যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক নাগরিকত্ব ও পরিকল্পনা বিষয়ক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স বলছে, বিশ্বের অষ্টম দুর্বলতম পাসপোর্ট এখন বাংলাদেশের। প্রতিষ্ঠানটি ২০২৪ সালে যে তালিকা প্রকাশ করেছে, সেখানে ১০৯টি অবস্থানের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ১০২ তম।
স্বৈরশাসক কিম জং আনের দেশ উত্তর কোরিয়াও বাংলাদেশের সাথে যৌথভাবে একই অবস্থানে রয়েছে। তবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তালিকায় বাংলাদেশের চেয়ে ভারত, মালদ্বীপ, ভুটান ও শ্রীলঙ্কা এগিয়ে রয়েছে। এছাড়া সুদান, ইথিওপিয়া, ইরিত্রিয়া, লাইবেরিয়া এবং কঙ্গোর মতো আফ্রিকার দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশগুলোও পাসপোর্ট তালিকায় বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে।
হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স জানিয়েছে, অগ্রিম ভিসা ছাড়াই একটি দেশের নাগরিক বিশ্বের কতটি দেশে ভ্রমণ করতে পারেন সেটির উপর নির্ভর করেই তালিকায় প্রতিটি দেশের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির দেয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, মালদ্বীপের পাসপোর্টধারী ব্যক্তিরা যেখানে অগ্রিম ভিসাই ৯৬টি দেশ ভ্রমণ করতে পারেন সেখানে বাংলাদেশের পাসপোর্টধারীরা পারেন মাত্র ৪২টি দেশে। এই ৪২টি দেশের মধ্যে অবশ্য উন্নত কোনো দেশের নাম নেই। বেশিভাগই আফ্রিকা এবং ক্যারিবীয় অঞ্চলের দেশ।
বলা হচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে। ২০২৬ সাল পর্যন্ত স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদাও পাওয়ার কথা রয়েছে বাংলাদেশের। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এত কিছুর পরও পাসপোর্টের মর্যাদার দিকে থেকে দেশটি কেন নিচের দিকে অবস্থান করছে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা অগ্রগতি সাধন করলেও সুশাসন ও মানব উন্নয়ন সূচকসহ অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ এখনো বেশ পিছিয়ে রয়েছে।
বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এসব জায়গায় পিছিয়ে থাকার কারণে অন্যান্য দেশের কাছে বাংলাদেশের যে ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে, সেটির উপর নির্ভর করেই তারা বাংলাদেশের পাসপোর্ট তথা নাগরিকদের মূল্যায়ন করছে।’
এছাড়া বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর অবৈধ উপায়ে বিদেশে যাওয়া এবং মানব পাচারের যেসব ঘটনা ঘটছে, সেগুলো দেশটির পাসপোর্টকে দুর্বল করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
মানব উন্নয়ন সূচকে অবস্থান :
২০২২ সালে জাতিসঙ্ঘের পক্ষ থেকে সর্বশেষ যে মানব উন্নয়ন সূচক প্রকাশ করা হয়েছে, সেখানে ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় কিছুটা ভালো অবস্থানে থাকলেও শ্রীলঙ্কার তুলনায় বেশ পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।
বিশ্বের ১৯১টি দেশের মধ্যে শ্রীলঙ্কার অবস্থান যেখানে ৭৩তম, সেখানে বাংলাদেশ রয়েছে ১২৯তম স্থানে। যদিও গত এক দশকে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলেন, ‘তারপরও তালিকায় বাংলাদেশ পেছনে পড়ে গেছে, কারণ অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায়নি।’
জাল পাসপোর্ট : যেসব দেশের পাসপোর্ট সহজেই জাল করা যায় সেগুলোকে দুর্বল পাসপোর্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘একটি দেশের পাসপোর্টধারী মূলত তার নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। কিন্তু সেটি যদি জাল হতে থাকে, তাহলে ভিসা দেয়ার ক্ষেত্রে অন্য দেশগুলোর মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক। সে কারণেই উন্নত দেশগুলো এমনভাবে পাসপোর্ট তৈরি করে, যেন সেটি সহজে জাল করা না যায়।’
