শরীরেই টেস্টোস্টেরন থাকে, কিন্তু পুরুষের শরীরে এর পরিমাণ অনেক গুণ বেশি থাকে। তাই ঘাটতি হলে এর প্রভাবও প্রকাশ পায়।
জীবনধারা ও পরিবর্তনগত কারণ যেমন অনিয়ন্ত্রিত ওজন, অল্প ঘুম বা মানসিক চাপ টেস্টোস্টেরন ঘাটতিকে বাড়াতে পারে।
আবার অণ্ডকোষের অসুখ বা আঘাত, জন্মগত কারণ ও ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও ঘাটতিতে ভূমিকা রাখতে পারে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম বলেন, ‘বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত এই হরমোন খুব বেশি মাত্রায় না বাড়লেও ছেলেদের মধ্যে এটির মাত্রা বেশি থাকে।
বয়ঃসন্ধিকালের পর এই হরমোনের মাত্রাটা হঠাৎ করে বেড়ে যায় এবং সে একজন পরিপূর্ণ পুরুষ হওয়ার জন্য তৈরি হয়।
ওর দাড়ি-গোঁফ তৈরি হওয়া থেকে শুরু করে যৌনাঙ্গের পরিপক্বতা, জননাঙ্গের পরিপূর্ণ আকার, ঘাম, মানসিকভাবে পুরুষালি আচরণ— টোটালটাই এই হরমোন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তখন।’
অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম বলেন, ’আমরা সহজ করে বলে থাকি, একটা পুরুষ দাঁড়িয়ে থাকে টেস্টোস্টেরন লেভেলের উপরে।
এই লেভেলে ঘাটতি হলে বা বেশি হলে সমস্যা হতে পারে। তবে বেশি হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। কারো কারো স্বাভাবিক রয়েছে, কারো কারো কম রয়েছে, এই সম্ভাবনাই বেশি।’
যুক্তরাষ্ট্রের টুইন্সবার্গ ফ্যামিলি হেলথ এন্ড সার্জারি সেন্টারের এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট কেভিন এম প্যান্টালোন বলেন, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইর মধ্যেই টেস্টোস্টেরন হরমোন থাকে।
তবে পুরুষের মধ্যে এই হরমোনের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেশি থাকে। যার কারণে পুরুষের প্রজনন কার্যক্রম বিকাশ লাভ করে ও যৌনাঙ্গ গঠিত হয়।
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের অধীনে হার্ভার্ড হেলথ পাবলিশিং এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, টেস্টোস্টেরন এর ফলে হাড় এবং মাংস পেশীর গঠন প্রভাবিত হয়।
ছেলেদের হাড় ও মাংসপেশীর ঘনত্ব বাড়ে, রক্তে লোহিত কণিকার উৎপাদন বাড়ে, কণ্ঠস্বরে পরিবর্তন হয়ে তা ভারী হয়, মুখে দাড়িতে ও শরীরের অন্যান্য অংশে লোম বাড়ে, যৌনাঙ্গের বৃদ্ধি ঘটে। একই সাথে যৌন ক্রিয়া এবং প্রজনন সক্ষমতা জাগ্রত হয়।
টেস্টোস্টেরনের মাত্রা সর্বোচ্চ ১৭ বছর বয়সে এবং পরবর্তী দুই বা তিন দশক পর্যন্ত এর মাত্রা বেশিই থাকে। গড়ে একজন স্বাস্থ্যবান পুরুষ দিনে ছয় মিলিগ্রামের মতো টেস্টোস্টেরন উৎপাদন করে।
হার্ভার্ড হেলথ পাবলিশিং-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাভাবিক পুরুষদের মধ্যে বিভিন্ন মাত্রায় টেস্টোস্টেরন থাকার কথা জানা যায়। প্রতি ডেসিলিটারে ২৭০ থেকে শুরু করে ১০৭০ ন্যানোগ্রাম পর্যন্ত টেস্টোস্টেরন থাকতে পারে।
প্রতি ২৪ ঘণ্টায় টেস্টোস্টেরেনের মাত্রা উঠানামা করে। সকাল আটটায় এই হরমোনের উৎপাদন সবচেয়ে বেশি থাকে। আর সবচেয়ে কম থাকে রাত ৯টায়।
টেস্টোস্টেরনের ঘাটতি পুরুষদের বিকৃত যৌন আচরণের অন্যতম কারণ। টেস্টোস্টেরনের ঘাটতির কারণে পারফর্মেন্স খুব কমে গেছে, তখন সে পার্ভার্টেড কিছু অ্যাক্টিভিটির দিকে ধাবিত হয়।
যাদের ক্ষেত্রে হরমোনের ঘাটতি খুব দ্রুত হয় তারা বুঝতে পেরে চিকিৎসা নিয়ে থাকে। কিন্তু যাদের মধ্যে ধীরে ধীরে হয়, সে এর সাথে খাপ-খাইয়ে নিতে নিতে বিকৃত যৌন আচরণের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের অলাভজনক অ্যাকাডেমিক মেডিকেল সেন্টার ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের তথ্য অনুযায়ী, কম টেস্টোস্টেরনের যেসব উপসর্গ থাকে তার মধ্যে রয়েছে : যৌন তাড়না কমে যাওয়া, যৌনাঙ্গ উত্থানে অক্ষমতা, যৌন মিলনে অক্ষমতা, অণ্ডকোষ সঙ্কুচিত হওয়া, শুক্রাণুর উৎপাদন কমে যাওয়া ও বন্ধ্যাত্ব।
এ ছাড়াও ঘুমে সমস্যা, মনোযোগে সমস্যা, কাজে উৎসাহ না পাওয়া, মাংস পেশী ও শক্তি কমে যাওয়া, হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়া, পুরুষদের স্তন গঠিত হওয়া, বিষণ্ণতা, ক্লান্তি ও অবসাদ।
এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট ডা. শাহজাদা সেলিম বলেন, ৮৫-৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে অণ্ডকোষের কোনো ধরনের ক্ষতি হলে টেস্টোস্টেরনের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
বাংলাদেশে সবচেয়ে স্বাভাবিক কারণ হচ্ছে, বয়ঃসন্ধিকালে বা এর আশেপাশে যদি কারো মামস হয়ে থাকে তাহলে তার মামস অরক্রাইটিস হয়।
এটি গলার পাশাপাশি অণ্ডকোষকেও আক্রান্ত করে। এর ফলে এটি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং টেস্টোস্টেরনের ঘাটতি তৈরি হওয়ার পথ তৈরি হয়। কারণ টেস্টোস্টেরন উৎপাদিত হয় এখান থেকেই। তবে বাংলাদেশের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগীরা এটা খেয়াল করে না।
টেস্টোস্টেরন হরমোনের কার্যকারিতা ঠিক রাখতে হলে দেহের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় এক থেকে দেড় ডিগ্রি কম রাখতে হয়। কারণ অতিরিক্ত গরমে দীর্ঘক্ষণ থাকলেও টেস্টোস্টেরনের উৎপাদন কমে যেতে পারে।
ফলে অতিরিক্ত গরম জায়গায় বাস করলে, কাজ করলে, বাসের ইঞ্জিনের ওপর বসে থাকলে শারীরিক তাপমাত্রা বেড়ে যেতে পারে যা এই হরমোনের ক্ষতি করে।
পরিবেশে কিছু ক্ষতিকর উপাদানের কারণেও টেস্টোস্টেরন হরমোনের ঘাটতিকে প্রশমিত করতে পারে। রক্তে শর্করার পরিমাণ যাদের বেশি বা যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের টেস্টোস্টেরনের ঘাটতি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
আঘাতজনিত কারণ বা দুর্ঘটনার কারণে যদি কারো অণ্ডকোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, জীনগত সমস্যা থাকে, তাহলে এই হরমোনের ঘাটতি থাকতে পারে।
কারো যদি জন্মগতভাবে অণ্ডকোষ না থাকে বা সেটি যদি পরিপূর্ণ গঠিত না থাকে, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থাকে, যৌন সংক্রমণজনিত রোগ থাকে, কোনো ভাইরাসের সংক্রমণ থাকে বা টিউমার থাকে তাহলেও টেস্টোস্টেরন কমে যেতে পারে।
এ ছাড়া মস্তিষ্কে আঘাত পেলে, লিভার সিরোসিস, কিডনির সংক্রমণ, অতিরিক্ত মদ্যপান, ঘুমে সমস্যা বা স্লিপ অ্যাপনিয়া এবং মানসিক রোগের চিকিৎসায় ওষুধ সেবন করলেও এই হরমোনের ঘাটতি তৈরি হতে পারে।
যেভাবে প্রতিরোধ সম্ভব
ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের তথ্য অনুযায়ী, যদি জীনগত কারণে, অণ্ডকোষে ক্ষতির কারণে অথবা হাইপোথ্যালামাস বা পিটুইটারি গ্রন্থিতে আঘাতের কারণে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কমে যায়, তাহলে তার কোনো চিকিৎসা করা সম্ভব নয়।
তবে কিছু জীবনযাত্রায় কিছু অভ্যাস পরিবর্তন বা সংযোজন করে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা স্বাভাবিক রাখা যায়। এগুলো হলো- স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, নিয়মিত ব্যায়াম করা, ওজন নিয়ন্ত্রনে রাখা, অতিরিক্ত পরিমাণ অ্যালকোহল পান ও মাদক থেকে দূরে থাকা।
এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট ডা. শাহজাদা সেলিম বলেন, টেস্টোস্টেরনের ঘাটতি ঠেকাতে হলে দৈহিক ওজন অবশ্যই কমাতে হবে। দ্বিতীয়ত, অতিরিক্ত গরম ও রেডিয়েশন থেকে দূরে থাকতে হবে। রেডিয়েশনে কাজ করতে হলে সুরক্ষা পদক্ষেপগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে যাতে ঝুঁকি কমে যায়।
চিকিৎসা কি
টেস্টোস্টেরনের ঘাটতি কমানোর কোনো একক চিকিৎসা নেই। এই হরমোন ঘাটতির চিকিৎসা আসলে উপসর্গ ভিত্তিক। এর মাত্রা ভিত্তিক নয়। তবে হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপির মাধ্যমে কিছু উপসর্গ কমিয়ে আনা যায়। যেমন যৌন তাড়না, বিষণ্ণতার সাধারণ উপসর্গ এবং কাজে উৎসাহে ঘাটতির মতো উপসর্গ কমে আসতে পারে।
তাই এ ক্ষেত্রে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে। কারণ হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপিতে বিভিন্ন ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও রয়েছে। সূত্র: বিবিসি বাংলা