চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার যেন বৈষম্যহীনতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। মানবিকতার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে উঠেছে কারাগারটি। বর্তমানে কারাগারে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ইস্পাত কঠিন শৃঙ্খলা ও বন্দীদের উন্নত জীবনমানের জন্য বন্দি ও স্বজনদের মধ্যে স্বস্তি বিরাজ করছে। জুলাই আগস্ট পরবর্তী সিনিয়র জেল সুপার ও জেলার কারাগারের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছেন। কারাগারকে মানবিক পুনর্বাসন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তারা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।
কারাগারে বন্দীদের শুধু আটকে রাখা নয়, বরং তাদের দক্ষতা বাড়িয়ে সমাজে পুনর্বাসন করতে কারাগারে নানা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ: বাঁশ ও বেতের বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি, তাঁত শিল্প, মৃৎশিল্প, অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্র, জামদানি শাড়ি তৈরি, কাঠের কারুকাজ ও দর্জি কাজ শেখানো হয়।
কারাভ্যন্তরে ক্ষুদ্র উদ্যোগ: বন্দীরা নিজেদের তৈরি করাপণ্য কারাগারের কেন্টিনে পিসির মাধ্যমে বিক্রি করার সুযোগ পান , যা তাদের আয় করার সুযোগ করে দেয়। এভাবে কারাগার থেকে মুক্তির পর তারা সমাজে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে সক্ষম হবে।
কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের খাদ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নে সিনিয়র জেল সুপার সুরাইয়া আক্তার ও জেলার একেএম মাসুম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। বন্দীদের সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে নিয়মিত মেনু পর্যালোচনা করা হয়। প্রতিদিনের খাদ্যে সরকার অনুমোদিত তাজা সবজি ও প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান নিশ্চিত করা হয়।
কারাগারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও আধুনিক ও শক্তিশালী করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সিসিটিভি ক্যামেরা, বডিস্ক্যানার, লাগেজস্ক্যানার, আর্চওয়ে মেটাল ডিটেক্টর সক্রিয় রাখাসহ নতুন নতুন নিরাপত্তা প্রযুক্তি সংযোজন করা হয়েছে, যাতে অবৈধ কার্যকলাপ প্রতিরোধ করা যায়। কারাগারে মাদকের প্রবেশ বন্ধ করতে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
কারাগারের কারারক্ষী ও কারা সদস্যদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে তারা আরও দক্ষ হয়ে ওঠেন। ফলে কারাগারের শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার মান উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
এছাড়া গভীর অনুসন্ধানে জানা যায়, কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের বন্দীরা এখন আগের তুলনায় ভালো খাবার, স্বাস্থ্যসেবা ও স্বজনদের সঙ্গে স্বস্তির সাথে দেখা করার সুযোগ পাচ্ছেন।
সম্প্রতি কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বলেন, "আমি কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলাম। যখন প্রথম এখানে আসি, তখন খাবার নিয়ে কিছু অভিযোগ ছিল, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে খাবারের মান অনেক উন্নত হয়েছে। প্রতিদিনের খাবারে বন্দিরা পর্যাপ্ত পরিমাণে সবজি, ডাল, মাছ বা মাংস পাচ্ছেন। খাবারের স্বাদ আগের তুলনায় অনেক ভালো এবং স্বাস্থ্যকর হয়েছে। এই বন্দী আরো জানান, কারাগারের জেলার স্যার ও জেল সুপার স্যার নিয়মিত সাপ্তাহিক ফাইলে আমাদের সাথে কথা বলেন।
কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হয়ে ভালো কাজ করার পরামর্শ দেন।
কারাগারে বন্দীরত সুমন নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যরা সাক্ষাৎ করে বলেন, "সবচেয়ে বড় স্বস্তির বিষয় হচ্ছে আমরা যখন সুমনের সাথে কারাগারের নির্ধারিত সময়ে সাক্ষাৎ করতে আসি তখন কোনো ধরনের হয়রানি বা অতিরিক্ত ঝামেলা ছাড়াই দেখা করতে পারি; আগের তুলনায় এখন প্রক্রিয়াটি অনেক সহজ এবং স্বচ্ছ।"
এছাড়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কারাগারের এক করারক্ষী বলেন, "জেল সুপার স্যার ও জেলার স্যারের সার্বিক দিকনির্দেশনায় আমাদের কারাগারের যাবতীয় কার্যক্রম খুব সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হচ্ছে। সবার প্রতি সমতা ও ন্যায্যতা বজায় রেখে জেল সুপার স্যার ও জেলার স্যার কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক কারারক্ষী বলেন, "দীর্ঘদিন যাবৎ কারাগারে কর্মরত আছি, বর্তমান জেল সুপার ও জেলার এর মতো সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা খুব কমই দেখেছি। দুই স্যারের তত্ত্বাবধানে কারাগারে বন্দীরা সুন্দর, সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করছেন এবং আমরা যারা কর্মকর্তা-কর্মচারী আছি, তারাও স্যারদের অনুপ্রেরণা ও সাহস নিয়ে স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করছি। এছাড়া বন্দীদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের কারিগরি বিষয়ের উপর স্বল্পমেয়াদি ও মধ্যমেয়াদি প্রশিক্ষণ আয়োজন করা হয়েছে।"
এই বিষয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসক তানভীর আহমেদ এর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, আমি নিয়মিত কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শন করি। কারাগারের বন্দিদের জন্য কারা কর্তৃপক্ষ মানবিকভাবে কাজ করছেন। আমি তাদেরকে সাধুবাদ জানাই।
ঢাকা বিভাগের ডিআইজি প্রিজন্স মো. জাহাঙ্গীর কবির এর সাথে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের বিষয়ে কথা বললে তিনি জানান, "আপনারা জানেন আমাদের মিশন হচ্ছে 'রাখিব নিরাপদ দেখাবো আলোর পথ'। ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে আমাদের এই মিশনকে শতভাগ বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সমালোচনা আছে, থাকবে। কিন্তু সেজন্য মনোবল না হারিয়ে বন্দি ও স্টাফ কল্যাণে সততার সাথে নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়ার জন্য আমি এবং মাননীয় আইজি প্রিজন্স স্যার সবসময়ই স্থানীয় কারা কর্তৃপক্ষকে উৎসাহ দিয়ে আসছি। দেখা যাক।"
যাযাদি/এস