তৌহিদ বলেন, ‘যেমন মনে করেন, কেউ চাইলেই ব্রিটিশ বা আমেরিকান পাসপোর্ট জাল করতে পারবে না। তাদের পাসপোর্ট জাল করা খুবই কঠিন।’
বাংলাদেশে আগে প্রায়ই জাল পাসপোর্ট তৈরির অভিযোগ পাওয়া যেত। ফলে এটি বন্ধ করার জন্য ২০২০ সালে ই-পাসপোর্ট চালু করে সরকার।
মানবপাচার : বিশ্লেষকরা বলছেন, একটি দেশ থেকে মানব পাচার হওয়ার অর্থ হচ্ছে দেশটি তার নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে এবং সেখানে অপরাধীদের সক্রিয় চক্র রয়েছে। এটি একটি দেশের পাসপোর্টকে দুর্বল করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে।
জাতিসঙ্গ জানায়, সরকারের নানা তৎপরতার পরও বাংলাদেশ থেকে এখনো মানবপাচারের মতো ঘটনা ঘটছে।
এ বিষয়ে গত বছর যৌথভাবে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে জাতিসঙ্ঘের অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা আইওএম এবং জাতিসঙ্ঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক দফতর। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সাতটি জেলায় সবচেয়ে বেশি মানব পাচারের ঘটনা বেশি শনাক্ত করা হয়েছে। এসব জেলা হচ্ছে মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, নড়াইল, ঝিনাইদহ, শরীয়তপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং হবিগঞ্জ।
এসব জেলা থেকে প্রতি লাখে দেড় জনের বেশি মানুষ পাচারের শিকার হচ্ছে। যেসব কারণে মানব-পাচার হয় তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটে থাকে উন্নত জীবনের আশায় এবং আর্থিক স্বচ্ছলতার প্রলোভনে।
প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রায় ৫১ শতাংশ মানুষ অর্থনৈতিক কারণে পাচারের শিকার হন।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘এতে অন্যদেশের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে পাসপোর্টে।’
অবৈধ পথে বিদেশ গমন : বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে দ্বিগুণ হওয়ার পরও দেশেটি থেকে অবৈধ উপায়ে বিদেশে যাওয়ার ঘটনা বন্ধ হয়নি। এখনো প্রতি বছর হাজার হাজার বাংলাদেশী অবৈধ পথে বিদেশে যাচ্ছেন, যাদের অনেকে মারাও যাচ্ছেন। সম্প্রতি এমনই একটি ঘটনায় সমুদ্রে ডুবে বাংলাদেশী আট নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে।
জানা গেছে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রপথে অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়া সময় ভূমধ্যসাগরে তাদের নৌকা ডুবে যায়।
সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলেন, ‘উন্নত জীবনের আশায় অবৈধ পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও যখন একটি দেশের নাগরিক বিদেশে যেতে চান, তখন সেই দেশটির আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও জীবনমান নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়।’
কবির মনে করেন, পাসপোর্টেও সেই মনোভাবের প্রকাশ দেখা যায়।
কর্ম দক্ষতা : বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর যত মানুষ বিদেশে কাজ করার জন্য যান, তাদের বেশিভাগই যান অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে। বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে গেছেন প্রায় সাড়ে ১১ লাখ শ্রমিক। তাদের মধ্যে দক্ষ শ্রমিক ছিলো মাত্র ১৭.৭৬ শতাংশ। একই সময়ে পেশাদার শ্রমিক গেছে মাত্র ০.৩৩ শতাংশ।
কর্ম দক্ষতা না থাকায় এসব শ্রমিকের অধিকাংশই যেমন ভালো বেতনের কাজ পান না, তেমনি ভাষাগত জ্ঞান না থাকায় অনেকে যোগাযোগও করতে পারেন না বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এর ফলে বিশ্বের অনেক দেশে কাছেই বাংলাদেশের পরিচিতি ঘটছে একটি অদক্ষ শ্রমিক সরবরাহকারী দেশ হিসেবে।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘অথচ সেখানে ভারত ও শ্রীলঙ্কা দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মশক্তি সরবরাহ করে অনেক এগিয়ে গেছে এবং নিজেদের সেভাবে পরিচয় কমিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে।’
সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা : হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স এ বছর যে তালিকা প্রকাশ করেছে, সেটির একেবারে নিচের দিকে রয়েছে, আফগানিস্তান, সিরিয়া ও ইরাক। এই তিনটি দেশই যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে বেশ অস্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে।
হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর ফলে দেশগুলোতে বসবাসরত নাগরিকদের অনেকেই আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, যার ফলে তারা উন্নত ও নিরাপদ জীবনের আশায় অবৈধ উপায়ে হলেও বিদেশে চলে যেতে চাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতির কারণে অনেক দেশই এখন আফগানিস্তান, সিরিয়া ও ইরাকের নাগরিকদের অগ্রিম ভিসা দিতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, গণতন্ত্র ও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক মহলে নানা প্রশ্ন রয়েছে। ফলে দেশটির নাগরিকদের অনেকের মধ্যেই উন্নত দেশে চলে যাওয়ার এক ধরনের প্রবণতা তৈরি হয়েছে।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন মনে করছেন, ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে এটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
হোসেন বলেন, ‘এক্ষেত্রে যারা ইউরোপ বা আমেরিকার ভিসা নিতে চাচ্ছেন, তাদের উদ্দেশ্য বিবেচনা করে তবেই ভিসা দেয়া হচ্ছে যেন তারা সেখানে থেকে যেতে না পারেন।’
সুশাসন : উপরে যতগুলো বিষয় আলোচনা করা হয়েছে, সেগুলোর প্রতিটিই একটি দেশের সুশাসনের সাথে জড়িত বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলেন, ‘যেই দেশগুলোর পাসপোর্টের মূল্য বেশি, মনে করা হয় যে ওই দেশগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলো শক্তিশালী, তাদের অর্থনীতি ভালো, তাদের শাসন ব্যবস্থা ভালো এবং বর্হিবিশ্বের কাছে তাদের একটা ইতিবাচক ভাবমূর্তি রয়েছে।’
কবির মনে করেন, ‘কাজেই অর্থনৈতিক অগ্রগতির পাশাপাশি সামাজিক সুশাসন নিশ্চিত করা না গেছে পাসপোর্টের মর্যাদা বাড়ানো সম্ভব নয়।
র্যাঙ্কিং দিয়ে কী বোঝানো হয়? বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলেন, পাসপোর্টের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে নাগরিকত্বের মূল্যায়নই করা হয়। পাসপোর্টের এই র্যাঙ্কিংয়ের মাধ্যমে জানা যায় আপনার দেশ সম্পর্কে বা আপনার পাসপোর্ট সম্পর্কে তাদের মূল্যায়নটা কী?
কবির জানান, ‘পাসপোর্টের এই র্যাঙ্কিংটা দেশের অর্থনীতি, শাসনব্যবস্থা ও দেশের মানুষের অবস্থাসহ অনেকগুলো বিষয় বিবেচনা করে তৈরি করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘র্যাঙ্কিংটা ওরা করে পার্সেপশনের (ধারণার) ভিত্তিতে। কোন দেশের পাসপোর্টের দাম বেশি বা কম, সে বিষয়ে কিছু স্টেকহোল্ডারদের মতামত নেয় তারা।’
কবির বলেন, ‘কোন দেশের পাসপোর্টের মূল্য কত, তা নির্ভর করে ওই পাসপোর্টের কী গুণাগুণ রয়েছে তার ওপর।’
পাসপোর্টের র্যাঙ্কিং উপরের দিকে থাকার প্রধান সুবিধা সম্পর্কে কবির বলেন, ‘আপনি একটু ভালো ব্যবহার পাবেন। কোনো দেশের ভিসার জন্য আবেদন করলে হয়তো কিছুটা নমনীয়ভাবে দেখা হয়।
কবির বলেন, ‘আর র্যাঙ্কিংয়ে নিচের দিকে থাকলে ভিসা দেয়ার ক্ষেত্রে পাসপোর্টধারী সম্পর্কে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খোঁজ-খবর নেয়া থেকে শুরু করে ভিসার আবেদন নাকচও করতে পারে কোনো দূতাবাস। সূত্র : বিবিসি
যাযাদি/ এস